ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের যুদ্ধশিশু ৯;###;কাজ করেছেন প্রাদেশিক ও ফেডারেল গবর্নমেন্টে

রিজা রুফিয়া রশফোর কানাডায় প্রতিষ্ঠিত, অভিজ্ঞ শিল্প নির্দেশক

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রিজা রুফিয়া রশফোর কানাডায় প্রতিষ্ঠিত, অভিজ্ঞ শিল্প নির্দেশক

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বাবার কোন ঠিকানা নেই। মা কোথায় আছেন। বেঁচে আছেন কিনা, জানেন না। জন্মের পর থেকেই অন্যের সেবায় বেড়ে ওঠা। তারপর দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমানো। সেখানে যাদের কাছে মানুষ তাদের সঙ্গেও রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। সব মানুষের জীবনে এ রকম গল্প নেই। হয়ও না। যাদের আছে তাদের কষ্টের যেমন শেষ নেই তেমনি হৃদয়ে দগদগে ক্ষতের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। যার জীবনে পিতৃ পরিচয় নেই, আপনজন নেই; জন্ম হয়েছে শিশু ভবনে। তিনি সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবেন, একথা তো কল্পনাই করা যায় না। তবে যুদ্ধশিশু রুফিয়ার বেলায় তাই হয়েছে। জীবনের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে কানাডা শহরে তিনি আজ প্রতিষ্ঠিত। বহুমুখী প্রতিভা তার। তিনি একাধারে কানাডার প্রাদেশিক ও ফেডারেল গবর্নমেন্টেও কাজ করেছেন। টরন্টো ডমিনিয়ন (টিডি) ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাছাড়া রয়্যাল ব্যাংক অব কানাডা এবং ব্যাংক অব মন্ট্রিয়লে কাজ করেছেন। আজকের টরন্টোর রিজা একজন অভিজ্ঞ আর্ট ডিরেক্টর এবং ডিজাইনার। আর অভিজ্ঞতা তাকে সম্পৃক্ত করেছে প্রসিদ্ধ কর্পোরেট ক্লায়েন্টসের সঙ্গে। তিনি পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ডিজাইনিং থেকে শুরু ডিজিটাল ডিরেকশন পর্যন্ত উঠতে পেরেছেন। রুফিয়ার বেড়ে ওঠা ॥ ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকার মাদার তেরেসা শিশু ভবনে রুফিয়ার জন্ম। জন্মের সময় ওজন ছিল দুই কেজি। দাপ্তরিক নথিপত্রে তার নাম দেয়া হয়েছিল রিটা (রিজা) রুফিয়া। জন্মের পর অনাথ আশ্রমে নবজাতককে রেখে যান ওর মা। বাংলাদেশ থেকে কানাডা যাবার পর ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই সংবাদ মাধ্যমে খবর ছাপা হয়। শিশুটির নাম ছাপা হয়েছিল রিজা। যুদ্ধশিশুদের আগমনের খবরে সবখানে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। রশফোরেরা তার নাম রিজা রুফিয়া রেখে শেষে পরিবারের নাম রশফোর যুক্ত করেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে শিশুটির নাম হয়েছিল, রিজা রুফিয়া রশফোর। ’৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস গ্রন্থের লেখক মুস্তফা চৌধুরী রুফিয়া সম্পর্কে তার কাছে জানতে ই-মেল করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন উত্তর বা আগ্রহ না থাকায় পাবলিক ডোমেইনে যে তথ্যাদি ছিল সেখান থেকেই বইতে যুক্ত করা হয়েছে। ব্যাংকার জীবন ॥ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রিজা কলেজে গ্রাফিক্স ডিজাইন পড়ে এবং এডভার্টাইজিং পেশাজীবী হিসেবে কাজও করে আসছেন গত কয়েক বছর ধরে। প্রডাকশন শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করে রিজা প্রাদেশিক ও ফেডারেল গবর্নমেন্টেও কাজ করেছেন। তিনি টরন্টো ডমিনিয়ন (টিডি) ব্যাংকে কাজ করছেন। তাছাড়া রয়্যাল ব্যাংক অব কানাডা এবং ব্যাংক অব মন্ট্রিয়লেও কাজ করেছেন। এখন টরন্টোর রিজা একজন অভিজ্ঞ আর্ট ডিরেক্টর এবং ডিজাইনার। আর অভিজ্ঞতা তাকে সম্পৃক্ত করেছে প্রসিদ্ধ কর্পোরেট ক্লায়েন্টসের সঙ্গে। তিনি পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ডিজাইনিং থেকে শুরু ডিজিটাল ডিরেকশন পর্যন্ত উঠতে পেরেছেন। প্রকাশ্য তথ্য থেকে বলা যায়, রিজা দক্ষতা এবং গুণের চর্চার সমাহারে নিজের জন্য একটি সফল পেশাজীবীর ব্যস্ত জীবন গড়ে নিয়েছেন। রিজা আজ কানাডাকে নিজের দেশ মনে করেন। সেখানে তিনি সফল ও দক্ষ পেশাজীবী। