ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা ॥ কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা ॥ কিছু কথা

আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের তদানীন্তন অন্যতম কর্ণধার হেনরি কিসিঞ্জার স্বাধীন বাংলাদেশকে কি হেয় চোখেই যে দেখতেন তা সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ গ্রন্থের পাতায় পাতায় বিধৃত রয়েছে। শুধু তাই নয়, সিআইএর এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের যে সকল গোপন দলিল এখন সময়ের রজ্জু ছিন্ন করে প্রকাশ হচ্ছে তাতেও নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের বাংলাদেশ বিদ্বেষ আর পাকিস্তানী হানাদারদের প্রতি তাদের যারপরনাই প্রীতির বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়। তাদের এই বিদ্বেষ প্রধানত ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু ভারতের প্রতি। ভারত তখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের এক কোটি উদ্বাস্তুর ভার বইতে হিমশিম খাচ্ছে, পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বিপরীতে পাকিস্তানে একটি ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ভূমিকা পালনের ব্যাপারে আবেদন-নিবেদন জানাচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তখন ‘পিংপং ডিপ্লোমেসির’ ছদ্মাবরণে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সর্বতো সহযোগিতার প্রত্যাশী হয়ে কূটচাল চেলেই যাচ্ছে। তখন চীন-মার্কিন সম্পর্ক স্থাপনের এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রশাসনের দিক থেকে ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি এই তোষণ নীতি পরিচালিত ও কার্যকর করা হচ্ছিল। ফলে ভারতের মিসেস গান্ধী ও তার সরকারের আহ্বানে সাড়া দেয়ার পরিবর্তে ভারতের প্রতি তথা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি চরম বৈরিতামূলক অবস্থান গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি চীনের মনোভাবও তখন দারুণ বৈরিতাপূর্ণ। চীন-ভারত সম্পর্কের দীর্ঘকালীন টানাপোড়েন এমনিতেই ঐ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে দিয়েছিল, এর ওপর আবার একাত্তরে চীনের অন্যতম মিত্র পাকিস্তানের সংহতি যখন পাকিস্তানী কুচক্রী শাসকরা নিজেরাই বিপন্ন করে তুলল তখনও চীন পাকিস্তানের ঐ গণহত্যাকারী শাসকদেরই পক্ষাবলম্বন করল বৈকি! মোদ্দাকথা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তথা সর্বাপেক্ষা দুঃসময়ে আমরা সেদিন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে (তদানীন্তন) পাশে পেয়েছিলাম নিশ্চিন্ত নির্ভরতা হিসেবে। তাছাড়া আরও অনেক দেশ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তবে ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা সবকিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল। আমরা যারা সেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী তারা এই দুই দেশের তদানীন্তন নেতৃত্ব ও গণমানুষদের সাহায্য-সহযোগিতা-সহানুভূতি-সমর্থনের কথা কোনদিনই ভুলতে পারব না। শুধু আমরা কেন, যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের জাতক কিংবা বর্তমান বা ভবিষ্যত সময়ের জাতক হবে তারাও জাতিগতভাবে এই দুই দেশের কাছ থেকে প্রাপ্ত সে সহযোগিতা ও সাহায্যের কথা কোনদিনই ভুলতে পারবে না। বিপন্ন, অসহায়, নারকীয় পৈশাচিকতার শিকার বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ঐ দেশ দুটির জনগণের ও তাদের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছা-ভালবাসা-সমর্থন-সহযোগিতায় সিক্ত হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ সেদিন। একাত্তর পর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা আমাদের জন্য কি ভয়াবহ ন্যক্কারজনক ছিল তা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। আবার একইভাবে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা আমাদের জন্য কি অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছিল তাও আজ ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। মার্কিন প্রশাসনের অন্যতম কর্ণধার হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বাংলাদেশ বিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে তার সেই জঘন্য উক্তিতে- ‘বাংলাদেশ হচ্ছে একটি তলাবিহীন ঝুড়ি।