ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

একুশের বইমেলা ॥ প্রস্তুতি প্রত্যাশা প্রস্তাবনা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

একুশের বইমেলা ॥ প্রস্তুতি প্রত্যাশা প্রস্তাবনা

বুধবারে শুরু হচ্ছে একুশের বইমেলা, মাঝে মাত্র চার দিন। চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে লেখক-প্রকাশকদের। পাঠকদেরও কি নয়? ধরা যাক লেখক-পাঠক মিলিয়ে সংখ্যাটা যদি হয় এক হাজার, তবে পাঠকের সংখ্যা কত? প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ যান বইমেলায়, একুশে ফেব্রুয়ারিতে লাখো মানুষ। শুক্রবারগুলোয়ও লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। এদের সবাই অবশ্য বই কেনেন না। পড়েন কি? বইয়ের ক্রেতা ও পাঠক লক্ষ্যযোগ্যভাবে বাড়ছে না। অথচ প্রতি বছরই নতুন প্রকাশক আসছেন, নতুন লেখকেরও জন্ম হচ্ছে। বই নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মেলা একুশের বইমেলায় বইয়ের বিক্রয়লব্ধ অর্থ আগের বছরের হিসাবকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে নানা সীমাবদ্ধতা, আক্ষেপ ও অভিযোগ সত্ত্বেও বইমেলা বাণিজ্য-বিচারে তার সাফল্য বজায় রেখেছে। আগে বাংলা একাডেমির মাঠে মেলাটি হতো। প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে গেল যে গাদাগাদি- ঠাসাঠাসি একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে বইমেলাটি চলে এলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তবে লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল বইমেলাটি বড় কোন জায়গায় অনুষ্ঠিত হোক। অবশ্য এখনও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ বইমেলার অংশ বটে। সেখানে ছোটকাগজগুলোর স্টল থাকে। শিশু-কিশোরদের বইয়ের স্টল থাকে এবং মহান একুশে স্মরণে বক্তৃতামালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানÑ এ দুটি ভেন্যুর মাঝখানে কিছুটা হাঁটাপথ, এবং দু’দিকে চলা একটি প্রশস্ত সড়ক। উদ্যানে মেলা আয়োজনের পর দেখতে দেখতে কয়েক বছর চলেও গেল। তাই বলা যায় বইমেলা মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্য অবয়ব পেয়েছে। এই রচনায় আমরা মূলত লেখক-প্রকাশকদের প্রস্তুতি, প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে কিছু নতুন বইয়ের খবর তো থাকছেই। পাঠকরা জানেন মাসব্যাপী বইমেলার যাবতীয় সংবাদ প্রকাশের জন্য সব সংবাদপত্র বিশেষভাবে স্থান বরাদ্দ দিয়ে থাকে। টিভি চ্যানেলগুলোও প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রচার করে। ছাড়কৃত মূল্যে বিজ্ঞাপন প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয় মিডিয়ায়। সব কিছুর উদ্দেশ্যই হচ্ছে পাঠকের কাছে নতুন বইয়ের তথ্য তুলে ধরে তাকে বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করা। একুশের বইমেলা নিয়ে শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত সবার ভেতরেই বিশেষ আবেগ কাজ করে। ভাললাগা কাজ করে। বই হলো জ্ঞান ও আনন্দের ভাণ্ডার, তাই বইমেলার আয়োজন সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হোক, তার প্রচেষ্টা থাকে সব পক্ষেরই। এ কথা আমাদের বার বার বলতে হবে যে, বই হলো অনন্য পণ্য, যা নিবেদিত হয় মহাকালের উদ্দেশে। তাই কালের মহার্ঘ্য হতে হলে তাকে হতে হয় যোগ্য, সম্পূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ এবং সূচাররূপে প্রকাশিত। সে কারণেই পাণ্ডুলিপি উত্তমরূপে সম্পাদনা ও গ্রন্থ মুদ্রণপ্রমাদমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কয়জন গ্রন্থ উৎপাদক বা প্রকাশক এই শর্তগুলো পূরণ করেন? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সফল বইমেলা করতে হলে মুক্ত মত গ্রহণের বিকল্প নেই। একাডেমির বাইরের সড়কটিকে অবশ্যই বইমেলার মূল আয়োজনের বাইরে কেবল নিষ্প্রাণ সড়ক হিসেবে গণ্য করলে আর চলছে না। মেলা শুরুর আধঘণ্টা আগে যান চলাচল বন্ধ করে মেলা শেষে পুনরায় এই সড়ক যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু মেলার বাকি সময়টকু এই সড়কটিকে মেলার অংশ করে তুলতেই হবে। পানি-বিদ্যুত, হাঁটাপথ, পর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থা, প্যাভিলিয়ন, খাবারদাবার, আড্ডাস্থলÑ সব কিছুর সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ধুলা থেকে বাঁচার সুবন্দোবস্ত থাকা চাই। বইমেলার স্বাভাবিক চিত্র হলো প্রতিদিনই ভ্যানগাড়িতে করে নতুন নতুন বইয়ের আগমন। মেলায় রেকর্ড সংখ্যক কিংবা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো সংখ্যায় বই আসে নিত্য ছাপাখানার টাটকা গন্ধ নিয়ে। একুশের বইমেলার জন্য আমরা অনেকখানি ত্যাগ স্বীকারেও যেন রাজি থাকি। মিডিয়া শতভাগ সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত থাকে। এতে ব্যবসায়িক বুদ্ধি ছাপিয়ে প্রাণের টানটাই বড় হয়ে ওঠে। আমরা বরং আত্মশ্লাঘা নিয়ে বলতেই পারি ‘বইপ্রিয় বাঙালীর অনন্য এক মেলা’ আমাদের একুশের চেতনাকে প্রতিবছর সমুন্নত করছে। এটা সত্যি যে নানা দিক দিয়ে একুশের বইমেলাটি অনন্যই বটে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা এ সবই কোন না কোন ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলে পুরোটা মাস। লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মিলন মেলাই বটে এই বইমেলা। ভুলে গেলে চলবে না শুধু একুশের বইমেলাকে উপলক্ষ করেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশের লেখক-পাঠকরা মাতৃভূমিতে ফেরেন। বিশ্বের আর কোন দেশে এতগুলো দিন, মানে মাসজুড়ে বইমেলা হয় না। কোন মেলায় হুড়মুড় করে হাজারও দর্শক এবং পাঠক-ক্রেতা মেলায় প্রবেশের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে না। বলতে পারি ভাষার মাসে একটা হুজুগ চলতেই থাকে। তবে বইয়ের জন্য বইমেলা আর বইমেলার জন্যই এত আয়োজনÑ সে কথা আমরা ভাল করে কি খেয়াল করি? খেয়াল করলে মেলাকে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর করার লক্ষ্যে আমরা সোচ্চার হতাম এবং বইমেলার বাইরেও যে বইয়ের জন্য, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই করণীয় রয়েছেÑ সে সব দিকে দৃষ্টি দিতাম। মহান একুশের