ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রূপগঞ্জের বকুল কানন

অত্যাচারী জমিদারের নিপীড়নের সাক্ষী, ১৩শ’ বছরের পুরনো

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২ জানুয়ারি ২০১৭

অত্যাচারী জমিদারের নিপীড়নের সাক্ষী, ১৩শ’ বছরের পুরনো

মীর আব্দুল আলীম ॥ জমিদারী যুগের অবসান হয়েছে প্রায় দেড় শ’ বছর আগেই। তবে তাদের নিজ হাতে গড়া বিভিন্ন স্থাপনা, বৃক্ষ, জলাশয়গুলো আজো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কৃতকর্ম আর দুঃশাসনের স্মৃতি নিয়ে। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার জমিদার বাবু জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর অধীনে থাকা তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমায় অন্তর্গত ছিল। ফলে খারিজা তালুক স্বত্বাধিকারী রঘুরামপুরের রঘুনাথ রাম নারায়ণের অধীনে রূপগঞ্জের পূর্বপার ছিল ঢাকা জেলাধীন একটি জনপদ। এ জনপদের লোকজনের জন্য এক সময়ের আতঙ্কের নাম ছিল রঘুরামপুরে রাজার নানা কুকীর্তি। স্থানীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, মুড়াপাড়ার জমিদার জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জীর নিজ বাসভবন তৎকালীন মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি থেকে একটু বিনোদনের জন্য হাতিতে চড়ে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে রঘুরামপুরের তালুকে চলে যেতেন। ঐ এলাকার তালুকভুক্ত জমিদার রঘুনাথ রাম নারায়ণের খনন করা দুটি দীঘি আগার পাড়ার দীঘি ও রঘুরামপুরের দীঘিতে পরিবারের সদস্য নিয়ে বাংলো হিসেবে সময় কাটাতেন। পরে গুতিয়াব এলাকায় চ-ীবাড়ির বকুল কাননে পাঁঠাবলি দিতেন। সূত্র জানায়, সে সময়ে ১২টি বকুল ফুলের গাছ বর্তমান বিশালকার আকৃতিতেই দাঁড়িয়ে ছিল। যা কালের বিবর্তনে আজও তরতাজা ও সজীব প্রাণে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ বাঙালীর প্রাণের উৎসব বৈশাখীমেলায় আসা লোকজনদের ছায়া দিয়ে আসছে। স্থানীয় বাসিন্দা রঘুনাথ রাম রায়ের উত্তরসূরি ৭২ বছর বয়সী যাদব চন্দ্র জানান, ছোট্ট বয়স থেকেই চ-ীবাড়ির ৮টি বিশালাকার বকুল গাছ আর দুটি বটগাছ একই আকৃতিতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাষ্যমতে, তার পিতা রাম অশ্বনী কুমার চৌধুরী, রাম নিবারণ চন্দ্র চৌধুরী, দীপুরাম রায় চৌধুরী, রঘুরাম নারায়ণ চৌধুরীসহ ধারাবাহিকভাবে জানতে পারেন বকুল বৃক্ষগুলো তখনও অক্ষত অবস্থায় ও একই আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নানা প্রাচীন কল্পকাহিনী ছিল এই বকুল কাননকে ঘিরে। ফলে অজানা বয়স নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল কানন হয়ে উঠছে ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণীয় স্থান। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এখানে পূজা করে। তবে স্থানীয় অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এ গাছগুলোর বয়স প্রায় ১৩শ’ বছর। তারা জানান, সাধারণত বকুল গাছের আকৃতি অতটা বড় হয় না। তবে গুতিয়াব চ-ীবাড়ি এলাকার অতি উর্বর জৈব শক্তিযুক্ত দোঁয়াশ মাটির এ গাছগুলো এমন আকৃতি পেয়েছে। তারা আরও জানায়, গাছগুলোর বয়স নিয়ে রয়েছে অজানা রহস্য। কারণ এই বকুল কাননের অভ্যন্তরে স্থাপিত শিব মন্দিরের প্রাচীন শিলালিপি পাওয়া গেছে। যার বয়স নিরূপণ করা যায়নি। তাদের ধারণা এই চ-ীবাড়ির বকুল কানন অতি প্রাচীনকালের জনপদের সাক্ষী। তবে বর্তমানে এই বকুল কানন হয়ে উঠেছে কিছু দরিদ্র পরিবারের জন্য আয়ের সুযোগ। এই এলাকার ২০ থেকে ২৫টি পরিবারের সদস্যরা শীত মৌসুমে বকুল ফুলের মালা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের একজন সুবল দাশ জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বকুল ফুল কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে যান তিনি। পরে পরিবারের সকল সদস্য মিলে ছোট ও বড় আকারের বকুল ফুলের মালা তৈরি করেন। এসব মালা সকাল হলেই স্থানীয় জনবহুল স্থানে ফেরি করে বিক্রি করেন। একটি মালা ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ টাকায়ও বিক্রি করেন। এভাবে প্রতিদিন ২শ’ থেকে ৩শ’ মালা বিক্রি করে আয় করেন দৈনিক প্রায় হাজার টাকা। এভাবে এই এলাকার আরও পরিবারের সদস্যরা শীত এলেই এই পেশায় যুক্ত হন। আয় করেন বাড়তি টাকা। ফলে বকুল কানন তাদের কাছেও আশীর্বাদ হয়ে আছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, বকুল কাননটি পুরনো বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী। এখানে ১২টি বকুল বৃক্ষ ছিল একসময়। তবে কালের বিবর্তনে কিছু গাছ মারা যায়। পরে ৮টি বৃহৎ বকুল গাছই হয়ে ওঠে স্থানীয়দের বিনোদনের স্থান। গতবছর একটি গাছ কালবৈশাখী ঝড়ে ভেঙ্গে যায়। এখন দাঁড়িয়ে আছে ৭টি বকুল গাছ। স্থানীয়রা আশা করছেন, এভাবে কালের সাক্ষী এই গাছগুলো রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এগিয়ে আসবেন। সূত্র আরো জানায়, এই বকুল কাননটির জমিদারের নানা কুকর্মের সাক্ষীও হয়ে আছে। তৎকালীন শোষণের শিকার কথিত আছে, জনগণ কোন উপায় না পেয়ে এই বকুল কাননকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। তাই স্রষ্টা এই বকুল কাননকে অমরত্ব দান করেছেন বলে মনে করেন স্থানীয় সনাতন ধর্মের লোকজন। জমিদাররা তাদের শত্রুপক্ষকে এখানে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করত বলে রয়েছে নানা কাহিনী। মেয়ে সন্তান হলে এখানে পুঁতে রাখারমতো ভয়ঙ্কর কাহিনীও রয়েছে মুখে মুখে। পরে রেওয়াজ বদলিয়ে নিয়মিত সনাতনীদের উৎসবে পাঁঠাবলি দিয়ে আসছেন। বর্তমান জনপদের বাসিন্দারা এখানে শ্রী চণ্ডী মাতাবাড়ি একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সকল ধর্মের লোকজন স্বাধীনভাবে বিচরণ করেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুরাদুল হাসান বলেন, গুতিয়াব এলাকার বকুল ফুলের বৃক্ষগুলো অতি প্রাচীন। এই বৃক্ষের দেখা মেলা ভার। স্থানীয়দের পাশাপাশি সরকারীভাবে এই গাছের বীজ সংগ্রহ করে রাখার তাগিদ দেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, এ গাছ ধ্বংস করা মানে ইতিহাস ধ্বংস করা। সকলকে এই বৃক্ষগুলোর যত্ন করার আহ্বান জানান তিনি।
×