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের অশোভন উক্তির কথাটিও এক্ষেত্রে একই পাল্লায় বিচারের দাবি রাখে বৈকি! ভারতের প্রতি তথা ভারতের জনগণের প্রতিও নিক্সন এতসব অবজ্ঞাসূচক ও অসৌজন্যমূলক উক্তি সেই দিনগুলোতে করেছিলেন যা ভাবলে আজও তার শিষ্টাচার-ভব্যতা ইত্যাদি বিষয়ে মনে নানান প্রশ্নের উদয় হয়। যা হোক, একাত্তর পেরিয়ে গেছে সে আজ কত কত কাল! অতলান্তিক মহাসাগরের অবারিত জলরাশি এতদিনে কত লক্ষবার এপার থেকে ওপারে গড়িয়ে গেছে তার হিসাব কে রাখে? ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ সকল রাষ্ট্রেই কত পরিবর্তন, চড়াই-উতরাই, উত্থান-পতন ঘটে গেছে। একাত্তরে যেসব রাষ্ট্র আমাদের প্রতি বৈরী ছিল তাদের অনেকের সঙ্গেই আমাদের সখ্য ও সুসম্পর্কও স্থাপিত হয়েছে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে কোন কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে খানিক মন কষাকষিও সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে দেশী-বিদেশী চক্র-চক্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাত করার কতই না প্রয়াস-প্রচেষ্টা চলেছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে পুনরায় বৈরিতা সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের প্ররোচনায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে। চীন মাও সেতুং, লিউ শাও চী, চৌ এন লাইকে সময়ের মেঘলোকে উধাও করে দিয়ে আবার পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটিয়েছে ‘সমাজতন্ত্রের’ নতুন মোড়কে। গ্লোবাল ভিলেজ আর বিশ্বায়নের নামে বিশ্বব্যাপী এক নতুন ও জটিল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এরই প্রভাবে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিতে দেশে দেশে চলছে নানামুখী তৎপরতা। এই উদ্যোগ-আয়োজন থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে কেন? শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভূ-লুণ্ঠিত চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মানমর্যাদা ও আত্মসম্মান ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। আর তাতে করে দেশে সকল মানুষের মধ্যেই আত্মোন্নয়নের এক প্রেরণা দেখা দিয়েছে। যে প্রভাবে সকলেই নিজেকে সেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করে চলেছে। তাই আজকের বিশ্ব অর্থনীতির কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও বাংলাদেশের পরিশ্রমী মানুষ শক্ত হাতে হাল ধরেছে, জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছে এই স্বপ্নকে বুকে নিয়ে যে, বাংলাদেশ আর পিছিয়ে থাকবে না। এগিয়ে যাবে দৃপ্তপদভারে। কিসিঞ্জারের মুখে চপেটাঘাত করে বাংলাদেশের মানুষ আজ সেই প্রমাণ দিয়েছে যে, আমরা ‘বটমলেস বাস্কেট’ নই, বরং আমরাই এখন বিশ্বের অন্যতম একটি উন্নয়নের রোল মডেল। এই অর্থনৈতিক সাফল্যের পথ বেয়েই তাই একাত্তরের বৈরী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনও আজ এগিয়ে এসেছে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হবার অভিপ্রায়ে। রাশিয়া, ভারত, ব্রিটেনসহ অন্য অনেক দেশই আজ আমাদের উন্নয়নের ব্যাপারে সহযোগিতা করে চলেছে। রাশিয়া, জাপান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ আমাদের