ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

ট্রাম্পের উত্থান এবং মুদ্রার উল্টোপিঠ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৭

ট্রাম্পের উত্থান এবং মুদ্রার উল্টোপিঠ

বিশ্বের পুরো মিডিয়া এখন ট্রাম্পময় এবং জীবনও যেন ট্রাম্পড! আপাত যদিও মনে হচ্ছে, কেউ তাকে পছন্দ করছে না; কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তিনি তার মতো কাজে নেমে গিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই তিনি তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। তার সেই কাজগুলো ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে সাড়া ফেলতে শুরু করেছে। আমেরিকার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক আছে, তাদের সবকিছু নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে যে সংবাদটির উপর থেকে চোখ সরাতে পারছি না তার শিরোনাম হলোÑ ‘ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বিমানবন্দরে অবরুদ্ধ গ্রীনকার্ড-ভিসাধারীরাও।’ সংবাদটিতে লেখা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়াসহ মুসলিমপ্রধান সাত দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নির্বাহী আদেশ জারি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেশটির বিভিন্ন বিমানবন্দরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন ওইসব দেশের অসংখ্য গ্রীনকার্ড ও মার্কিন ভিসাধারী মানুষ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত’ সিরিয়ান শরণার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। এছাড়া যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরান, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়া, সোমালিয়া ও সুদানÑ এই ৬টি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাওয়া লোকদের ভিসা দেয়া আগামী তিন মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এক নির্বাহী আদেশে তিনি এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। আদেশের কয়েক ঘণ্টা না পেরুতেই এসব নিষিদ্ধ দেশের অসংখ্য গ্রীনকার্ড ও মার্কিন ভিসাধারী মানুষ বিমানবন্দরে আটকা পড়েছেন। (সূত্র : প্রিয়.কম, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭)। অনেক রাজনীতিবিদ, শরণার্থী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। আরব-আমেরিকান বৈষম্যবিরোধী কমিটি এক বিবৃতিতে বলে, এর অর্থ হলো নিষিদ্ধ দেশগুলো থেকে আসা ব্যক্তিরা, যারা ইতোমধ্যে বিমানবন্দরে অবতরণ করেছেন তাদেরও ফিরে যেতে হবে। মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, এতে আমেরিকান মূল্যবোধের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। সিনেটর কমলা হ্যারিস বলেছেন, ‘এই আদেশ আসলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা।’ অন্যদিকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে বাংলাদেশীদের যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশী এবং মার্কিন আইনজীবীরা। সেমিনারে তারা বলেছেন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বাস্তবতায় যেসব বাংলাদেশী নিবন্ধনের ভয়ে চলে গিয়েছিলেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। নানা চেষ্টা করেও তারা আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারেননি। তাই এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আতঙ্কিত না হয়ে আইনী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান তারা। ॥ দুই ॥ অবস্থা দ্রুত বদলে যেতে শুরু করেছে। ট্রাম্পের এই নির্বাহী আদেশ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজে নেমে পড়েছে বিমানবন্দরগুলো। তারা সন্দেহভাজন যাত্রীদের আমেরিকাতে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না, এবং কয়েকজনকে ইতোমধ্যেই দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ এটা নিয়ে মামলাও করেছেন। যদি এই আদেশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে হাজার হাজার মুসলমান এই মুহূর্তে আর আমেরিকাতে প্রবেশ করতে পারবেন না; তারা বর্তমানে আমেরিকার বাইরে রয়েছেন। এই নতুন আদেশের ফলে আমেরিকার গ্রীনকার্ডধারীরাও বিপদে পড়তে পারেন। যাদের গ্রীনকার্ড রয়েছে, তাদের সেই দেশের সরকার দীর্ঘ মেয়াদে থাকতে, এবং কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু তাদের এখনও নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। ফলে তারা আমেরিকান নন। যেই ৭টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের গ্রীনকার্ড দেয়া হয়েছিল, এবং বর্তমানে যারা আমেরিকার বাইরে রয়েছেন, তারাও ঠিকমতো আমেরিকাতে ফিরতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, ওই সাতটি দেশের প্রায় ৫ লাখ মানুষকে গত এক দশকে গ্রীনকার্ড দেয়া হয়েছে। এখন খুঁজে খুঁজে তাদের যদি ধরা হয়, তাহলে আমেরিকাতে তো বটেই, পুরো বিশ্বে একটা বিশাল হৈ চৈ শুরু হয়ে যাবে। গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই ইতোমধ্যে এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করছেন, গুগলের অনেক কর্মী যারা আমেরিকার বাইরে ভ্রমণে আছেন, তারা ঠিকমতো আমেরিকাতে ফিরতে পারবেন না। তিনি তার কর্মীদের উদ্দেশ করে লেখা একটি বার্তায় বলেন, এর ফলে হয়ত অনেক ভাল কর্মীকে আমেরিকাতে আনা সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রথম দায়িত্ব হলো যারা ঝামেলায় পড়েছেন তাদের আগে সাহায্য করা। যারা বিদেশের মাটিতে ঝামেলায় পড়েছেন তাদের গুগলের নিরাপত্তাবিষয়ক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি। গুগল তাদের আমেরিকার বাইরে থাকা কর্মীদের যথাশীঘ্রই আমেরিকাতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ওয়ালস্ট্রিটে এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বর্তমান গুগলের ১৮৭ কর্মী (যারা আমেরিকাতে কর্মরত) তারা এই ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছেন। তাদের আমেরিকা থেকে নিজ দেশে চলে যেতে বাধ্য করা হতে পারে। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গেরও একটি স্ট্যাটাস ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে তিনি তার পূর্বপুরুষের কথা বলেছেন। তিনি তার ব্যক্তিগত স্ট্যাটাসে লিখেন, আমার বাপ-দাদারা এসেছিলেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং পোল্যান্ড থেকে। আর প্রিসিলার মা-বাবারা ছিলেন চীন এবং ভিয়েতনাম থেকে আসা শরণার্থী। যুক্তরাষ্ট্র হলো ইমিগ্র্যান্টদের মাটি এবং আমরা এর জন্য গর্বিত। অনেকের মতো আমিও ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশটি নিয়ে বিচলিত। তিনি আরও লিখেন, আমাদের এই দেশ নিরাপদ রাখতে হবে। তবে যারা নিরাপত্তার জন্য হুমকি তাদের উপর ফোকাস করে কাজটি করতে হবে। যারা নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, তাদের যদি এর আওতায় আনা হয়, তাহলে আমেরিকা আরও কম নিরাপদ হয়ে উঠবে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ যারা বর্তমানে অবৈধভাবে আমেরিকাতে আছে; কিন্তু নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়Ñ তারা প্রতিনিয়ত দেশত্যাগের ভয়ে দিনযাপন করবে। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন একটু পরপর সংবাদ আসছে যে, বিভিন্ন এয়ারলাইন্স তাদের যাত্রীদের স্ট্যাটাস পরীক্ষা করছে এবং আমেরিকাতে যেতে পারবে না এমনটা মনে করে তাদের উড়োজাহাজে উঠতে দেয়া হচ্ছে না। আবার এদিকে প্রতিবাদ করে ইরান পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে, তারা কোন আমেরিকানকে ইরানে প্রবেশ করতে দেবে না। এটাই নতুন পৃথিবী, নতুন বাস্তবতা! ॥ তিন ॥ আমরা সবাই যখন ট্রাম্পের সমালোচনা করছি, তখন কেউ কেউ হয়ত মুদ্রার অপর পিঠটি দেখতে পাননি। ধরে নিচ্ছি ট্রাম্পের সবকিছুই খারাপ। তিনি মানুষটা খারাপ, তার নীতি খারাপ, তার ব্যবহার খারাপ, তার কথা বলার ঢং খারাপ, মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খারাপÑ সবকিছু খারাপ। কিন্তু এই খারাপ মানুষটি একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হলেন কিভাবে? এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, ট্রাম্পের মতো একজন মানুষকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলো? ট্রাম্পের অনেক ইস্যুর ভেতর বড় একটি ইস্যু হলো মুসলমান। তিনি বলেছেন, যারা আমেরিকার ভাল চায় না, তাদের আমেরিকায় চাই না। সেই কথার ফাঁকে মূলত জড়িয়ে আছে এই বিশ্বের তাবদ মুসলমান। তিনি যে ৭টি দেশের নাগরিকদের আমেরিকাতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন, তার লেজ ধরে হয়ত আরও অনেক দেশই চলে আসবে। এই ৭টি দেশের মানুষ যখন আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করা হবে, তখন হয়ত আরও অনেক মুসলমানকে বহিষ্কার করা হবে। সেই আতঙ্ক যে বাংলাদেশী প্রবাসীদের ওপর নেই, তা বলা যাবে না। তাই হয়ত স্থানীয় আইনজীবীরা সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়ে মাঠে নেমেছেন। এটা তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, মুসলমানদের সঙ্গে অন্য ধর্মের একটা টানাপোড়েন বাড়ছেই। তার একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হয় সন্ত্রাসবাদ। সেটা বাংলাদেশে যেমন আমরা দেখছি পৃথিবীর নানান দেশে দেখছি এবং আমেরিকার ভেতরও দেখছি। এবং যে সন্ত্রাস বিস্তৃত হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগের অবস্থানটি নীতিনির্ভর নয়, সুবিধানির্ভর। তারা যদি নীতির উপর নির্ভর করে প্রতিবাদ করতেন, তাহলে যখন আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে ইসলামিক উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন অন্যদের সঙ্গে তাদেরও রাস্তায় নামা দরকার ছিল। তাদের সক্রিয় হওয়াটা জরুরী ছিল। সেটা যেহেতু হয়নি, এখন সবাইকে নতুন এই মেরুকরণ দেখতে হবে। মূলত মুসলমানরাই ট্রাম্পকে তৈরি করেছে, ট্রাম্পকে শক্তিশালী করেছে। ॥ চার ॥ আমরা সবাই ট্রাম্পকে সমালোচনা করি, আমেরিকার সমালোচনা করি, আবার আমেরিকা যেতে চাই। এটাও তো সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। ফেসবুকে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ার পর বন্ধু শোয়েব রিয়াজ আলম এর একটি জবাব দিয়েছেন, ‘আমরা কথায় কথায় আমেরিকার বদনাম করি, মুসলিমদের করা সব অপকর্মের পেছনে আমেরিকা আছে বলে ক্রমাগত অভিযোগ করি, কিন্তু আমেরিকার উন্নত জীবনযাত্রার লোভ আমরা সংবরণ করতে পারি না। আমেরিকায় আমাদের যেতেই হবে, বৈধ বা অবৈধ যেভাবে পারি থাকতেই হবে। আর অভিযোগ তো চলবেই। তোমরা যারা আমেরিকাকে পছন্দ কর না, তারা নাইবা থাকলে আমেরিকায় বা নাইবা গেলে আমেরিকায়!’ গুগলের সুন্দর পিচাই যখন তার কর্মীদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, তখন মুদ্রার অপর পিঠে কেউ কেউ বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তাদের ভাবনা, এর ফলে গুগল, ফেসবুক, উবার, সিসকো, ইন্টেল, এ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমেরিকার বাইরে থেকে বেশি বেশি ট্যালেন্ট আমেরিকাতে নিয়ে যেতে পারবে না। এখন তো আমেরিকা বিভিন্ন রকমের লোভ দেখিয়ে এই ট্যালেন্টদের নিজ দেশে নিয়ে যায়। সেটা করতে না পারলে তখন ওই ট্যালেন্টরা সেই দেশেই থাকার চেষ্টা করবে, নিজ দেশে কন্ট্রিবিউট করার চেষ্টা করবে, সেই দেশের লাভ হবে। পাশাপাশি গুগল, ফেসবুক, এ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিজস্ব অফিস খুলবে, এবং আরও বেশি বিনিয়োগ করবে। তখন সেই অফিসগুলোয় স্থানীয়ভাবে নিয়োগ হবে। শুধু একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশে মাইক্রোসফট, গুগল, আইবিএম, সিসকো, ওরাকল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান কত বছর ধরে অপারেট করছে। কেউ কি এখানে কোন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার খুলেছে? স্যামসাং খুলেছিল, সেটাও এখন গুটিয়ে নিচ্ছে। ট্রাম্পের এই নতুন নীতির ফলে বাংলাদেশও লাভবান হতে পারে। এই গ্রহটি তো শুধু ট্যালেন্টদের জন্য নয়, ট্রাম্পদের জন্যও! ২৮ জানুয়ারি ২০১৭ [email protected]
×