জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ রাজধানীর মণিপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী সামীয়া তাবাসসুম তার মায়ের সঙ্গে নিলক্ষেতে গাইড বই কিনতে এসেছে। কারণ পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন অনুশীলনী তার কাছে বোধগম্য নয়। মায়ের মন্তব্য, পাঠ্যবইয়ে দেয়া সৃজনশীল প্রশ্নগুলো বইয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। প্রতিবছরের শুরুতেই সামীয়ার মতো প্রায় সব শিক্ষার্থী গাইড বই কিনতে ভিড় করে বিভিন্ন বুক হাউসে। শিক্ষা আইনে নিষিদ্ধ করা হলেও নোট বই ও গাইড বই এখনও বিক্রি হচ্ছে বাজারে। বরং নোট-গাইড এখন বাজারে সহায়ক বই বা অনুশীলন মূলক বই হিসেবে পরিচিত।
রাজধানীর নীলক্ষেত, আজিজ সুপার মার্কেট ও বাংলাবাজার বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর বই ক্লাস ভিত্তিক ‘প্যাকেজ’ সাজিয়ে রেখেছেন দোকানিরা। মার্কেটে অনুপম, জুপিটার, লেকচার, পাঞ্জেরীসহ বিভিন্ন গাইডগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা অনুপম, জুপিটার এই দুটি গাইডেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বলে জানালেন বিক্রেতারা। মিরপুরের একটি বেসরকারী কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রী সাবরীনা। তার স্কুল থেকেই বলে দেয়া হয়েছে অনুপম সিরিজের গাইড বই কিনতে। তার মা বললেন, ‘এসব কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণে না পড়িয়ে, বরং তাদের গাইড বইয়ের প্রতি ঠেলে দিচ্ছে শিক্ষকরা। আমার তো মনে হয়, শিক্ষকদের কাছেই বোধগম্য নয় সৃজনশীল পদ্ধতি।’ বিভিন্ন বেসরকারী স্কুলের পাশাপাশি সরকারী স্কুলের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন অনেক অভিভাবক। এসব স্কুলের শিক্ষকরাই মূলত বলে দেন কোন গাইডটি কিনতে হবে।
রাজধানী আজিজ সুপার মার্কেটে ভিকারুননিসা ন্যূন স্কুল থেকে গাইড বই কিনতে এসেছিল ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাহসিনা হাবীব। সে অনুপম সিরিজের একসেট বই কিনেছে ৪৫০ টাকা দিয়ে। তবে, মূল বই থেকে সমাধানের চেষ্টা করে তাহসিনা। তাহসিনার মা রোজিনা কবীর বলেন, ‘সিলেবাস এমন করে সাজানো নোট ছাড়া আমরা নিজেরা বুঝতে পারি না। শিশুরা কিভাবে বুঝবে! এজন্য গাইড বই কিনতে আসছি। একদিকে সরকার বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে, অন্যদিকে সিলেবাস কঠিন করে গাইডের প্রচারে সহায়তা করছে। তাই আগে মূল বই সহজ করতে হবে। তারপর গাইড বন্ধ করতে হবে।’
শাহীন স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে জিপিএ-৫ পেয়েছে তানজিলা। সে বাবা আব্দুল কাদেরীর সঙ্গে নীলক্ষেতে এসেছে গাইড বই কিনতে। আব্দুল কাদেরী বলেন, ‘আজকে সবাই নোট গাইডের দিকে ঝুঁকছে, তার বড় কারণ হলো মূল বইয়ের সক্ষমতা নেই। যদি অংক বইয়ের কথা বলি, সেখানে দেখা যায়, যে সব অনুশীলনী দেয়া থাকে তার অধিকাংশই থাকে নোট গাইডে। সমাধান ৫ বা ৭ টি দেয়া থাকে তা অন্য প্যাটার্নের সঙ্গে মেলে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের সুবিধার জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হলেও, শিশুরা এর সুবিধা ভোগ করছে না। সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসরণ করায় এখন বিভিন্ন গাইড বইয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। কারণ পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নগুলো এতটাই কঠিন করে দেয়া হয়েছে। যেগুলো বাচ্চারা বইতে খুঁজে পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের উচিত মূল বই সহজ সাবলীল করা। যেন শিশুরা সেখান থেকে প্রশ্ন এবং উত্তর খুঁজে পায়।
শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বাড়াতে ‘সৃজনশীল’ নামে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু করা হলেও এই পদ্ধতি বরং শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে চাপে রাখছে বলেও মন্তব্য অনেক অভিভাবকের। মূলত এই পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে বই পড়া আরও কমে গেছে, নির্ভরশীলতা বেড়েছে কোচিং সেন্টার আর গাইড বইয়ের ওপর। এমনকি শিক্ষকেরাও এখন গাইড বইয়ের ওপর অধিক নির্ভরশীল। এমনকি ক্লাসেও শিক্ষার্থীদের গাইড থেকে প্রশ্ন পড়ানো হয়। সৃজনশীল নামের প্রশ্নপদ্ধতি একে কাঠামোবদ্ধ, তার ওপর এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া হয়নি। সর্বোপরি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে বিভিন্ন রকম অনিয়ম, নিয়োগ-বাণিজ্যে মেধার পরাজয় হওয়ার কারণে সক্ষম মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের গবেষণা কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষানীতিতে স্পষ্টভাবেই এসব গাইড বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দিয়েছেন। সংসদে শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে। নোট-গাইডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা সরকারের। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে বলেই হয়তো বা গাইড বইয়ের বিক্রি বাড়ছে। তবে এর জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি দায়ী হতে পারে না। কারণ সৃজনশীল পদ্ধতি অনুসারে পড়তে হলে সৃজনশীলভাবেই পড়তে হবে। বইয়ে যে প্রশ্নগুলো থাকে তার উত্তর বইয়ের পাওয়া না গেলেও, একই গল্প অথবা অনুচ্ছেদের মতোই ভিন্ন একটি গল্প অবলম্বণে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হয়। তাই বইয়ের গল্পটি যদি শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে তবেই অনুশীলনীর প্রশ্নগুলোরও উত্তর দিতে পারবে। এক্ষেত্রে গাইড বই অবলম্বন করার দরকার নেই।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ‘সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রণয়নের ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিই বোঝেন না। এ কারণে এসব শিক্ষক নোট-গাইড থেকে প্রশ্ন করেন। সরকারী হিসেবে সারা দেশে এ সংখ্যা ৪৫ ভাগ। আর শিক্ষক নেতাদের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ ভাগ।’
কয়েকজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুখস্থনির্ভর না হয়ে বুঝে পড়ার জন্য সরকার নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। কিছু অসাধু প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে এসব বই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে এসব নোট বা গাইড কিনতে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এভাবে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা থেকে আর লাভবান হচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। মুখস্থবিদ্যা নয়, বুঝে পড়ার জন্য সৃজনশীল পদ্ধতি আবিষ্কার করা হলেও শিক্ষার্থীরা এর উপকারিতা পাচ্ছে না। জিপিএ-৫ পাওয়ার আশায় তারা নোট বা গাইড বইয়ের আশ্রয় নিয়ে তোতাপাখির মতো পড়া মুখস্থ করছে। অন্যদিকে অভিভাবকেরাও এ বিষয়ে উদার। জিপিএ-৫-এর আশায় সন্তানকে নানা রঙের বাহারি নামের গাইড বই কিনে দিচ্ছেন।
নোট গাইডের ব্যাপারে শিক্ষা আইন খসড়ায় বলা হয়েছে, কোন প্রকাশক বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কেবল সহায়ক পুস্তক বা ডিজিটাল শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রকাশ করতে পারবে। কিন্তু কোন ধরনের নোট বই, গাইড বই বা নকল মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে না। এই আইনের ফলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তারা সৃজনশীলতা থেকে বের হয়ে নোট-গাইড নির্ভর হয়ে পড়ছে, আর সুযোগ করে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা ও শিক্ষকরা। এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই সবাইকে সচেতন হতে হবে।