সহজ শর্তে ঋণ থেকে শুরু করে নানান উন্নয়নমূলক কাজে সাহায্য করতে যারপরনাই আগ্রহী। অনেক বিশাল বিশাল উন্নয়ন পরিকল্পনা আর তাতে সাহায্য-সহযোগিতার পূর্ণ আশ্বাসের ঝাঁপি মেলে ধরেছে তারা। এসবই আমাদের জন্য সুখকর বিষয় নিশ্চয়ই। তবে এ ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণের আগে প্রস্তাবগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ যে অতি জরুরী তা এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা সরকারকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের অর্থনীতির চাকাটি আজ বহু কষ্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও সার্বিক জনগণের প্রচেষ্টায় প্রশংসনীয় গতি অর্জন করেছে। সুতরাং, কোন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের পরিণতিতে বা কোন কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর প্ররোচনার ফাঁদে পড়ে যেন এই গতি বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে সবিশেষ দৃষ্টি রাখাটা দেশপ্রেমিক নীতিনির্ধারক মাত্রেরই কর্তব্য। চীন, জাপান, রাশিয়া অনেক বড় বড় প্রকল্পে ঋণ সহযোগিতা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ও করছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু ক্ষেত্রে এসব দেশের সঙ্গে এম ও ইউ এবং ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ সকল চুক্তির বিষয়ে বা ওইসব দেশ থেকে নতুন করে ঋণ পাবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে প্রকাশ জিডিপি বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জকে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া থেকে বিভিন্ন শর্তযুক্ত চড়া সুদে ঋণ নিতে কোন কোন মহল নাকি বেপরোয়া। সুদের হার ৩ থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ, উপরন্তু বিভিন্ন শর্ত তো আছেই। এমনধারার ঋণ বেশি নেয়া হলে তা আমাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন আশঙ্কাও করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং, এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের বিকল্প নেই। এ জাতীয় শর্তযুক্ত ও চড়া সুদের ঋণ নিতে একাধিক প্রকল্প বাছাই করা হচ্ছে বলে ওই সূত্রমতে প্রকাশ। এমতাবস্থায়, সংশ্লিষ্ট মহলের জ্ঞাতার্থে এ জাতীয় ঋণে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা দেশের কি ও কেমন ক্ষতি সাধিত হয় তার দু-একটি নিদর্শন তুলে ধরা যাক : এক্ষেত্রে চীনা ঋণের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা যায় যে, এসব ঋণের ক্ষেত্রে উচ্চ সুদ নেয়া হয়, যা ২-৩ শতাংশ থেকে ৬-৭ শতাংশ অবধি দাঁড়ায়। পাঁচ বছরের জন্য সময় বৃদ্ধির বিধান সংবলিত এই ঋণ ২০ বছরে ম্যাচিউর হয়। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অত্যন্ত স্বল্প সুদে যেমন ০.২৫ শতাংশ থেকে ২-৩ শতাংশ হারে সহজ শর্তে ঋণ দেয়। শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে তার হামবানতোতা বন্দর প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য ৩০ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছিল, যার সুদের হার ছিল শতকরা ৬.৩ শতাংশ। আর ওই ঋণ ১১ বছরে পরিশোধ করার কথা। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা তার নরোচচোলাই কয়লা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে শতকরা প্রায় ৪ শতাংশ সুদের হারে ৮৯ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ঋণ নেয়। এই ঋণে চীন শর্ত জুড়ে দেয় যে, প্রকল্পের ঠিকাদারির কাজ কোন চীনা কোম্পানিকে দিতে হবে আর যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও প্রকিউরমেন্টের কাজ দিতে হবে চীনা প্রতিষ্ঠানকে। উপরন্তু, কমসে কম শতকরা ৫০ ভাগ প্রকিউরমেন্ট হতে হবে চীন থেকে। যাই হোক, এসব কারণেই এ ধরনের