ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিমানের সব কার্যক্রম পরিচালনায় ৫ সদস্যের টাস্কফোর্স

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিমানের সব কার্যক্রম পরিচালনায় ৫ সদস্যের টাস্কফোর্স

আজাদ সুলায়মান ॥ বিমানের প্রশাসনিক ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এতে আগের মতো আর বিমান পরিচালনা পর্ষদ একচেটিয়া মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে কিংবা অবজ্ঞা করে বড় ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। কারণ, এখন থেকে বিমানের সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করবে মন্ত্রণালয় গঠিত নতুন কমিটি। এই কমিটির নাম দেয়া হয়েছে ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণ টাস্কফোর্স’। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জিয়াউল হককে প্রধান করে এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ৫ সদস্যের টাস্কফোর্সের অপর সদস্যরা হলেন সিনিয়র সহকারী সচিব নিলুফার ইয়াসমীন। এছাড়া বিমানের এক পরিচালক, কাস্টমসের কমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা ও বিমানের পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা এই কমিটির সদস্য হবেন। পদাধিকারবলে মন্ত্রী ও সচিব টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকালে নতুন টাস্কফোর্স গঠনের ফাইলে স্বাক্ষর করেন বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন চিঠি কিংবা নির্দেশনা বিমানে আসেনি। নতুন টাস্কফোর্স সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমান পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী জনকণ্ঠকে বলেছেন- এখনও আমাদের কাছে টাস্কফোর্সের টার্মস অব রেফারেন্স সম্পর্কে কোন চিঠি আসেনি। এটি বিমান বোর্ডের সঙ্গে কোন ধরনের সাংঘর্ষিক হবে কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেটা না দেখে বলা যাবে না। আগে আসুক দেখি তাতে কি আছে। একই বক্তব্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহম্মেদের। বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে গতরাতে বলেন-এই কমিটি আগামী সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করবে। কমিটির অপর তিন সদস্য রবিবার অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। কিভাবে এ কমিটি কাজ করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে বিমানের সব সেক্টরের প্রধান প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করা হবে। তথ্য নেয়া হবে আর্থিক অবস্থার। গত চার দশকে বিমানের খাতওয়ারি লাভ-লোকসানের প্রকৃত চিত্র হাতে নিয়েই সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ফাইল ওয়ার্কিংয়ের পাশাপাশি অপারেশনাল কাজের বিবরণ নেয়া হবে। তারপর মন্ত্রণালয় যেখানে হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন মনে করবে সেখানেই করবে। আসলে বিমানের পরিচালনা পর্যদের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়কে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে এই অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হলো। টাস্কফোর্স সম্পর্কে জানা যায়, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বিমানে কোন অনিয়ম-দুনীতি, অর্থ আত্মসাৎ, অবহেলা ও গাফিলতির কারণে ফ্লাইট টেকনিক্যাল, এয়ারক্রাফটের যন্ত্রপাতি নষ্ট করার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি গঠন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। টাস্কফোর্সের নির্দেশ অমান্য করলে সংশ্লিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিমানের যে কোন ধরনের কেনাকাটা, উড়োজাহাজ লিজ, উড়োজাহাজ ক্রয়, জনবল নিয়োগ, আন্তর্জাতিক স্টেশনগুলোতে কান্ট্রি ম্যানেজার, স্টেশন ম্যানেজার ও হজের সময় হজ কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিমান গঠিত টাস্কফোর্সের অনুমোদন লাগবে। বিমান বোর্ডের সব ধরনের কার্যক্রম বিমান টাস্কফোর্সের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। টাস্কফোর্স ইচ্ছা করলে বিমান ম্যানেজমেন্ট ও বোর্ডের যে কোন সিদ্ধান্ত বাতিল কিংবা সংযোজন-বিয়োজনের জন্য ওই ফাইল পুনরায় ফেরত পাঠাতে পারবে। জনবল নিয়োগের আগে অনুমোদন নেয়া এবং নিয়োগ দেয়ার জন্য চূড়ান্ত অনুমোদনও টাস্কফোর্সের কাছ থেকে নিতে হবে। কার্গো সেকশনের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে তদারকি করবে এই টাস্কফোর্স। এছাড়া বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেয়া যাবে না টাস্কফোর্সের অনুমোদন ছাড়া। টাস্কফোর্সের অনুমোদন ছাড়া কোন কর্মকর্তার চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে গেলে তাকে নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে টাস্কফোর্সের অনুমোদন নিতে হবে। টাস্কফোর্স ইচ্ছা করলে বিমানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাখায় চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট নিয়োগ দিতে পারবে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানের নাট-বোল্ট ঢিলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গঠিত ৩টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে এ ধরনের কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। ওই তিন কমিটির সুপারিশের সারসংক্ষেপ গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদনের পর বিমান মন্ত্রণালয়ে ফেরত আসে। এরপরই এই টাস্কফোর্স গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সম্মতি নেয়ার পরই বৃহস্পতিবার এ টাস্কফোর্স গঠন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের নাট ঢিলার ঘটনায় গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটির সুপারিশের সারসংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল। সেটি গত সপ্তাহে অনুমোদন হয়ে ফেরত এসেছে। এর প্রেক্ষিতে নতুন এই টাস্কফোর্স গঠন করা হলো। এদিকে নতুন কমিটি টাস্কফোর্স নিয়ে কতটুকু কি করবে সে সম্পর্কে সন্দিহান দেখা দিয়েছে। যদিও বিমানকে এসেনশিয়াল সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব দীর্ঘদিন থেকে আলোচনা হচ্ছিল। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না। শ্রমিকদের সিবিএ, বাংলাদেশ পাইলট এ্যাসোসিয়েশনের সিবিএ ও প্রকৌশল শাখার সিবিএ নেতাদের হাতে বিমান জিম্মি হয়ে আছে যুগের পর যুগ। ম্যানেজমেন্ট এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। মন্ত্রণালয়েরও কোন ক্ষমতা নেই। এ সম্পর্কে রাশেদ খান মেনন বলেন, এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। এর জন্য শ্রম দফতরের সঙ্গে সমঝোতা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য কাজ চলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইলেও এটা এত সহজে করা যাবে না। অনেক ফ্যাক্টর এতে জড়িত । এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে বিমানকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করলে বিমানে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে জানতে চাইলে এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও রিজজেন্ট এ্যায়ালাইন্সের সাবেক সিইও (চীফ অপারেশনাল অফিসার) আশিষ রায় চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এতে সংস্থাটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। এখন অনেকেই ওভারটাইম না করেও বিল নিয়ে যাচ্ছে। অফিসে না থেকেও হাজিরা দিয়ে চলেছে। কথায় কথায় ধর্মঘট ডেকে বিমানবন্দর অচল করে দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আসবে। উল্লেখ্য, গত ২৭ নবেম্বর রাষ্ট্রীয় সফরে হাঙ্গেরি যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী এ্যায়ারক্রাফটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। তারপর বিমানের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পর্ষদের কর্মদক্ষতা নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় চলে। এ ঘটনায় তিনটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের সুপারিশ ছিল বিমানকে ঢেলে সাজাতে হলে মন্ত্রণালয়কে ক্ষমতায়ন করতে হবে। ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত প্রায় ১৯টি সুপারিশসহ একটি প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানো হলে তাতে অনুমোদন দেয়া হয়। এর পরই বৃহস্পতিবার গঠন করা হয় বহুল প্রতীক্ষিত টাস্কফোর্স। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান কর্পোরেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্পোরেশন হিসেবে বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীই বিমান পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকতেন। ২০০৭ সালে বিমানকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি করা হয়। এতে একতরফা সব ক্ষমতা ন্যস্ত হয় বিমান পর্ষদের ওপর। এরপর বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ারমার্শাল জামালউদ্দিন আহমেদ বিমান পর্ষদের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি কোম্পানি আইনের প্রতিটি বিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেন। এতে বিমানের কোন কর্মকা-ে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ ছিল না। যে কারণে তৎকালীন বিমানমন্ত্রী জিএম কাদেরও একবার মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পাঠানোর পরও সেটার অনুমোদন দেয়া হয়নি। তারপর থেকে মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা বৃদ্বির বিষয়টি বার বার উঠে আসে। কিন্তু এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিনের দৃঢ়তায় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত এটা সম্ভব হয়েছে বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারীর আমলে।
×