ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি চুক্তি ও গ্যাংল্যান্ড এল সালভাদর

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শান্তি চুক্তি ও গ্যাংল্যান্ড এল সালভাদর

আজ থেকে ২৫ বছর আগে এল সালভাদরের পুনর্জন্ম হয়েছিল। ১৯৯২-এর ১৬ জানুয়ারি বামপন্থী গেরিলাদের সঙ্গে সরকারের একটা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ১২ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। একটা নতুন সম্ভাবনা নিয়ে সামনের দিকে যাত্রা করে ৬০ লাখ লোকের এই দেশটি। কিন্তু সেই শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের রৌপ্যজয়ন্তী জনগণের মনে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ তাদের চেতনায় প্রাধান্য বিস্তার করে আছে শান্তি নয়, ভীতি। এল সালভাদরে গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি। পার্থক্য হচ্ছে যুদ্ধটা এখন গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে সরকারের নয় বরং বিভিন্ন গ্যাংয়ের সঙ্গে সরকারের। দুই আমেরিকার মধ্যে এল সালভাদরই হলো এখন সবচেয়ে হিংসায় বিক্ষুব্ধ। সেখানে খুনের হার প্রতি এক লাখে ৮০ জন যা যুক্তরাষ্ট্রের হারের ১৫ গুণ। এটাই একমাত্র হতাশার কথা নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গোড়াতে বেশ জোরালো গতিতে শুরু হলে তা এখন ২ শতাংশের মতো জায়গায় নেমে এসেছে যা কিনা মধ্য আমেরিকার গড় হারের অর্ধেকেরও কম। দুর্নীতি লাগামহীন। যুদ্ধোত্তর দুই প্রেসিডেন্ট দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। তার মধ্যে একজন বিচার শুরু হওয়ার আগেই গত জানুয়ারি মাসে মারা গেছেন। সালভাদরবাসীর অনেকেই দেশের ওপর হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের ৪০ শতাংশের বেশি আগামী বছরের মধ্যে দেশ ছাড়তে চায়। সালভাদরের আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী গৃহযুদ্ধে বিবদমান পক্ষগুলোর উত্তরসূরি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ত্রুটিবিচ্যুতি। শান্তি চুক্তি হওয়ার পর থেকে দক্ষিণপন্থী ন্যাশনালিস্ট রিপাবলিকান এলায়েন্স (এরিনা) এবং বামপন্থী ফারাবুন্দো মারতি ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এফএমএলএন) পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সালভাদর সানচেজ সেরেন এফএমএলএন দলীয় এবং একজন সাবেক গেরিলা কমান্ডার। তারা যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা কিভাবে করতে হয় তা শেখেননি। এই দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা এত অস্বাভাবিক মাত্রায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা চলতে পারে না। এফএমএলএ এখনও সমাজতন্ত্রের বুলি কপচায়। তবে বাজার অর্থনীতিও দলটি আপাতত মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে এরিনার বক্তব্য এল সালভাদর হবে বামপন্থীদের সমাধিক্ষেত্র। দু’দলের মধ্যে সংঘাত আছে কিন্তু কারোর কোন ভিশন বা রূপকল্প নেই। তাদের মিল আছে এক জায়গায় এবং সেটা হচ্ছে লুটপাট করে খাওয়া। আর তা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একটা বিশেষ শ্রেণী যেমন গড়ে উঠেছে তেমন আবার কোন প্রতিষ্ঠান এর বিরোধিতা করতে গেলে তার কণ্ঠেরোধ করা হয়। এল সালভাদরের নেতারা শেষ অবধি আজ এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে নতুন এক ধরনের শান্তি চুক্তি প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে একটা সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আনা হয়েছে জাতিসংঘের বিশেষ দূত মেক্সিকোর কূটনীতিক বেনিটো এনডিয়ানকে। সর্বক্ষেত্রে যে জট লেগে গেছে তার কারণে এল সালভাদর আজ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কম। ব্যয় করাও হয়েছে বেশি। এর পরিণতিতে গত বছরের শেষদিকে কেন্দ্রীয় সরকার নগদ টাকার মারাত্মক সঙ্কটে পড়ে। এদিকে সরকারবিরোধীরা আইনসভায় সংখ্যাগুরু হওয়ার সুযোগ নিয়ে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে ঋণ নিতে বাধা দেয়। ফলে সরকার দেউলিয়াত্বের মুখে এসে দাঁড়ায়। শেষে গত নবেম্বরে সরকার ও ডান বিরোধী দল এরিনার মধ্যে সমঝোতার ফলে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়। এল সালভাদর শক্তিশালী ডলারকে তার মুদ্রা হিসেবে ধরে রাখার ফলে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থেকেছে। তবে রফতানি তেমন একটা হতে পারছে না। উদ্যমহীন ও কর্মবিমুখ আমলাতন্ত্র আরেক সমস্যা। ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে যত সময় নেয় এল সালভাদর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানিতে তার চেয়ে কম সময় লাগে না। দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ। তার পরও দেশটা চলছে কিসের ওপর ভরে করে? এর জবাব হলো প্রবাসীদের টাকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২০ লাখ সালভাদরবাসীর বাস। তাদের পাঠানো অর্থ দেশটির অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। তবে অপরাধ বিশেষত গ্যাং অপরাধ দেশের অর্থনীতির জন্য যতটা বাধা অন্য আর কিছুই ততটা নয়। গ্যাং অপরাধের ফলে বিনিয়োগ আসছে না। তরুণ কর্মীরা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতার খরচ জিডিপির ১৬ শতাংশ। গ্যাংগুলো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করে থাকে। এক হিসাবে তা জিডিপির ৩ শতাংশ। সম্প্রতি গ্যাং আক্রমণের হুমকির মুখে কয়েকটি গ্রাম সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে যায়। এফএমএলএন সরকার এসব অপরাধী চক্রের প্রতি তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতোই কঠোর। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে গত দুই বছরে ৯শ’ গ্যাং সদস্য নিহত হয়েছে। অনেকের মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এসব তৎপরতার ফলে খুনের সংখ্যা গত বছর ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৫২৭৮-এ নেমে আসে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×