ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তিনদিনের জয়নুল উৎসব আয়োজন

শিল্পাচার্যের জন্মদিনে চারুকলায় প্রাণের উচ্ছ্বাস

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

শিল্পাচার্যের জন্মদিনে চারুকলায় প্রাণের উচ্ছ্বাস

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পৌষের রোদেলা সকাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ছড়িয়েছে প্রাণের উচ্ছ্বাস। প্রাঙ্গণজুড়ে বইছে আনন্দের আবহ। লিচুতলা থেকে বকুলতলা-সবখানেই উৎসবের আমেজ। ভেসে বেড়াচ্ছে গানের সুর। কোথাও বা বসেছে মেলা। স্টলগুলোয় ঠাঁই পেয়েছে শখের হাঁড়ি, টেপা পুুতুল, নকশি কাঁথা, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্যসহ মনকাড়া রকমারি পণ্যসামগ্রী। এমন আনন্দময় পরিবেশের উপলক্ষ ছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিন উদ্্যাপন। বৃহস্পতিবার ছিল শিল্পাচার্যের ১০৩তম জন্মদিন ও ১০২তম জন্মবার্ষিকী। সেই সুবাদে রঙময় হয়ে ওঠে চারুকলার আঙিনা। দেশের চারুশিল্পের পথ প্রদর্শককে জানানো হয় জন্মদিনের অপার ভালবাসা। এদেশের চারুশিল্প ও চারুশিক্ষার পথিকৃৎ শিল্পীর স্মরণে তিন দিনের জয়নুল উৎসবের সূচনা হয়। এ আয়োজনে জয়নুল সম্মাননা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। এ বছর জয়নুল সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান ও ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী যোগেন চৌধুরী। এছাড়াও চারুকলা প্রাঙ্গণে উন্মোচিত হয়েছে শিল্পাচার্যের অবয়বময় দুটি ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে যেন শিল্পাচার্যের শরীরী অস্তিত্ব না থাকলেও তাঁর সামনে চলে আসে তাঁর মননের অনুভব। জয়নুলের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদিন জীবনসঙ্গীর ভাস্কর্য উন্মোচনের সময় চেয়ে থাকেন অপলক দৃষ্টিতে। পেছনের স্মৃতিতাড়িত আবেগ এসে ভর করে তাঁর দুই চোখজুড়ে। আর এই দুই ভাস্কর্যের একটি নির্মাণ করেছেন ভারতের ভাস্কর তারক গড়াই এবং অন্যটি চারুকলার শিক্ষার্থীরা। শিল্পাচার্যের শ্রম, মনন ও মেধায় গড়া চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে এ উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হয়েছে। উৎসবের শুরুতেই পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয় জয়নুুলের সমাধিসৌধে। প্রথমে পরিবারের পক্ষে একগুচ্ছ লাল গোলাপ দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শিল্পাচার্যের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদিন। এরপর শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। এছাড়াও শ্রদ্ধা জানায় চারুকলা অনুষদ, অনুষদের আটটি পৃথক বিভাগ, শিল্পকলা একাডেমি, লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, ভারতীয় হাইকমিশন, চারুশিল্পী সংসদ, চারুকলা বরিশাল, গ্যালারি চিত্রকসহ শিল্পকলার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। শ্রদ্ধা নিবেদনের পালা শেষে উৎসবের উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা ছিল অনুষদের বকুলতলায়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, বিশেষ অতিথি ছিলেন জাহানারা আবেদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। অতিথিরা শিল্পী যোগেন চৌধুরী ও হাশেম খানের হাতে তুলে দেন জয়নুল সম্মাননা। এছাড়া ‘জয়নুল শতবর্ষ প্রবন্ধাবলী’ শিরোনামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিবৃন্দ। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতায় শিল্পাচার্যকে নিবেদিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। অনেকগুলো কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে শোনায় ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সত্য-সুন্দর’ ও ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’। সম্মাননা গ্রহণ করে যোগেন চৌধুরী বলেন, দেশজ শিল্পের সঙ্গে আধুনিকতার সংযোগ করেছিলেন জয়নুল আবেদিন। চিত্রকলায় যতই বিবর্তন ঘটুক না কেন, ক্যানভাসে মানুষের উপস্থিতি থাকবে, থাকবে জমির মানুষের গল্প। এ বিষয়টি তার কাছ থেকেই শেখা। অনুভূতি প্রকাশে শিল্পাচার্যের আপন স্মৃতির ডানা মেলে ধরেন হাশেম খান। বলেন, ১৯৫৮ সালের কথা বলছি, আইয়ুব খান সামরিক ক্ষমতাবলে রাজনৈতিক চর্চার পথ বন্ধ করে দিলেন। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। স্যার ঠিক করলেন, তিনি চারুকলায় লোকশিল্পীদের নিয়ে এক মেলা করবেন। সারা বাংলার লোকশিল্পীদের নিয়ে তিনি এই মেলা করবেন। আমি একে দেখি আমাদের চিত্রকলার এক অনন্য আন্দোলন হিসেবে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, জয়নুল আবেদিন দাঁড়িয়ে আছেন এক ঈর্ষণীয় জায়গায়। দেশ-বিদেশে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শিল্পীরা তাকে নিয়ে এমনই বলেন। তবে আজ আমরা সঠিক সময়ের মধ্যে নেই, চারপাশে নানা বিভ্রান্তি। এ সময়ে শিল্পাচার্যের দর্শন ও বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। তাঁর আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুবা সব আয়োজন বৃথা হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ভাস্কর তারক গড়াই নির্মিত জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য উন্মোচন করেন জাহানারা আবেদিন। এ সময় তিনি বলেন, জয়নুল আবেদিনের কাজকে সংরক্ষণ করতে হবে। সে সঙ্গে সবার মাঝে তাঁর কাজ ও চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপর সবার জন্য উন্মুক্ত হয় জয়নুল মেলা। চারুকলার সঙ্গে সম্পৃক্তদের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন এ মেলায়। এতে অংশ নিয়েছে চারুকলা অনুষদের আটটি বিভাগ- অঙ্কন ও চিত্রায়ন, ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, কারুশিল্প, মৃৎশিল্প, গ্রাফিক ডিজাইন, প্রাচ্যকলা এবং শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকার বাইরে থেকে আসা আরও ১২টি স্টল। প্রতিটি স্টলেই পাওয়া যাচ্ছে লোকজ অনুষঙ্গময় বিভিন্ন সামগ্রী। স্টলে সাজানো শোলার তৈরি পাখি, ঝালর, টেপা পুতুল, ক্যালেন্ডার, চিত্রকর্ম, ছোট-বড় ভাস্কর্য দেখার পাশাপাশি ঘরেও নিয়ে গিয়েছেন অনেকেই। আর বিকেল বেলায় ছিল নাচে-গানে সাজানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এতে অংশ নেয় শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা। উৎসব চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ উৎসবে লিফলেটের মাধ্যমে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মদিবসকে (২৯ ডিসেম্বর) ‘জাতীয় চারুকলা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ। একইসঙ্গে তারা দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপনের আহ্বানও জানিয়েছেন।
×