ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

আফ্রিকার রাজত্ব ফের ক্যামেরুনের

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আফ্রিকার রাজত্ব ফের ক্যামেরুনের

আফ্রিকান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার করেছে ক্যামেরুন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি গ্যাবনের লিবারভিলের স্টাডে ডি এলআমিটে স্টেডিয়ামে আফ্রিকান নেশন্স কাপ ফুটবলের ফাইনালে মিসরকে ২-১ গোলে হারিয়ে মুকুট জয় করে রজার মিলারের দেশ। এ জয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর পর আফ্রিকান সেরার মুকুট পুনরুদ্ধার করেছে ক্যামেরুন। এর আগে দুবার ফাইনালে মিসরের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ক্যামেরুনের। হারটা আর হ্যাটট্রিকে পরিণত করতে দেয়নি আফ্রিকান সিংহরা। মধুর প্রতিশোধ নিয়ে আফ্রিকান ফুটবলের রাজা এখন ক্যামেরুন। ২০০২ সালে সর্বশেষ এ আসরে ট্রফি জিতেছিল ক্যামেরুন। এবার ১৫ বছর পর চ্যাম্পিয়ন হয়ে পঞ্চমবার আফ্রিকান সেরা হলো দেশটি। শুধু তাই নয়, নেশন্স কাপের ফাইনালে এই প্রথম মিসরকে হারাল ক্যামেরুন। ১৯৮৬ ও ২০০৮ সালে ফাইনালে মিসরের কাছে হেরেছিল রজার মিলারের দেশ। মিসরের সর্বোচ্চ সাতবারের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পঞ্চমবার নেশন্স কাপের শিরোপাজয়ী এখন ক্যামেরুন। ১৯৯৪ সালের পর এই প্রথম টুর্নামেন্টের ফাইনালে পিছিয়ে পড়েও শিরোপা জয় করার রেকর্ড গড়ল কোন দেশ। এবারের আসরের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন ক্যামেরুনের মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান বাসোগগ। অনেকটা অসম্ভবকে সম্ভব করেই আফ্রিকান নেশন্স কাপ জয়ের উৎসব উদ্যাপন করছে ক্যামেরুন। ম্যাচে শুধু পিছিয়ে পড়াই নয়, ইতিহাসও তাদের পক্ষে ছিল না। তাছাড়া অনেকটা নতুন দল নিয়ে মিশনে এসেছিলেন বেলজিয়ান কোচ হুগো ব্রুস। বিষয়টি তার কাছে চ্যালেঞ্জ জেতার মতোই। বেশ কয়েকজন শীর্ষ তারকাকে দল থেকে বাদ দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে ছিলেন ব্রুস। কড়া সমালোচনা সইতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জটা দারুণভাবেই জিতে নিয়েছেন তিনি। এখন তো ক্যামেরুনের বীরে পরিণত হয়েছেন সফল এ কোচ। গ্যাবনের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে উপচেপড়া দর্শক উপস্থিত হয়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন ক্যামেরুনের সমর্থক। সার্থক হয়েছে তাদের এ উপস্থিতি। শিরোপা জয়ের উৎসবে যোগ দিতে পেরে ধন্য হয়েছে তারা। বলতে গেলে অনেকটা আনকোরা দল নিয়েই নেশন্স কাপের মতো টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল ক্যামেরুন। দলে নামডাকওয়ালা কোন তারকা ফুটবলারেরই উপস্থিতি ছিল না। লিভারপুল ডিফেন্ডার জোয়েল ম্যাটিপ, সাকলে স্ট্রাইকার এরিক চুপো মোটিংসহ আটজন নামকরা খেলোয়াড়ই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন। ২৩ সদস্যের স্কোয়াডের ১৪ জনই প্রথমবারের মতো নেশন্স কাপে খেলেছেন। তবুও শেষ হাসি হেসেছেন তারা। ম্যাচের ২২ মিনিটে মোহাম্মদ এলনেনির গোলে এগিয়ে যায় মিসর। মোহাম্মদ সালেহর বলটি গোলে পরিণত করেন তিনি (১-০)। দ্বিতীয়ার্ধে এসে পাল্টে যায় খেলার চেহারা। বদলি খেলোয়াড়রাই মূলত ম্যাচের চেহারা পাল্টে দেন। ৫৯ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় এনকলু গোল করে ক্যামেরুনকে সমতায় ফেরান (১-১)। শেষ বাঁশি বাজার মাত্র দুই মিনিট আগে অদম্য সিংহদের এগিয়ে দেন আবুবকর (১-২)। এতেই উৎসবে মেতে ওঠে ক্যামেরুনের সমর্থকরা। ম্যাচ শেষে বেলজিয়ান কোচ হুগো ব্রুস বলেন, আমি নতুন কিছু তরুণ খেলোয়াড় সংগ্রহ করে কাজ শুরু করেছিলাম। সবাই ভালভাবেই কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছি। এখন থেকে আমরা দল হিসেবেও পরিণত হলাম। কোচের খেলোয়াড় নির্বাচন এতটাই ইতিবাচক ছিল যে, অতিরিক্তের তালিকায় থাকা ফুটবলারদের মধ্যেও ছিল দারুণ অনুপ্রেরণা। লিও’র ডিফেন্ডার এনকলু ইনজুরিতে পড়া এডলফে তাইকেউ’র পরিবর্তিত হিসেবে মাঠে নেমে গোল করেছেন। অপরদিকে তুরস্কের ক্লাব বেসিকটাসের সেন্টার ফরোয়ার্ড আবুবকরও টামবের পরিবর্তিত হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন। জয়সূচক গোলটিও করেন সুযোগসন্ধানী এ ফুটবলার। নেশন্স কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে ২০১৭ সালের ফিফা কনফেডারেশন্স কাপের সর্বশেষ দল হিসেবে মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে ক্যামেরুন। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরে প্রিলিমিনারি রাউন্ডে গ্রুপ ‘বি’-তে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি, চিলি ও অস্ট্রেলিয়ার পর চতুর্থ দল হিসেবে জায়গা করে নিল ক্যামেরুন। আগামী ১৮ জুন মস্কোর স্পার্টাক স্টেডিয়ামে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন কাপে চিলির বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে এবারের কনফেডারেন্স কাপ মিশন শুরু করবে হুগো ব্রুসের দল। সর্বশেষ ২০০৩ সালে কনফেডারেশন্স কাপে খেলেছিল ক্যামেরুন। সেবার রানার্সআপ হয়েছিল দেশটি। রজার মিলারের দেশ আবারও আফ্রিকান সেরা। এই মিলারের কথা মনে আছে? ১৯৮২ বিশ্বকাপে গ্রুপপর্ব থেকেই ক্যামেরুনের বিদায়। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ খেলার আর সুযোগ হয়নি। পরের বছরই বুটজোড়া খুলে রাখার ঘোষণা দেন রজার মিলার। অবসর উপলক্ষে ঘটা করে অনুষ্ঠানও সেরে ফেলেন। ১৯৯০ বিশ্বকাপের মূলপর্বে আবারও খেলার সুযোগ এলো ক্যামেরুনের। রজার মিলারের বুটজোড়া তখন শোকেসে। নিজে না খেললেও দলের খেলাটা প্রাণভরে উপভোগ করবেন ঠিক করলেন। ঠিক সেই সময় প্রেসিডেন্টের ফোন, ‘খেলতে হবে তোমাকে।’ ততদিনে বয়স হয়ে গেছে ৩৮। তাতে কী? চেষ্টা করে দেখতে তো দোষ নেই। সিদ্ধান্ত বদলালেন। অবসর ভেঙ্গে যোগ দিলেন জাতীয় দলে। জায়ান্ট কিলার হিসেবে ইতালিতে পা রাখল আফ্রিকান সিংহরা। প্রথম ম্যাচেই আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারালো সিংহরা। দ্বিতীয় ম্যাচ রোমানিয়ার বিপক্ষে। দুটি গোল এলো বুড়ো মিলারের পা থেকে। দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গেল ক্যামেরুন। দ্বিতীয় রাউন্ডে মিলারদের প্রতিপক্ষ টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা ভালদেরামার কলম্বিয়া। কিন্তু রজার মিলারের ঝলকানিতে মলিন ভালদেরামারা। দুটি গোল করে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে ক্যামেরুনকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গেলেন মিলার। অতিরিক্ত সময়ে করা তার একটি গোল আজও স্মরণীয়। উপরে উঠে আসা কলম্বিয়ান গোলরক্ষক রেনে হিগুয়েতার কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে লক্ষ্যভেদ করেন মিলার। সে গোল উদযাপনের ভঙ্গিটা ছিল আরও অদ্ভুত। মাঠের কোনায় গিয়ে স্টিক ধরে কী এক ভঙ্গিতে যেন নাচ। হবে হয়ত আফ্রিকার প্রথাগত কোা নৃত্য। রজার মিলারের উদ্যাপনভঙ্গি সে সময় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কোকা-কোলা তাদের বিজ্ঞাপনচিত্রেও রজার মিলারের সে উদ্যাপনভঙ্গি ব্যবহার করে। ইতালি বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের জয়রথ থামে গ্যারি লিনেকারের ইংল্যান্ডের কাছে। কোয়ার্টার ফাইনালের সে ম্যাচে ০-১ গোলে পিছিয়ে থেকে প্রথমার্ধ শেষ করে ক্যামেরুন। দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামেন রজার মিলার। একটি পেনাল্টিও আদায় করে নেন, যা থেকে গোল করে দলকে লিড এনে দেন ইকেকে। যদিও শেষ পর্যন্ত ২-৩ গোলে হেরে রজার মিলারদের বিশ্বকাপযাত্রা সেবারের মতো শেষ হয়। ১৯৯০ বিশ্বকাপে রজার মিলার গোল করেন চারটি। অসাধারণ নৈপুণ্যই তাকে এনে দেয় আইকনের স্বীকৃতি। পরের বিশ্বকাপেই আরেকটি রেকর্ড গড়েন মিলার। ১৯৯৪-এর যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে যখন মাঠে নামেন বয়স হয়ে গেছে তখন ৪২।
×