ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতি সমৃদ্ধ অতীত বহুমাত্রিক উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতি সমৃদ্ধ অতীত বহুমাত্রিক উপস্থাপনা

------------------- মোরসালিন মিজান, সোনারগাঁ থেকে ফিরে ---------------------- বহুকালের পুরনো জনপদ নয় শুধু, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী সোনারগাঁ। প্রাচীন বাংলার রাজধানী হয়ে ছিল প্রায় তিন শ’ বছর। আগের মতো কিছু আর নেই। তবে সোনারগাঁ সোনালি অতীতের কথা মনে করিয়ে দেয়। এলাকাটিতে প্রবেশ করতেই অদ্ভুত এক ভাললাগা কাজ করে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নগরে এখন চলছে গ্রামীণ ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টা। সে লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। হরেক রকম কর্মকা-ের অন্যতম একটি লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব। প্রতিবছর আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের উৎসব। যথারীতি জানুয়ারির প্রথম দিন শুরু হয়েছিল। আর যখন শেষ হতে চলেছে তখন ঘুরে দেখার সুযোগ হলো আয়োজনটি। শনিবার মেলায় গিয়ে দেখা গেল, বিশাল পরিসর। বহুবিধ আয়োজন। গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গ দিয়ে স্টল সাজানো হয়েছে। মোট স্টল ১৯৩টি। ২৭টি স্টলে কারুপণ্যের পসরা। হস্তশিল্পের নিদর্শন রয়েছে ৪৬টিতে। মেলায় যোগ দিয়েছেন পল্লী অঞ্চল থেকে আসা ৫৪ জন কারুশিল্পী। মেলার বড় অংশজুড়ে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের প্রদর্শনী। বংশ পরম্পরায় যারা শিল্পটির সঙ্গে যুক্ত, তাদের খুঁজে আনা হয়েছে। সংখ্যায় ৮ জন। মেঝেতেই বসেছেন তারা। গ্রামের মেলায় সেই কবে কোনকালে দেখা মাটির পুতুল আবারও দেখার সুযোগ হয় এখানে। কিশোরগঞ্জের সুনীল চন্দ্র পালের কাজগুলো দেখতে সাধারণ। তবু খুব আকর্ষণ করে। কারণ আর কিছু নয়, এগুলো ট্রাডিশনাল। গ্রামীণ জীবন ও তৃণমূলের সংস্কৃতি মাথায় রেখে গড়া। গ্রামীণ মানুষের কর্মমুখর জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। কৃষি কর্মের বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হওয়া নারীদের উপস্থাপন করেছেন। সাধারণ কৃষক বা মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেকে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ইতিহাসের পাতা থেকে ওঠে আসেন পোড়ামাটির ঈশা খাঁ। বিভিন্ন লোককাহিনীর চরিত্রও বাদ যায় না। দুই মাথা বিশিষ্ট ঘোড়া হতে পারে এর ভাল উদাহরণ। রাজশাহীর সুশান্ত কুমার পাল বা সঞ্জয় কুমার পালদের কথা নাগরিক সমাজ মোটামুটি জানেন। বাপ বেটা মিলে শখের হাঁড়ির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। একই কাজে যোগ দিয়েছেন পরিবারের আরেক সদস্য মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল। তার স্টলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনিই চোখ চলে যায়। উজ্জ্বল রঙে আটকে যায় চোখ। আঁকুবুকির কাজ শেষে শিকেয় সাজিয়ে রখা হয়েছে শখের হাঁড়ি। নিচে বসে ঐতিহ্যবাহী মাটির পাত্রে প্রাকৃতিক রঙে ছবি আঁকছেন তরুণ শিল্পী। কাঁচা হলুদ রঙের মৃৎপাত্রে লাল রঙের তুলির আঁচড়। সূক্ষ্ম এবং নির্ভুল আঁচড় পাশে দাঁড়িয়ে দেখা আনন্দের বৈকি! নারায়ণগঞ্জের রামচন্দ্র আঁকছিলেন সরাচিত্র। একটিতে তিনি এঁকেছেন কাবা শরীফের ছবি। অন্যটিতে আবার মা লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি। দুটোই ভীষণ আন্তরিকতা দিয়ে করা। লোক সংস্কৃতির মূল শক্তি যে অসাম্প্রদায়িকতা, সরাচিত্র যেন সে কথা আবার মনে করিয়ে দেয়। কেউ কেউ দর্শনার্থীদের চোখের সামনেই নরম মাটিকে গড়ে নিচ্ছেন। একটি মাত্র চাকা। সেটি ঘুরছে। মাঝখানে মাটির দলা। সতর্ক আঙ্গুলে সামান্য ছুঁয়ে দিতেই সুন্দর আকার ও আকৃতি পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে তৈরি হচ্ছে মৃৎপাত্র। আজকের প্রজন্ম দেখে তো অবাক। কৌতূহল নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখছিলেন বড়রাও। এসবের বাইরে মেলার আয়োজকরা মৃৎশিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন’ শিরোনামে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। জাদুঘরের কিছু নিদর্শন রাখা হয়েছে বিশাল স্টলে। এগুলো প্রকৃতই গ্রামকে রিপ্রেজেন্ট করে। পাশাপাশি রাখা হয়েছে বর্তমান সময়ের শিল্পীদের কিছু কাজ। এর মধ্য দিয়ে পুরনো প্রকৃত চর্চার সঙ্গে আধুনিক সময়ের এক্সপেরিমেন্টগুলোর মেলবন্ধন দেখানো হয়েছে বলে জানান আয়োজকরা। মেলায় সিলেটের শীতলপাটি নিয়ে এসেছেন গীতেশ চন্দ্র দাশ। নিজের স্টলে বসেই সূক্ষ্ম এই কাজটি করছিলেন তিনি। জানালেন, হবিগঞ্জের রাজনগর থানার একটি গ্রামে সারা বছরই কাজ করেন। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন মেলায় অংশ গ্রহণ করেন। গীতেশের শীতলপাটিতে হাত দিয়ে অবাক হতে হয়। আশ্চর্য নরম। লোকজ নকশা আঁকা পাটির দাম অনেক। এমনকি অর্ধলক্ষ টাকার শীতলপাটি আছে। সে তুলনায় ক্রেতা কম। মাঝবয়সী গীতেশ জানালেন, পোষায় না। তবু ভালবাসার টানে কাজ করে যাচ্ছেন। একই কথা বললেন, শঙ্কর মালাকার। তিনি শোলা শিল্প সামগ্রী দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন। চমৎকার কাজ। শোলার পাখি কুমির ইত্যাদির দিকে বিস্ময় নিয়েই তাকাতে হয়। মেলায় আছে রংপুরের ঐতিহ্য শতরঞ্জির শিল্পী। একাধিক স্টল। একটিতে কাজ করছিলেন শিল্পী। জানালেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে শিখেছেন। শাশুড়ি শিখিয়েছেন। তিনি নেই। এখন ঐতিহ্যটি ধরে রেখেছেন তার বউ। আরও আছে চট্টগ্রামের তালপাতার হাতপাখা, সোনারগাঁয়ের হাতি ঘোড়া পুতুল ও কাঠের কারুশিল্প, নকশিকাঁথা, বেত ও বাঁশের কারুশিল্প। মুন্সীগঞ্জের শীতল পাটি, কুমিল্লার তামা-কাঁসা পিতলের কারুশিল্প, কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা আছে। প্রদর্শিত হচ্ছে রাঙামাটির ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য। এমনকি বাদ যায়নি ঠাকুঁরগায়ের বাঁশ ও শিকার কারুশিল্প। মাসব্যাপী আয়োজনের প্রতিদিনই থাকছে বাউলগান, পালাগান, কবিগান, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালী গান, জারিগান, সারিগান, হাছন রাজার গান, লালন সংগীত, মাইজভা-ারী গান, মুর্শিদী গান। আলকাপ গান, গাঁয়ে হলুদের গানও শোনাচ্ছেন লোক শিল্পীরা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিল্পীদের পরিবেশনা থাকছে। শরিয়তী-মারফতিগান, ছড়া পাঠের আসর, পুঁথি পাঠ মুগ্ধ হয়ে শুনছেন শ্রোতা। লাঠি খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, লোকজীবন প্রদর্শনী, লোকজ গল্প বলা, পিঠা প্রদর্শনী আরও কত কী! প্রদর্শনীর পাশাপাশি শনিবার বাংলাদেশের চারজন কারুশিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। শীতলপাটি শিল্পের জন্য সবিতা মোদী, তামা কাঁসা ও পিতল শিল্পের জন্য মানিক সরকার, সরাচিত্রে সদন্য চন্দ্র দাস ও পাটের শিকা শিল্পের জন্য সুফিয়া আক্তার এই সম্মাননা লাভ করেন। চারজন কারুশিল্পীকে এক ভরি ওজনের একটি গোল্ড মেডেল ও ৩০ হাজার চেক প্রদান করা হয়। এদিন মেলা ঘুরে দেখেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান। স্থপতি রবিউল হাসান, শিল্প সমালোচক মইনুদ্দীন খালেদকে সঙ্গে নিয়ে মেলা ঘুরে দেখেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন ফাউন্ডেশনের পরিচালক রবীন্দ্র গোপও। এ সময় হাশেম খান জনকণ্ঠকে বলেন, মেলায় লোকজ সংস্কৃতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে। দেখে ভাল লাগল। তৃণমূলের শিল্পীদের নিজস্ব ঢংয়ের কাজকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। তারা যেভাবে কাজ করে আসছেন, সেভাবে করতে দিতে হবে। ফাউন্ডেশনের মৃৎশিল্প প্রদর্শনীরও প্রশংসা করেন তিনি। তবে গ্রামীণ শিল্পীদের ট্রাডিশনাল শিল্পকর্ম প্রদর্শন করার মেলায় বর্তমান সময়ের আধুনিক শিল্পীদের কাজ ঢুকিয়ে দেয়ার কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, দুটো দুই জিনিস। একসঙ্গে উপস্থাপন করলে মূল ধারাটি সম্পর্কে মানুষ ভুল বার্তা পেতে পারে। একই প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশনের পরিচালক রবীন্দ্র গোপ বলেন, আমরা আমাদের সমৃদ্ধ অতীত নিয়ে কাজ করছি। আমাদের এই চর্চা আগামী দিনের জন্য। অনেক বড় মেলা আয়োজনে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে মেলাটি আরও সুন্দর এবং ত্রুটিমুক্ত করার চেষ্টা করা হবে।
×