ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী

বর্বরতা রুখে শান্তির বারতায় কবিতার জয়গান

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বর্বরতা রুখে শান্তির বারতায় কবিতার জয়গান

মনোয়ার হোসেন ॥ কবিতাই বলে মানবতার কথা। কবিতার আশ্রয়েই কবিরা লড়ে যান অমানবিকতার বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে মানুষ যখন লোভী ও ভীতু হয়ে ওঠে তখন কাব্যবীজের স্ফুরণে জেগে ওঠে আলোর পথযাত্রীরা। আর এভাবেই সত্য ও সত্তাকে একসঙ্গে প্রকাশ করে কবির সৃষ্ট কবিতা। শব্দের পিঠে শব্দের সংযোজনে উচ্চারিত হয় অন্তর্নিহিত বিষয়। সে শব্দমালায় থাকে দ্রোহ, প্রেম ও সময়ের দিনলিপি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে হাতিয়ার হয়েছে কবিতা। আবার কখনও সময়ের প্রযোজনে কবিতা ছড়িয়ে দেয় শান্তির বারতা। সেই শান্তির বারতা নিয়েই বুধবার শুরু হলো ৩১তম জাতীয় কবিতা উৎসব। ‘কবিতা মানে না বর্বরতা’ স্লোগানে অনুষ্ঠিত উৎসবে সারা দেশের কবিদের সঙ্গে আমন্ত্রিত বিদেশী কবিরা বর্বরতাকে রুখে দিয়ে শপথ নিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার। বিশ্বব্যাপী চলমান নৃশংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো তাদের কণ্ঠ। সৃজনের নিমগ্নতাকে সঙ্গী করে বললেন সভ্য পৃথিবী গড়ার কথা। সেই সঙ্গে শব্দের খেলায় দিনভর চলেছে কবিদের কবিতাপাঠের আসর। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে হালকা শীতের রোদেলা সকালে বসে বর্বরতাকে রুখে দেয়ার প্রত্যয়ে দুই দিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির আহ্বানে জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত উৎসবটি এ বছর পদার্পণ করল ৩১তম আসরে। এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক, কবি রফিক আজাদ ও কবি শহীদ কাদরীর স্মৃতির প্রতি। সারা দেশের কবিদের সঙ্গে একত্রিশতম উৎসবে অংশ নিচ্ছেন সাত দেশের ১৪ কবি। উদ্বোধনী দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ছয়টি অধিবেশন। পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের পাশাপাশি দিনব্যাপী বিভিন্ন পর্বে কবিতা পাঠ করেছেন কবিরা। অংশ নিয়েছেন কবিতার সঙ্গে শান্তি ও মৈত্রীর বন্ধনবিষয়ক আলোচনায়। এছাড়া আয়োজনে ছিল কবিতার গান, অন্য ভাষায় কবিতার কবিতাপাঠ ও খ্যাতিমান বাকশিল্পীদের অংশগ্রহণে আবৃত্তিপর্ব। বহুমাত্রিক আয়োজনে সকাল থেকে রাতঅবধি খ্যাতিমান কবিসহ নানা বয়সী কবিতাপ্রেমীদের বিপুল উপস্থিতিতে সরব ছিল উৎসব প্রাঙ্গণ। প্রথম দিনে নিবন্ধনের মাধ্যমে কবিতা পড়েছেন দেশের নানা প্রান্তের দুই শতাধিক কবি। বিশ্বব্যাপী চলমান বর্বরতার বিরুদ্ধে জোটবাঁধা কবিরা উৎসব প্রাঙ্গণে জড়ো হতে থাকেন সকাল ৮টার পর থেকেই। সকাল সাড়ে নয়টায় পর শুরু হয় উৎসব কার্যক্রম। গ্রন্থাগার চত্বর থেকে বের হয় শোভাযাত্রা। পদব্রজে শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় ভাষাশহীদদের স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে শহীদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অর্পণ করা হয় পুষ্পস্তবক। এরপর শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় চারুকলাসংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিসৌধে। সেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও পটুয়া কামরুল হাসানের সমাধিতে নিবেদন করা হয় পুষ্পাঞ্জলি। শোভাযাত্রা শেষে শুরু হয় উৎসব উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা। শুরুতেই বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে জাতীয় সঙ্গীতের সুর। সেই সুরের তালে তালে উত্তোলিত হয় জাতীয় পতাকা ও কবিতা পরিষদের পতাকা। উত্তোলন করেন পরিষদের সদস্যসহ অতিথি কবিরা। এরপর সারিবেঁধে শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শোনান একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং মুহাম্মদ সামাদ রচিত ও ফকির আলমীরের সুরারোপিত উৎসব সঙ্গীত ‘বর্বরতা মানে না কবিতা/কবিতা মানে না বর্বরতা ...’