ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুর রহমান স্বপন

পুলিশ কি জনবান্ধব হবে না?

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পুলিশ কি জনবান্ধব হবে না?

দুজন সাংবাদিককে থানার মধ্যে নিয়ে মারপিট করার পরও বলা হলো পুলিশ মারপিট করেনি, ধাক্কাধাক্কি হয়েছে মাত্র। এই যখন অবস্থা তখন পুলিশ তো আস্কারা পাবেই। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করবেই। পুলিশ সপ্তাহ চলার সময় পুলিশের এ হেন ন্যক্কারজনক কাজ শুধু সাংবাদিকদের ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেনি। হতবাক হয়েছে সমগ্র দেশবাসী। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ। পুলিশ অপকর্ম রোধ করার চেয়ে নিজেরাই নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। আর এটি আমার কথা নয়। পুলিশের অপকর্মের কথা তারা নিজেরাই প্রকাশ করেছে। সদ্য সমাপ্ত পুলিশ সপ্তাহের চতুর্থ দিনে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এ কে এম শহীদুল হকের কাছে যে সব অভিযোগ করেছেন তা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। পুলিশের চেন অব কমান্ড যে কতটা দুর্বল বা বিশৃঙ্খল তা পরিষ্কার হয় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিযোগ থেকে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ছিলেন পাবনার পুলিশ সুপার। তিনি তখন পুলিশের কনস্টেবল পদে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোঠায় কাউকে চাকরি দেননি। তখন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা পাবনায় সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন ওই পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সংবাদপত্রে তখন সংবাদও প্রকাশিত হয়। তিনি যুদ্ধাপরাধী মামলার বিচারাধীন আসামি পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য মাওলানা আব্দুস সুবহানের আজ্ঞাবহ ছিলেন। ওই পুলিশ সুপার বর্তমান সরকারের সময় বহাল তবিয়তে পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হয়েছেন। উত্তরাঞ্চলে তার পোস্টিং। উল্লেখ্য, এই পুলিশ অফিসার ২০১৩ সালে যখন রাজশাহীর অতিরিক্ত ডিআইজি ছিলেন তখন রাজশাহীতে পুলিশ খুন হয় স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক শিবির ক্যাডারদের হাতে। একাধিক পুলিশ মারপিটেরও শিকার হন। পুলিশী তৎপরতা নিয়ে তখন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তারপর তাকে বদলি করা হয়। সঙ্কট কেটে গেছে তার। এবারের পুলিশ সপ্তাহে তিনি পদক (বিপিএম) পেয়েছেন! কারণ, তিনি বিশেষ জেলার মানুষ! পুলিশের চেন অব কমান্ড যে কতটা দুর্বল ও ভঙ্গুর এটি তার একটি উদাহরণ। পুলিশের আইজি শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করার সময় পুলিশ সুপাররা নানা অভিযোগ করেন। তারা বলেন, মাদক ব্যবসা নির্মূলে সবচেয়ে বড় বাধা থানা পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তারা টাকার বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। আর এদের বিরুদ্ধে কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা কার্যকর করা হয় না। পুলিশ সুপারদের আদেশ-নির্দেশ মানেন না ওসিরা। কারণ তাদের বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি করে থাকে ডিআইজি। অবস্থাটা এমন যে থানার কিছু কিছু ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এতটাই ক্ষমতাধর যে তাদের সমীহ করে চাকরি করতে হয় পুলিশ সুপারদের! অতিসম্প্রতি পাবনা সদর থানায় থাকাকালীন এক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহরের শালগাড়িয়া মহল্লায় একটি বিয়ে করেন (প্রথম স্ত্রীর অগোচরে বা বিনা অনুমতিতে)। প্রথম স্ত্রী