বইমেলায় গিয়ে সবাই বই কিনবেন এমনটাও আশা করি না। অন্তত এটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি, বই নিয়ে যে- মেলা তাতে দর্শনার্থীরা অন্তত দুই মিনিটের জন্য হলেও একখানা নতুন বই হাতে তুলে নেবেন। না কিনুন, উল্টেপাল্টে দেখবেন। প্রত্যেক মেলায় কয়েক হাজার করে বই প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু ভাল বই বা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ নির্বাচন করতে গেলে হতাশা এসে ভর করে। তার পরও মানসম্পন্ন না হলেও লেখকদের, বিশেষ করে নবীন-তরুণ লেখকদের বই প্রকাশ বা লেখালেখির সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ইতিবাচক একটি কাজ। সাহিত্য বা সংস্কৃতিচর্চায় যতক্ষণ নিয়োজিত থাকেন তরুণরা ততক্ষণ মাদকের মতো নেশার হাতছানি বা অন্যান্য অপকর্ম থেকে তারা মুক্ত থাকেনÑ এই সামাজিক বাস্তবতাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাই যার যা খুশি লিখুন, বই বার করুন, বন্ধুদের বই উপহার দিন। এই কর্মকাণ্ড থেকেই আগামীতে বেরিয়ে আসবে নতুন পথরেখা। তাই নিয়ন্ত্রণ নয়। তবে এটা ভুললে চলবে না যে কোন লেখকের পাণ্ডুলিপি অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ সম্পাদক দ্বারা সম্পাদিত হওয়ার পর প্রকাশ করাই বাঞ্ছনীয়; আন্তর্জাতিক মানদণ্ডও সেটা। শত শত প্রকাশকের মধ্যে ক’জন এটা জানেন? জানলেও মানেন? বইমেলার স্টল বরাদ্দের পর... সোমবার বইমেলার স্টল বরাদ্দ দেয়া হলো। প্রকাশকরা অধীর আগ্রহে এর অপেক্ষায় ছিলেন। প্রকাশকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারু ভাগ্যে প্রত্যাশামাফিক একাধিক ইউনিটের স্টল জোটেনি। কারু বা স্থানটি মনোপূত হয়নি। প্রকাশনা জগতের একমাত্র নারী প্রকাশনা-অধিকর্তা শাম্মী শাহরিয়ার চটজলদি ফেসবুকে তার স্টলের (চিত্রা প্রকাশনী) নম্বর প্রচার করে দিলেন। একজন শুভানুধ্যায়ী কিছুক্ষণের মধ্যে মেলোর মাঠ থেকে বাঁশের কাঠামোর ছবি তুলে লাল দাগ দিয়ে স্টলটির অবস্থান তুলে ধরলেন, অর্থাৎ কমেন্টের ঘরে ছবি জুড়ে দিলেন। শ্রাবণ প্রকাশনীর স্টল পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কিছুকাল তুমুল আলোচনা চলেছিল। প্রকাশনাটির কর্তাব্যক্তি রবীন আহসান খুবই খুশি। তিনি লিখলেন : একটি সুসংবাদ। বাংলা একাডেমিতে এবার ডিজিটাল লটারির কারণে শ্রাবণ প্রকাশনীর ১৯ বছরের সময়কালে ইতিহাসে প্রথম ভাল জায়গায় স্টল পেয়েছে! অপরদিকে সিনিয়র প্রকাশক মজিবর রহমান খোকার কথায় (বিদ্যাপ্রকাশ) ঝরে পড়ল ক্ষোভ। তিনি লিখলেন : ‘প্রতিবছর লিখিত আবেদন করা সত্ত্বেও কোন কারণ দর্শানো ছাড়া প্রত্যাখ্যাত হচ্ছি। এ জন্য অবশ্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বা মেলা উদযাপন কমিটি আমার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, করেও না। কারণ তারা জানে, যাদের হুঙ্কারবল, পেশীবল, অর্থবল, মন্ত্রী-আমলাবল আছে, তাদের যথাযথ ইজ্জত-সম্মান দিয়ে চলতে হয়। যারা ২ ইউনিটের স্টল পাওয়ার যোগ্য নয়, তাদের ৪ ইউনিটের স্টল বা প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দিতে হয়Ñ কেবল ক্ষমতার দম্ভ আছে বলে। অনৈতিকতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং মেলা উদযাপন কমিটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ প্রকাশকদের অভিমত কোন পাঠককে যদি বইমেলা শুরুর দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশের বাইরে চলে যেতে হয় তাহলে কমপক্ষে তিনি মেলার অর্ধেক নতুন বই সম্পর্কে অন্ধকারেই থাকবেন। বইমেলা আস্তে আস্তে সমাপ্তির দিকে যত এগোয়, প্রকাশকরাও তত বেশি করে নতুন বই মেলায় আনতে থাকেন। তার মানে হলো নতুন বই প্রকাশের বেলায় মেলা শুরুর আগে প্রকাশকদের প্রস্তুতি অসমাপ্ত থাকে। এ নিয়ে বরাবরই আমরা প্রকাশকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছি। তাড়াহুড়ো করে বই নয়, মেলা শেষের আগেই সব পাণ্ডুলিপি ছাপা হয়ে যাক। কোন কোন প্রকাশক বিষয়টি অনুধাবনে সমর্থ হচ্ছেন। মিজান পাবলিশার্সের প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটওয়ারী বললেন, ‘বইমেলার পুরোটা সময় শুধু বইমেলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই। বইয়ের প্রকাশনা নিয়ে টেনশন করতে চাই না, বইমেলা উপভোগ করতে চাই। আমার প্রকাশনীর সব বই জানুয়ারিতেই বেরিয়ে যাবে।’ কেমন বইমেলা চান? এমন প্রশ্নের জবাবে এডর্ন প্রকাশনীর সৈয়দ জাকির হোসাইন বললেন, বইমেলাকে দেখতে হবে অবশ্যই শুদ্ধ বই চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে। যেখানে লেখক-প্রকাশক এমন চর্চা করবেন যাতে জাতির সৃজন ও মননের চৌকস বহির্প্রকাশ থাকবে। পুষ্টিহীন খাদ্য যেমন কোন শরীর রক্ষা করতে পারে না, তেমন শুদ্ধতাহীন কোন প্রকাশনা মননের শক্তি বাড়াতে পারে না। বই দেখতে ও দেখাতে যেমন সৌন্দর্যের পণ্য তেমন অপর পিঠের বিষয় কোন ধরনের বই আমাকে ও আমার সমাজকে সমৃদ্ধ করবে সেটি অনুধাবন করা। মেলা দিনে দিনে যৌবন পেরিয়ে এখন পরিপক্ব। আমাদের সৃষ্টিশীলতার দক্ষতা ও পরিপক্বতাই পরিপূর্ণতা দিতে পারে এগিয়ে যাবার স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণে। অয়ন প্রকাশনের মিঠু কবির তিনটে পয়েন্ট দিলেন। ১. অমর একুশে বইমেলাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে। শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর এবং গোটা বইমেলা প্রাঙ্গণকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনা হোক। বইমেলা যত সামনের দিকে এগোয় নিরাপত্তা তত শিথিল হয়। আমরা একটি সর্বোচ্চ নিরাপদ একুশে বইমেলা চাই। ২. গত বছর তোরণ, ফেস্টুন, ব্যানার আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন হয়নি। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। এ বছর শাহবাগ, টিএসসি, দোয়েল চত্বর, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অংশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঢোকার গেটে তোরণ নির্মাণ করলে প্রচার প্রসার বৃদ্ধি পাবে বলে আমার বিশ্বাস। ৩. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একুশে বইমেলার অংশে কমপক্ষে চারটি গেট করা হোক। সে সব গেটের অন্তত তিনটি দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান করার সুযোগ থাকবে। লেখক-পাঠকদের চাওয়া কথাশিল্পী আতা সরকার বলেন, বাংলা একাডেমির বইমেলা মানেই এক ধরনের ঘনবদ্ধ শিহরণ। ঢাকার নগর জীবনে শুধু নয়, সারা দেশে এমনকি দেশে দেশে যেখানে বাঙালীদের বাস সেখানেই চাঞ্চল্যের অভিঘাত দেখা দেয়। ভাষা শহীদদের রক্তের অনুরণন প্রত্যেক বাঙালীর ধমনীতে। একটা সড়ক যখন সেই একক মেলাটিকে ভাগ করে ফেলে তখন হৃদয়ে ধাক্কা খাই। পুরো রাস্তাকে জড়িয়ে মাঝখানে কোন ফাঁকা আর শ্রেণী বিভাজন না রেখে অখণ্ড গোটা মেলা কি করা যায় না? বই মেলায় আসি তারুণ্যের প্রাণপ্রবাহ খুঁজতে। নিজেদের তারুণ্য আবিষ্কার করতে। ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে কত শত লিটল ম্যাগাজিন সঙ্কলন বেরুত। বই মেলায় ঢোকার মুখেই তরুণরা চেপে ধরত উচ্ছল সৃষ্টির আনন্দে। এই ভিড়টাকে আমরা হারিয়ে ফেলছি। বন্ধ হয়েছে সদ্য নতুন প্রকাশকদের আবাহন করার প্রবণতা। তেমন জেদি অহঙ্কারি প্রকাশকও কি হারিয়ে গেছে? বইমেলার গায়ে লেগেছে বনেদি হাওয়া। তরতাজা হাওয়াও যে পেতে চাই। আরেক কথাশিল্পী পাপড়ি রহমান বলেন, খুন-হত্যাবিহীন বইমেলা চাই। মোটকথা রক্তপাতহীন, সাধারণ মানুষের আনাগোনামুখর মেলা দরকার। যেমনটা আমাদের তারুণ্যে ছিল। বইমেলায় না- গেলে আমাদের স্থবির মনে হতো। সারা বছর অপেক্ষার পর একডাঁই বই কিনে ঘরে ফেরা। আতঙ্কহীন ঘুরে ঘুরে বই দেখা আর কেনা। তেমন বইমেলা চাই। যেন পাঠক বই কেনে পাঠের তাগিদে। নিজের প্রাণকে কল্লোলিত রাখার তাগিদে। আর প্রতিটা ভাল বইয়ের খবর যেন পাঠকের কাছে পৌঁছায়। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমগুলো যেন বিশেষ ভূমিকা রাখে। গল্পকার আফরোজা পারভীন বললেন, বইমেলা হওয়া দরকার আকর্ষণীয়। ধুলাবালিমুক্ত পরিবেশ, নির্দিষ্ট দূরত্বে ডাস্টবিন, হাঁটা আর বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ, টয়লেট ফ্যাসিলিটি থাকা জরুরী। সারা বছর লেখকরা অপেক্ষা করে থাকেন মেলার জন্য। এ কারণে মেলার সময় অনেক বই প্রকাশ হলেও মানসম্মত বই কমই পাওয়া যায়। বইয়ের কনটেন্ট ভাল হলেও ছাপার ভুল থাকে, বাইন্ডিং খারাপ হয়, প্রচ্ছদ উপযুক্ত ও মনোগ্রাহী হয় না। এদিকে প্রকাশক লেখক উভয়ের নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন নতুন লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য লেখক-পাঠক ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতার ব্যবস্থা করা। লেখকদের জন্য কিছু আড্ডার জায়গা থাকলেও তারা সেখানে বসেন না। জায়গাগুলো দখল করে থাকে মিডিয়ার লোকজন এবং মেলায় আসা পাঠক-দর্শনার্থী। আড্ডাস্থলগুলোতে লেখকরা নিয়মিত বসে পাঠকদের সঙ্গে তাদের লেখালেখি সম্পর্কে কথা বললে মেলার পরিবেশ আন্তরিক ও উপভোগ্য হবে। কান্তা রেজা বলেন, যেহেতু প্রকা- এক জায়গা নিয়ে মেলাটি আয়োজিত হয়ে থাকে, তাই বিশ্রামের জন্য যথেষ্ট জায়গা প্রয়োজন। প্রায়ই দেখেছি, শিশুরা বই কিনতে এসে হাঁপাচ্ছে। সাংবাদিক সেলিনা শিউলির মতে এমন বইমেলা হবে, যেখানে সাহিত্যপ্রেমীরা যাবে। তুমুল আড্ডা হবে চা বা কফির সঙ্গে। রাজনীতি নয়, থাকবে শুধু