। গান শেষে বিগত বছরের শুরু থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, অভিনয়সহ নানা অঙ্গনের প্রয়াত কীর্তিমানদের স্মরণে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন কবি আমিনুর রহমান সুলতান। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কবি আসাদ চৌধুরী। আহ্বায়কের বক্তব্য রাখেন রবিউল হুসাইন। বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত। সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ। উৎসব উদ্বোধনের কথা ছিল বরেণ্য কবি বেলাল চোধুরীর। তবে শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি উৎসবে। তার পক্ষে উৎসব উদ্বোধনের লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিষদের সাবেক সভাপতি কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এছাড়া উদ্বোধনী পর্বে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, কবি নাসির আহমেদ, সাযযাদ কাদির, রবীন্দ্র গোপ ও বুলবুল মহলানবীশ। কবিতা উৎসবের তাৎপর্য তুলে ধরে বেলাল চৌধুীর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলা হয়, কবিতা উৎসব এখন বাংলাদেশের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রবহমানতা। এ উৎসবের মাধ্যমে জয় হোক মা-মাটি ও মানুষের, নির্মূল হোক জঙ্গীবাদের, জয় হোক কবিতার, বর্বরতা মানে না কবিতা। কবিতার স্বরূপ তুলে ধরে এই কবির বক্তব্যে বলা হয়, কবিতা হচ্ছে মানুষের অন্তর্গত ও অন্তর্নিহিত মাতৃভাষা। স্বগতোক্তি ও একা একা নিজের সঙ্গে সুসংহত এবং সসুমাঞ্জস্যভাবে কথামালা সৃষ্টিই হচ্ছে কবিতা। কবিতা সর্বদাই সত্যনিষ্ঠ। কবিতায় কোন মিথ্যা, শঠতা বা নীচুতা চলে না। বাঙালী ও বাংলাদেশের কবিতা সমৃদ্ধিশালী, ঐতিহ্যপ্রিয় এবং প্রকৃতি ও জীবনঘনিষ্ঠ। ঘোষণাপত্রে আসাদ চৌধুরী বলেন, মানতেই হবে পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ প্রায় ক্রনিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। পাল্লা দিয়ে মানুষ যেন লোভী আর ভীতু হয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে ক্ষমতা ও শক্তির বেপরোয়া দাপট বর্বরতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মানবতা ও মনুষ্যত্বের শত্রু এই বর্বরতা। এই অপশক্তিকে রুখতে না পারলে পুনরায় বিপন্ন হবে মানবতা। সঙ্কটে কবিতাকে আশ্রয়ের কথা উল্লেখ করে কবি বলেন, সৃজনশীলতার আদিরূপ নিয়ে তর্ক থাকলেও মানতেই হবে কবিতা তার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে। কবিতা সত্য ও সুন্দরের কথাই বলে এসেছিল, স্বপ্ন ও কল্পনার কথাই বলে এসেছিলÑআর তাই সব ধরনের সঙ্কটে কবিতা বাতিঘরের কাজ করেছে। উৎসব আহ্বায়কের বক্তব্যে রবিউল হুসাইন বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকারের কথা জানায় কবিতা। আবার মানুষের বর্বরতার বিরুদ্ধেও দাঁড়ায় কবিতা। গণবিমুখীনতাধর্মী, মানবিকতাবিরোধী দুষ্কর্ম তাদের ইচ্ছাকে পদদলিত করে অত্যাচার-নির্যাতনের পথ বেছে নিতে দেখা যায় তখনই কবিতা স্বতঃস্ফূর্ততায় সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের