ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একান্ত সাক্ষাতকারে সাবেক তারকা ফুটবলার মাহমুদুল হক লিটন;###;টি ইসলাম তারিক

‘ফুটবল জাগরণে আবাহনী-মোহামেডানের বিকল্প নেই’

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৪ জানুয়ারি ২০১৭

‘ফুটবল জাগরণে আবাহনী-মোহামেডানের বিকল্প নেই’

বাংলাদেশের ফুটবলের ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরতে হলে চুয়াডাঙ্গার কথা চলে আসবে অবলীলায়। কারণ ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত একাধিক খেলোয়াড় খেলে গেছেন কলকাতা তথা অল ইন্ডিয়া ফুটবল টুর্নামেন্টে। তাদের মধ্যে অন্যতম শাহাব উদ্দিন, হাবু জোয়ার্দার, ডুডি জোয়ার্দার, অদুদ মণ্ডল, কানাই লাল হরিদাস বৈরাগী এবং শাফায়েত বিশ্বাসসহ আরও অনেকে। শাফায়েত বিশ্বাস ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তান বাছায় একাদশের হয়ে খেলেছিলেন ইরানের বিরুদ্ধে। তবে চুয়াডাঙ্গা ফুটবলের জনক হিসেবে এই জেলায় খ্যাতি প্রয়াত হায়দার আলী জোয়ার্দারের। সেই চুয়াডাঙ্গায় কারও জন্ম হলে ফুটবলের প্রতি একটা আলাদা টান থাকাটাই স্বাভাবিক। তেমনি তার জন্ম হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। ঐতিহ্যের রেস ধরে ফুটবল নিয়েই মেতে থাকতেন তিনি। বড় হয়ে নিজেকে তৈরি করেছিলেন ফুটবলার হিসেবেই। যিনি ঢাকা লীগে খেলা শুরু করেই তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তার খেলোয়াড়ি যৌবন পার করেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়র্নে খেলেই। টাকার জন্য তিনি হন্য হয়ে অন্য দলে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেননি কখনোই। তিনি মাহমুদুল হক লিটন। ফুটবল সমর্থকরা যাকে বড় লিটন বা ব্রাদার্সের লিটন হিসেবে চিনেন। ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল ছোট বেলা থেকেই। তবে বলতেই হয় তৎকালীন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক যিনি বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দার এবং প-িতজি নামে খ্যাত এক স্থানীয় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় তিনি হতে পেরেছিলেন একজন দক্ষ ফুটবলার। লিটন সম্পর্কে বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান জানান, লিটন ছিল ব্রাদার্স তথা বাংলাদেশ ফুটবলের একজন দক্ষ স্ট্রাইকার। তার পায়ের কাজ ছিল অসাধারণ। সে যদি মোহামেডান বা আবাহনীতে খেলত তবে তার ফুটবল ক্যারিয়ার হতো অন্যরকম। আনোয়াররুল করিম খসরু নামে ফুটবলের এক সমর্থক জানান- কাজী সালাহ উদ্দিন, এনায়েত এবং মেজর হাফিজ উদ্দিনের পর দীর্ঘদিন ফুটবলে স্ট্রাইকারের অভাব ছিল। সেই গ্যাপটা কিছু কিছু স্ট্রাইকার পূরণ করেছিলেন বটে, তবে লিটন পূরণ করেছিলেন একজন পরিপূর্ণ জাত স্ট্রাইকার হিসেবেই। যার ফুটবল মেধা, ড্রিবলিং, গতি আর নিশানা ভেদি শর্ট ছিল অন্যদের চাইতে আলাদা। লিটন ১৯৮২ সালে অনুর্ধ ১৯ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। ১৯৮৩ সাল থেকে জাতীয় দলে। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ব্রাদার্সের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৯৯ সালে লিটন কোচিংয়ে ‘বি’ লাইসেন্স অর্জন করেন। পারিবারিক সমস্যার কারনে ‘এ’ লাইসেন্স অর্জন করা হয়নি। ১০টি বাইরের দেশের ট্রেনিং সম্পন্ন করেছেন। তিনি দুই বছর শেখ রাসেলের এবং এক বছর ফেনি সকারের কোচ ছিলেন। শেখ রাসেল দুইবারেই লীগে তৃতীয় স্থান লাভ করে। মাহমুদুল হক লিটন ১৯৮৬ সালে ব্রাদার্সের ১৯৯২ সালে ওয়ারির অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৯৩ থেকে ৯৫ মৌসুম তার প্রথম ক্লাব ইস্টেন্ডে খেলে খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করেন। দুই মেয়ের জনক লিটন। ১১ ডিসেম্বর হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে তার শরীরে রিং পরানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন। টাকার প্রতি তার কখনোই লোভ ছিল না। যদি তা থাকত তবে জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান বা আবাহনীতে তিনি খেলতে পারতেন নির্দ্বিধায়। ফুটবল ছিল তার নেশা। তিনি মনে করেন ফুটবল একটা পুঁজি। যা বিক্রি করার জন্য নয়। আর তাই তো তিনি তার ফুটবলের ভরা যৌবন পার করেছেন তার প্রিয় ক্লাব ব্রাদার্সে। আর তাই তো সমর্থকরা আজও তাকে অবলীলায় স্মরণ করেন নিঃসার্থবাদী লোভহীন আদর্শ খেলোয়াড় হিসেবেই। তারকা এই ফুটবলার দৈনিক জনকণ্ঠকে দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাতকার। তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলোÑ * ফুটবলে কিভাবে নিজেকে যুক্ত করলেন? ** আসলে আমি মূলত ফুটবলের পাশাপাশি ভলিবল খেলতাম। ওই সময় আমি বিটিএমসির ভলিবল খেলোয়াড় ছিলাম। ১৯৮১ সালে ভিক্টোরিয়াতে ফুটবলার হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করি। কিন্তু ভারতীয় খেলোয়াড় মীর সাজ্জাদ, নইমুদ্দিন আর নাসির উদ্দিন ভিক্টোরিয়াতে খেলতে আসলে ক্লাব কর্মকর্তারা ওই বছর আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলেন। আগামী বছর ক্লাবে যোগাযোগ করতে বলেন। আমি বাড়ি চলে যাই। আমার ভেতরে খুব জিদ কাজ করে। সে বছরেই আমি ঢাকা এসে ইস্টএ্যান্ড ক্লাবের ব্যাক আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। আলমগীর ভাই ক্লাব অফিসিয়ালের সঙ্গে কথা বলে আমাকে লীগের মাঝ পথেই ইস্টএ্যান্ডে খেলার আমন্ত্রণ জানান। পরবর্তীতে আমি ভিক্টোরিয়া থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে ইস্টএ্যান্ড ক্লাবে খেলা শুরু করি এবং এক ম্যাচ পরেই ওয়াপদার সঙ্গে হ্যাটট্রিক করি। * বাংলাদেশ ফুটবলের এমন দৈন্যদশা আপনি কিভাবে দেখছেন? ** একজন ফুটবলার হিসেবে অবশ্যই ভালভাবে দেখছি না। ভাবতেই অবাক লাগছে ফুটবল র‌্যাঙ্কিং এখন ১৮৭! যেখানে আগে মূল প্রতিপক্ষ ছিল ভারত সেখানে এখন ভুটান আর মালদ্বীপ। এমন চলতে থাকলে ফুটবলে বাংলাদেশ একেবারে সর্ব নিম্নে চলে যাবে। * এখান থেকে বের হওয়ার উপায় কী? ** আপনি চাইলেই কোটি কোটি টাকা খরচ করে এক বছরে কখনোই সাফল্য পাবেন না। এটা শুধুমাত্র ফুটবল নয় সর্ব ক্ষেত্রেই। অবশ্যই দীর্ঘমেয়াদী সঠিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। সেটা হতে পারে দশ বছর বা তারও বেশি। * সঠিক পরিকল্পনা বলতে কী বোঝাচ্ছেন? ** ফুটবল খেলাকে ছড়িয়ে দিতে হবে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে। গ্রাস রুট লেভেল থেকে কাজ শুরু করতে হবে। গ্রাস রুট লেভেল বলতে আমি বলছি না যে একেবারেই শিশু থেকে তা নয়। স্কুল বা কলেজ লীগ চালু করে সেখান থেকে বাছাই করে তাদের ভাল প্রশিক্ষকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং সেটা কোন একাডেমির মাধ্যমে হতে পারে। * বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ তো অনেক জেলা ঘুরেই হয়েছে। কোন পরিবর্তন কী চোখে পড়েছে ? ** এখনও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে আছে। দল সব জেলা ঘুরে খেললে কিন্তু কাজ হবে না। সব জেলায় নিজস্ব লীগ চালু করতে হবে। তবেই খেলোয়াড় তৈরি হবে। * আপনি যখন খেলতেন তখন কোন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়কে সমীহ করতেন? ** অবশ্যই পাকির আলী। সেসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে খেলত। তার পা, মাথা, চোখ এবং মেধা একসঙ্গে কাজে লাগাত। * আপনার দৃষ্টিতে এ যাবতকালের সেরা প্লেয়ার কে? ** খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল। খুবই ট্যালেন্টেড প্লেয়ার ছিল ওয়াসিম । তার মতো প্লেয়ার আজ অবধি আমার চোখে পড়েনি। * বাংলাদেশের ফুটবল জাগরণে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত? ** সারা বিশ্বে ফুটবল হকি বা ক্রিকেট বলেন সবখানে দুটো দল পক্ষ এবং প্রতিপক্ষ। সেটা ক্লাব বা দেশ। তেমনি বাংলাদেশে মোহামেডান আর আবাহনী। আবাহনী-মোহামেডানের রিজার্ভ সমর্থক রয়েছে। বাংলাদেশ ফুটবল জাগরণে মোহামেডান-আবাহনীর বিকল্প নেই। অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি মোহামেডানকে ভাল