বইয়ের কথা। সাংবাদিক রেজা নওফল হায়দার চান ডিজিটাল বইমেলাÑ মেলায় রাখা পর্দায় স্পর্শ করলে যেন জানা যায় বইয়ের খবর, কার্ড দিয়ে কেনা যাবে বই, স্টলে হেড ফোন দিয়ে শোনা যাবে বইয়ের রিভিউ ও লেখকের পরিচয়। লেখক মিজানুর রহমান কল্লোল মনে করেন বইমেলার পরিবেশ অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায় ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কারণে। চ্যানেল কর্মীরা অনেকখানি জায়গা দখল করে রাখে। চিত্রধারণের সময় অহেতুক স্বাভাবিক চলাচল বিঘিœত হয়। তরুণ লেখক রাফিউজ্জামান সিফাত চান মানুষ দলবেঁধে আসবে, ঘুরবে, দেখবে এবং বই কিনে বাড়ি ফিরবে, নতুন লেখকদের উৎসাহিত করবে এমন বইমেলা। আশারাফুজ্জামান উজ্জ্বল বললেন, শুধু ভ্রমণকাহিনী পাওয়া যাবে এমন স্টল থাকলে বেশ হতো। পাঠক তারেক মাহমুদ চান পাঠক ও লেখকদের সরাসরি আলাপচারিতা বা ঘনিষ্ঠ হবার প্রাণবন্ত পরিবেশ বা সুযোগ থাকতে হবে যেন লেখকের লিখা চিন্তা ও দর্শন নিয়ে আরও জীবন্ত ভাব বিনিময় করা যায়। বইয়ের মিছিল... মুক্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ফেসবুকে লেখকদের নতুন বইয়ের খবর জানাতে। তাৎক্ষণিকভাবে বহুজনই প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচ্ছদ পাঠিয়ে তার তথ্য তুলে ধরেন। বইমেলায় যেসব নতুন বই আসছে তার সংবাদ সামনের চার শুক্রবার সাহিত্যের পাতায় থাকবে, তা ছাড়া প্রতিদিন যথারীতি জনকণ্ঠের শেষ পাতায় বক্স করে খবর থাকবে। তাই আপাতত আমরা অল্প কিছু বইয়ের তথ্য তুলে ধরছি। বইমেলায় আসছে কবি ওমর শামসের প্রবন্ধগ্রন্থ জীবনানন্দ কেন শুদ্ধতম, সদ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক শাহাদুজ্জামানের উপন্যাস একজন কমলালেবু, ইকবাল হাসানের প্রেমবিরহের অণুকাব্য ও গল্পগ্রন্থ আলো আঁধারে কয়েকটি সোনালি মাছ, শোয়াইব জিবরানের কাব্য ঘোর ও শূন্য জলধিপুরাণ, হামীম কামরুল হকের গল্পগ্রন্থ অক্ষরপুরুষ ও অন্যান্য গল্প, শামস আরেফিনের কাব্য নবজাতক স্বপ্নেরা, এহসান মাহমুদের কাব্য আদিবাসী প্রেমিকার মুখ, ফরিদ কবিরের আমার গল্প, ফারহানা মান্নানের একুশ শতক ও অন্য শিক্ষার সন্ধানে, রোমেনা লেইসের কাব্য মেঘের দেশে মেঘবালিকা, আনোয়ার কামালের কাব্য বিমূর্ত মগ্নতা, বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের কিশোরগ্রন্থ রহস্যময় মেরিন দ্বীপ, স ম শামসুল আলমের নির্বাচিত গল্প, সোহরাব সুমনের অনুবাদগ্রন্থ মহান সুলতান সুলেমান, রবিশঙ্কর মৈত্রীর কাব্য যিশু হলেই ক্রুশবিদ্ধ হতে হয়, সিদ্দিক মাহমুদুর রহমানের কলকাতা ও কলকাতা, রাহেল রাজীবের কাব্য কাকতাড়ুয়ার গোপন গ্রাম, রিয়াসাত আল ওয়াসিফের হাওয়ায় উড়ছে কবিতা, সোলায়মান সুমনের গল্পগ্রন্থ মৃত্যুখেকো মানুষগুলো, কাজী জহিরুল ইসলামের ভ্রমণসমগ্র, পিয়াস মজিদের স্মৃতিসত্তার সৈয়দ হক, রুখসানা কাজলের নুনফল গল্পকথা, কামাল রাহমানের দুটি উপন্যাস রাজাধিরাজ ও দেবপাল, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর বিজ্ঞান ইতিহাস সমাজ কড়চা ‘উপরিতলের গভীরে’, শামীম আহমেদের প্রিয় প্রেম অপ্রিয় বিচ্ছেদ প্রভৃতি।
×