পাবনায় থাকতেন না। তিনি বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর পাবনায় আসেন এবং ওসির বাসভবনে অপর নারীকে দেখে ক্ষুব্ধ হন। থানার মধ্যেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন ওই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এই ঘটনার পর ওসিকে বদলি করা হয় জয়পুরহাট জেলায়। তার অপকর্ম সম্পর্কে তদন্ত হয়। এক সময় তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়। ডিআইজির কৃপায় এই দুষ্কর্মকারী পুলিশ অফিসার রক্ষা পান। তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের কাছে আরও অভিযোগ করা হয় : পুলিশের ওসিরা সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের ছত্রছায়ায় থাকেন। কারও অপকর্মের জন্য সাজা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও তা কার্যকর করা যায় না। রাজনৈতিক চাপকে পাশ কাটিয়ে কাউকে সাজা দেয়া হলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা আবার তাদের রাজনৈতিক নেতাদের ধরে পুনর্বহাল হয়। এরপর তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এসব কারণে এসপিদের নির্দেশকে পাত্তা দেয় না অনেক থানার ওসি। পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭-এর এই সভায় যেসব পুলিশ সুপার বক্তব্য রাখেন তারা হলেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূর আলম মিয়া, কুমিল্লার আমির হোসেন, চাঁদপুরের শামসুন্নাহার বেগম, নরসিংদীর আমেনা বেগম, খাগড়াছড়ির আব্দুল মজিদ। ডিএমপির কয়েক কর্মকর্তা ছাড়াও সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান এবং পিবিআইর ডিআইজি মনোজ কুমার বক্তব্য রাখেন। বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, মাদক ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ। বক্তব্য প্রদানকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রায় সকলেরই একই রকম অভিযোগÑ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের একটি অংশ নিজ নিজ এলাকায় মাদক বিস্তারের মাধ্যমে যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজের এবং এলাকার উন্নয়নের কথা না ভেবে তারা অবৈধ অর্থের ভাগ-বাটোয়ারায় বেশি মনোযোগী। এরা পুলিশকে উল্টো চাপের মুখে রাখে মাদকের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য। মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদারদের সঙ্গে কোন না কোন রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের যোগাযোগ রয়েছে। আর তাদের সহায়তা করে থানার কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা। যথেষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই ওই সব পুলিশ অফিসার বা সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা আইনকে ভ্রƒকুটি দেখিয়ে আবার পুনর্বহাল হয়েছে। উক্ত বৈঠকে এমনও মন্তব্য করা হয় ‘শাস্তি পাওয়া পুলিশ সদস্য পুনর্বহাল হয়ে আরও দাপটে অপকর্ম করে থাকে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর চাল-গম-টাকা, টেন্ডারসহ নানা অর্থ যোগের যাবতীয় সেক্টরে রাজনীতিবিদদের অপকর্ম সর্বজনবিদিত। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে প্রভাবশালী নেতারা এসব অপকর্মে লিপ্ত থাকেন। তারা তাদের অনুসারীদের টেন্ডারের অর্থ কিংবা চাল-গম-নগদ টাকার ভাগ দেয়ার পরিবর্তে এলাকায় মাদকদ্রব্যের ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের মদদ দেন। এদের বেশিরভাগই যুবক। যুবকরা নগদ টাকার লোভে মাদক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। ওই বৈঠকে একাধিক পুলিশ সুপার তাদের বক্তব্যে আরও বলেন, অনেক ওসি মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে পোস্টিং নিয়ে থাকেন। ফলে উক্ত ‘বিনিয়োগ’ সুদাসলে ঘরে তুলতে মরিয়া হয়ে ওঠে ওসিরা। তাদের টার্গেট থাকে শুধু টাকার দিকে। আর একসঙ্গে অনেক টাকা উপার্জনের জন্যই মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করে থাকে তারা। ওসিদের বিরুদ্ধে যখন এসব অপকর্মের তদন্ত হয় এবং শাস্তি হয়, তখন তারা রাজনৈতিক তদ্বির শুরু করে। পুলিশ সুপাররা ওই সভায় ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে যুব সমাজকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত করা যাবে না। এসব কথা বলে প্রতিকার হিসেবে পুলিশ সুপারগণ সুপারিশ করেছেন জঙ্গী এবং মাদকের বিস্তার রোধে শৃঙ্খলা রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ। এর জন্য তারা ওসিদের ‘পোস্টিং’ ও ‘বদলি বাণিজ্য’ বন্ধ করার জন্য পুলিশ প্রধানকে অনুরোধ করেছেন। এসব কথা তখনই ওঠে যখন পুলিশ প্রধান জঙ্গী এবং মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলেন। পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক, পুলিশ সুপারদের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শোনার পর কোন সদুত্তোর বা প্রতিকারের জন্য কোন ব্যবস্থাপত্র দিতে পেরেছেন কি-না তা জানা যায়নি। এবারের পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘জঙ্গী মাদকের প্রতিকার, বাংলাদেশ পুলিশের অঙ্গীকার।’ আইজি শহীদুল হক বলেছেন, ‘শুধু মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ধরলেই চলবে না, মাদকের পেছনের গডফাদারকে খুঁজে বের করতে হবে।’ মাদকদ্রব্য নানা অসামাজিক বা অপরাধমূলক কাজের ইন্ধন যোগায়। মাদকদ্রব্য যারা গ্রহণ করে তাদের কথাবার্তা তো অসংলগ্ন হয়ই। পাবনায় সদ্য যোগদানকারী পুলিশ সুপার ঈশ্বরদীতে এক সমাবেশে বলেছেন, ‘ঈশ্বরদীতে মাদকদ্রব্য থাকলে পুলিশ থাকার দরকার নেই।’ তার কথাটি খুবই শক্ত। না ঈশ্বরদী পুরোপুরি মাদকমুক্ত হয়নি। উল্লেখ্য, উত্তরাঞ্চলের বড় মাদক বাণিজ্য কেন্দ্র ঈশ্বরদী। দু’মাস আগে পাবনা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এমপি ও পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স বলেছেন, পাবনার প্রথম সমস্যা মাদকদ্রব্য। ওসিদের আগে নিয়ন্ত্রণ করতেন পুলিশ সুপাররা। এখন নাকি সেটি করেন, ডিআইজি, এডিশনাল আইজি এবং আইজি। এ ছাড়াও আছে রাজনৈতিক তদ্বিরে পোস্টিং। অর্থাৎ পুলিশে নেই চেন অব কমান্ড। এটি পুলিশ সুপারদের দেয়া বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই সুস্পষ্ট হয়। কথায় বলে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত। আমার স্কুলের প-িত মহাশয় যদু গোপাল গোস্বামী বলতেন, মনিবের চেয়ে চাকর যখন ক্ষমতাবান হয় তখন আর সে গ্রামে বাস করা যায় না। ঘিয়ের চেয়ে যদি তেলের দাম বেশি হয় তা হলে তো সে দেশে বসবাস করা যায় না। ন্যায়বিচার পাওয়া সে দেশে দুরাশা। কবিগুরু রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুরের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি বহু বছর আগে লিখেছেন, ‘কুমির যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতল স্পর্শ থানার মধ্যে অন্তর্হিত হওয়াই পুলিশ কর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম।’ এটিএন নিউজের হতভাগ্য সাংবাদিক ঈশান দিদার এবং ক্যামেরাপার্সন আবদুল আলিমকে শাহবাগ থানার মধ্যে এরশাদ নামের পুলিশ অফিসার ও তার সহযোগী সদস্যরা যেভাবে পেটাল তার ছবি সংবাদ মাধ্যমে দেখে খাঁজকাটা কুমিরের কথাটিই মনে পড়ে গেল এবং গা শিউরে উঠল! ঘৃণা জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু জানতে ইচ্ছা হয়, এ দেশের পুলিশ কি জনবান্ধব হবে না কখনই? লেখক : সাংবাদিক
×