দল গড়তে হবে। যেন চ্যাম্পিয়ন ফাইটে থাকে। আগামী পাঁচ বছরে যদি তিনবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারে তবে দর্শক মাঠে আসতে বাধ্য। ফুটবল জাগরণ বলতে যেটা বুঝায় সেটা হবে এ কথা নিশ্চিত। চ্যাম্পিয়ন রেসে শেখ জামাল, শেখ রাসেল, ঢাকা এবং চিটাগং আবাহনীর পাশাপাশি মোহামেডানকেও থাকতে হবে। মোহামেডান ভাল দল গড়তে পারছে না। চ্যাম্পিয়ন তো দূরের কথা এবার রেলিগেসনের শঙ্কায় পড়েছিল। দর্শক তো মুখ ফিরিয়ে নেবেই। আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু চ্যাম্পিয়নের যে স্বাদ সেটা পাচ্ছে না। আবাহনীর কোচ জর্জ কোটান কিন্তু সে কোথায় বলে গেছেন। যেখানে দর্শক গ্যালারি শূন্য সেখানে চ্যাম্পিয়ন হওয়াতে মজা নেই। * আপনি তো সারাজীবন খেলেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। তবে মোহামেডানÑআবাহনীর কথা বলছেন কেন? ** যেটা বাস্তব সত্য আমি সেটাই বলছি। এদেশে আবাহনী-মোহামেডান ছাড়া অন্য কোন দলের কোন সমর্থক নেই। ব্রাদার্স ছিল তৃতীয় শক্তি। আবাহনী-মোহামেডানের সমর্থকরাই ব্রাদার্স সমর্থন করত যখন প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে ব্রাদার্সের খেলা থাকত। (হেসে)। * একজন সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য আপনার কী করণীয় আছে? ** দেখেন সাধারণত খেলোয়াড়রা অবসর নিয়ে ঝুঁকে পড়ে ক্লাবের বা বাফুফের কর্মকর্তা হওয়ার জন্য। আমি খেলা শেষে জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যবসা শুরু করি। বর্তমানে আমি দেশের ফুটবলের কথা চিন্তা করে আমার নিজ জেলা চুয়াডাঙ্গায় বিগত ছয় মাস আগে ‘ফিউচার ফুটবল একাডেমি’ তেরি করেছি। আমাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নইম হোসেন জোয়ার্দার। এখান থেকে যদি কিছু খেলোয়াড় বের করতে পারি সেটা অবশ্যই ফুটবলের জন্য উন্নতি হবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমি মনে করি একজন সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। * খেলোয়াড়ি জীবনে ক্লাবের হয়ে আপনার সব চাইতে সেরা খেলা কোনটি? ** ১৯৮৫ সালের ব্রাদার্স-আবাহনী ম্যাচটিই আমার জীবনের সেরা এবং কষ্টের খেলা। আমরা ২-০ গোলে লিড নিয়েও কিছু ভুলের কারণে ম্যাচ হেরে গিয়েছিলাম। সে বছর ব্রাদার্সের নিয়মিত একাদশ সাজাতে হিমশিম খেতে হতো। যেখানে ২৪ জন খেলোয়াড় স্কোয়াডে থাকে সেখানে আমাদের সর্ব সাকুল্যে খেলোয়াড় ছিল ১৫ জন। আমি পাকির আলির সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হলে আমার রিপ্লেসমেন্ট খেলোয়াড় রাজকুমারের মাঠে নামার কথা। কিন্তু সে পারিবারিক জটিলতার কারণে দেশে ফিরে যায়। কোচ আলী ইমাম ভাই ভেবেছিলেন আমি সুস্থ হয়ে মাঠে নামতে পারব। তাই তিনি একটু সময় নিচ্ছিলেন। এই ফাঁকে আবাহনী একটি গোল পরিশোধ করে বসে। পরে আমি আর মাঠে নামতে পারিনি। শেষে আবাহনী ৩-২ গোলে জয় লাভ করে। তবে ২-০ গোলে আমরা এগিয়ে থাকার পর ওয়াসিম আবাহনীর গোলরক্ষককে একা পেয়েও একটা অমার্জনীয় মিস করে। সে গোলটা হয়ে গেলে ব্রাদার্স প্রথম চ্যাম্পিয়নের স্বাদ পেত। * দেশের হয়ে কোন্্ খেলাটার কথা আপনার এখনও মনে পড়ে? ** ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে ফিনল্যান্ডের একটি ক্লাবের সঙ্গে খেলাটি আজও আমার খুব মনে পড়ে। সে খেলাতে আমরা ফিনল্যান্ডকে ৩-১ গোলে পরাজিত করি। যাতে হ্যাটট্রিক করেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম ভাই। তিন গোলের দুটিই আসলাম ভাই করেছিলেন আমার পাস থেকে। * আপনি জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান আবাহনীতে খেলেননি কেন? ** আমি ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে আবাহনীতে যোগ দিলেও ইনজুুরির কারণে খেলা হয়নি। মোহামেডানে ১৯৮৩ সালে আমার খেলা প্রায় নিশ্চিত ছিল। কিন্তু এক কর্মকর্তার কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য আর খেলা হয়নি। তবে ১৯৮৮ সালে এশিয়ান ক্লাব কাপে পিরুজির বিরুদ্ধে মোহামেডানের স্কোয়াডে ছিলাম।
×