সমার্থক হয়। কেননা কবিতার ধর্মই এ রকম। সভাপতির বক্তব্যে মুহাম্মদ সামাদ বলেন, সাহিত্যে ও সমাজে আদিমতা, বন্যতা, অসভ্যতা, নীচতা ও ক্ষুদ্রতার নির্দেশক হলো বর্বরতা। পৃথিবীতে সুন্দরের সমূহ সর্বনাশ থামিয়ে দেয়ার মানসে ৩১তম জাতীয় কবিতা উৎসবের স্লোগান ও গানে আমরা ধ্বনিত করেছি আরও একটি নতুন বারতা ‘কবিতা মানে না বর্বরতা বা বর্বরতা মানে না কবিতা’। কবিতার সদা বহমান অমৃতধারায় আত্মা পবিত্র হোক, মরুভূমি উর্বর হোক। ফুলে-ফলে, ধন-ধান্য, সতেজ-সবুজে ভরে উঠুক বসুন্ধরা। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে অনুষ্ঠিত হয় ‘কবিতা মানে না বর্বরতা’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সভাপতিত্বে এতে অংশ নেন আমন্ত্রিত সাত দেশের কবিগণ। তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের আশিস সান্যাল, চিন্ময় গুহ, বীথি চট্টোপাধ্যায়, কাজল চক্রবর্তী, রাতুল দেববর্মণ ও দিলীপ দাস। এছাড়া ছিলেন সুইডেনের ক্রিশ্চিয়ান কার্লসন, রাশিয়ার ড. আলেক্সানড্রোভিচ পোগাদাইভ, অস্ট্রিয়ার মেনফ্রেড কোবো, জার্মানির ইওনা বুরঘার্ট ও টোবিয়াস বুরঘার্ট এবং পুয়ের্তোরিকোর লুস মারিয়া লোপেজ, মারিয়া ডি লোস ও অ্যানজেলেস কামাকো রিভাস। আলোচনার সঙ্গে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠে কবিতাপ্রেমীদের জন্য এ পর্বটি হয় অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সভাপতির বক্তব্যে বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর বলেন, কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলা। এ কারণেই আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে বর্বরতার বিরুদ্ধে। বর্বরতা ও সভ্যতা একসঙ্গে চলতে পারে না। আমরা সভ্যতার সন্তান। সভ্যতার পক্ষে লড়াই চলবে। আমরাই জয়ী হব। দ্বিতীয় পর্বে দিলারা হাফিজের সভাপতিত্বে কবিতাপাঠে অংশ নেন নিবন্ধিত কবিরা। তৃতীয় পর্বে আনোয়ারা সৈয়দ হকের সভাপতিত্বে¡ অংশ নেন বাংলাদেশের অন্য ভাষার কবিরা। চর্তুথ পর্বে শিহাব সরকারের সভাপতিত্বে অংশ নেন আমন্ত্রিত কবিরা। পঞ্চম পর্বে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সভাপতিত্বে অংশ নেন ভারতের আমন্ত্রিত কবিরা। প্রথম দিনের শেষ পর্ব অর্থাৎ আবৃত্তি পর্বে রামেন্দু মজমুদারের সভাপতিত্বে অংশ নেয় আমন্ত্রিত আবৃত্তিশিল্পীরা। এদিনের আয়োজন চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। দুই দিনের উৎসবের শেষদিন আজ বৃহস্পতিবার। এদিন বিকেল সাড়ে ৫টায় উৎসব মঞ্চে ২০১৬ সালের জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার প্রদান করা হবে। জাতীয় কবিতা পরিষদ সম্মাননা প্রদান করা হবে বরেণ্য কবি বেলাল চৌধুরীকে এবং জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার তুলে দেয়া হবে কবি সাযযাদ কাদিরকে। এর আগে বেলা ১১টা থেকে এদিন ৭টি অধিবেশনে থাকবে সেমিনার, কবিতাপাঠ ও ছড়াপাঠ। ‘কবিতার অনুবাদ : মুক্ততা ও মৌলিকতা’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করবেন আহমদ রফিক। এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন মুহম্মদ নূরুল হুদা। এ আলোচনায় অংশ নেবেন শামীম আজাদ, ক্রিশ্চিয়ান কার্লসনসহ দেশ-বিদেশের কবিরা। এদিন সন্ধ্যা ৭টায় কবিতাপাঠের দশম পর্বে সভাপতিত্ব করবেন পাঠকনন্দিত কবি নির্মলেন্দু গুণ। এ পর্বে কবিতা পড়বেন দেশের কবিবৃন্দ। আমন্ত্রিত শিল্পীদের অংশগ্রহণে নাসির উদ্দীন ইউসুফের সভাপতিত্বে রাত ৮টায় কবিতার গান শীর্ষক পর্বের মাধ্যমে শেষ হবে উৎসব।
×