প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে আজ সেখানে নানান সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কেননা, ইতোমধ্যেই হামবানতোতা প্রকল্প বিপুল লোকসান গুনছে। গত ২৮ অক্টোবর ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধে বলা হয় যে, হামবানতোতা বিমানবন্দর এখন বিশ্বের সবচেয়ে কমচালু বিমানবন্দর হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এমতাবস্থায়, এই প্রকল্পের লোকসান পোষাণোর জন্য চীনের সঙ্গে এখন এমন এক চুক্তি করতে হচ্ছে যাতে করে এই প্রকল্পের উপর শ্রীলঙ্কার নিয়ন্ত্রণই আর গত ডিসেম্বর থেকে থাকছে না। হামবানতোতাসহ শ্রীলঙ্কায় চীনা ঋণের সহায়তায় যেসব অবকাঠামোগত প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে তাতে করে দেখা যায় শ্রীলঙ্কা শুধু এক্ষেত্রেই ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ দায়ভারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। চীন প্রকল্প বাস্তবায়নকল্পে নিজ দেশের যেসব শ্রমিক নিয়োজিত করে তাদের মধ্যে কারাবন্দী আসামিদেরও অন্তর্ভুক্ত করে থাকে তারা। এটি অনেকটা যেন তাদের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল ওই সময় পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় বিভিন্ন চীনা প্রকল্পে ৬৬৬০ জন চীনা কর্মী নিয়োজিত ছিল। তাছাড়া চীনা প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও প্রায়ই শোনা যায়। ২০১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমস পত্রিকার খবরে বলা হয় যে, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপাল শ্রীসেনা শ্রীলঙ্কায় চীনা ঋণে বাস্তবায়িত অবকাঠামোগত প্রকল্পসমূহে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ব্যাপারে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। এক্ষেত্রে তিনি ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কলম্বো বন্দরনগরী প্রকল্পের দুর্নীতি তদন্তেরও অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে ভোলেননি। শুধু শ্রীলঙ্কাই নয়, মিয়ানমার, ঘানা, পাকিস্তান, এঙ্গোলা, গিনি বিভিন্ন দেশেও চীনা ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নরত প্রকল্পসমূহ সম্পর্কে এমনি নানান অভিযোগ শোনা যায়। মোদ্দাকথা, চীনা ঋণ অনেক ক্ষেত্রেই গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে বিভিন্ন দেশে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক স্বার্থটিকেই বুঝিবা চীনারা বেশি করে দেখে থাকে। এর সঙ্গে যে দায়বদ্ধতা বা কিছু অঙ্গীকারের ব্যাপারও জড়িত এ কথা চীনারা সম্ভবত মানতেই চায় না। ফলে বিরাট বিরাট প্রকল্পের কাজ তারা করে বটে; কিন্তু শেষকালে অনেক ক্ষেত্রেই তা সংশ্লিষ্ট দেশটির জন্য সমূহ বিপদই ডেকে আনে মাত্র! এমন অনেক নজিরই রয়েছে। সুতরাং, এসব ঘটনার আলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণপূর্বক ঋণ গ্রহণ ও প্রকল্প প্রণয়নের কাজ হাতে নিতে হবে। জিডিপি বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার নামে যেনতেন প্রকল্প প্রণয়ন আর চড়া সুদে ও কঠিন শর্তে চীন বা অন্য কোন দেশ থেকে ঋণ গ্রহণের আগে গভীরভাবে তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে। লক্ষ্য রাখতে হবে, প্রস্তাবিত প্রকল্প যেন শেষকালে একটি অলাভজনক প্রকল্পে পরিণত না হয় বা ঋণের বোঝা হয়ে সার্বভৌমত্বের উপর খবরদারি করার মওকা না পায়। মনে রাখা দরকার, দেশপ্রেমবর্জিত আমলা-ফড়িয়ারা নিছক নিজেদের আখের গোছাবার জন্য নীতিনির্ধারক মহলের সামনে নানান প্রতারণার ফাঁদ মেলে ধরে। সে ফাঁদে পা না দিয়ে দেশের সত্যিকারের কল্যাণধর্মী প্রকল্প প্রণয়ন আর কম সুদের সহজ শর্তের ঋণে তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকাটা অতীব জরুরী। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×