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে তারেক মাসুদের অনন্য সৃষ্টি ‘মুক্তির গান’। এতে এক মুক্তিযোদ্ধা বলেছিলেন- দেশের স্বাধীনতার জন্য দেশান্তরী- দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। ১৯৭২ সালের ২২ জুলাই বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ওয়ার বেবিস লিভ ফর নিউ হোম। লেখক মুস্তফা চৌধুরী তার বইতে ২১ শিশুর ছবি ছেপেছেন। ১৯৭২ সালের জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার মাদার তেরেসা শিশু ভবনে ছবিটি তোলা হয়। এদের মধ্য থেকে ১৫ শিশুকে পাঠানো হয় কানাডায় দত্তক দিয়ে। বাকি ৬ শিশুর স্বাস্থ্য এত খারাপ ছিল যে, দীর্ঘ বিমানযাত্রার ধকল তারা সামলাতে পারবে না বলে মনে করা হয়। এই ৬ শিশু কোথায় আছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিতাদের মধ্যে যারা গর্ভবতী হয়েছেন, সেটা ‘অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ জন্য কেন ধর্ষিতা নারী সমাজচ্যুত হবে? কেন পরিবার ও সমাজের ভয়ে জন্মদাত্রীরা সন্তানকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল? আমরা কেন মানবিক হতে পারিনি? প্রশ্নটিই জোরালোভাবে এখন সামনে এসেছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে তেমন কোন আলোচনা হয়নি। তারা এখন কোথায় আছে, বাংলাদেশে কারা আছেন; এ সম্পর্কে কারো কাছে কোন তথ্য বা গবেষণা নেই। গবেষকরা বলছেন, কানাডাসহ কয়েকটি দেশের মানবতাবাদী কয়েকটি পরিবারে বাংলাদেশের একদল শিশু বেড়ে উঠেছিল। তাদের মায়েরা মাতৃত্বের অনাবিল তৃপ্তি-আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন চারদিকের বিষাক্ত পরিবেশের কারণে। তাই এসব শিশুর ব্যাপারে কেউ কোন আগ্রহ দেখাননি। নীড়শূন্য রশফোর দম্পতি ॥ বর্তমানে প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের বাসিন্দা রুফিয়ার বাবা-মা। ফিল ও ডায়ান রশফোর ১৪ দত্তকগ্রাহী মা-বাবার মধ্যে যুদ্ধশিশু রুফিয়াকে ১৯৭২ সালে দত্তক নিয়েছিলেন। ফ্রেড ও বনি ক্যাপচিনো বাংলাদেশ থেকে রশফোর দম্পতির জন্য শিশুটিকে কানাডা নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মুস্তফা চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন রশফোর দম্পতি। তখন তারা জানান, রুফিয়াকে দত্তক নেবার সময় তারা অন্টারিও এসপানোলা শহরে বসবাস করেন। তখন তারা অন্যান্য দত্তকগ্রাহী বাবা-মা বিশেষ করে যারা অন্টারিও প্রদেশে বসবাস করেতেন তাদের সঙ্গে বেশ ভাল যোগাযোগ রাখছিলেন। রশফোর দম্পতি তখন ছয়টি ছেলেমেয়ে লালন করত। যাদের মধ্যে দত্তক ৩ ও ঔরসজাত তিন। ফিল ও ডায়ান বলেন, কানাডাতে বহুজাতিক ছেলেমেয়ের পরিবার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে গিয়েই দত্তক নেবার কথা ভাবেন। ৪০ বছর পরে তারা মনে করেন তারা নিশ্চিতভাবে সেটা তাদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী করেছেন। আজ রশফোর দম্পতির নীড় শূন্য; কারণ, ছেলেমেয়েরা যার যার জীবন শুরু করেছেন। তাদের সন্তানরা বর্তমানে তিনটি দেশে বসবাস করছেন। তবে বাবা-মায়ের সঙ্গে সবার যোগাযোগ রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার বহু নারী গর্ভবতী হয়েছিলেন। মায়ের গর্ভে মৃত্যু হয়েছিল এমন শিশু, অপুষ্ট ও অপরিণত নবজাতকের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। যদিও এর সঠিক কোন হিসাব নেই। সেবা সদন ও শিশু ভবনে যারা ছিলেন তাদের অনেকের প্রসবকালে জটিলতা হয়েছিল। যার মধ্যে মায়েদের উচ্চ রক্তচাপের বিষয় ছিল। ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে যেসব ধর্ষিতা যুদ্ধশিশুকে গর্ভধারণ করেন সে শিশুরা ১৯৭১ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই জন্মানোর কথা। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় জাতীয় নারী পুনর্বাসন বোর্ড কর্তৃক ১৯৭২ সালে যে ২২ সেবা সদন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে তিন থেকে চার হাজার শিশুর জন্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর শিশু সদনের সিস্টার ম্যারির সঙ্গে কথাবার্তা বলে কানাডা থেকে আসা প্রতিনিধিদল জানতে পারে, বহু জন্মদাত্রী সন্তানদের লুকিয়ে রেখেছিলেন। যেহেতু তারা সন্তানদের গোপনে পরিত্যাগ করতে চান অথবা কেউ কেউ নবজাতককে পরিত্যাগ করতে চান না; হয়ত রাখতে চান এমন মানসিকতা থেকেই লুকিয়ে রাখার বিষয়টি এসেছিল। তারা জানান, যুদ্ধশিশু ও তাদের মায়েদের নিয়ে অনেক জনশ্রুতি থাকলেও কিছু প্রকৃত প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে।
×