ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যবিত্ত পরিবার ঝুঁকেছে সঞ্চয়পত্র কেনার প্রতি ;###;২০ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে ইতোমধ্যে

লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ মাসেই

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ মাসেই

রহিম শেখ ॥ দুই বছর আগে সরকারী চাকরি থেকে অবসরে যান হাবিবুর রহমান। পেনশনের যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে কেনেন ‘পেনশনার’ সঞ্চয়পত্র। নিজের নামে কেনা সঞ্চয়পত্রের ত্রৈমাসিক মুনাফা তুলতে গত সোমবার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন তিনি। জানালেন, দক্ষিণ কমলাপুরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে যে টাকা পান তা দিয়ে বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর চেষ্টা করেন। সুদের হার কমানোর পরও বিনিয়োগ করছেন কেন, জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সুদের হার কমলেও ব্যাংকের তুলনায় তো এখনও অনেক বেশি পাচ্ছি। তাছাড়া এই মুহূর্তে বিনিয়োগের আর কোন জায়গা নেই বলে তার মত। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১ লাখ টাকার বিপরীতে তিন মাস অন্তর অন্তর মুনাফা তুলেন ২ হাজার ৯৪০ টাকা। বর্তমানে ৩০ লাখ টাকা থেকে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ এবং যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাচ্ছে। মোট ৪ ধরনের সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন ১৮ বা তার বেশি বয়সের যে কোন নারী। কিনতে পারছেন যে কোন বয়সের শারীরিক প্রতিবন্ধী পুরুষ ও মহিলা। যার একটা বড় অংশই রয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের। মূলত তাদের ওপর ভর করেই প্রতিমাসেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে সরকার। জুলাই-নবেম্বর প্রান্তিকে বিক্রি হয়েছে ২০,৩১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। বাজেটে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৯,৬১০ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যমতে, গত নবেম্বরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ এসেছে ৪ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। অক্টোবরে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, আগস্টে বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৩২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার। এ হিসাবে প্রতিদিন এখন গড়ে ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। সব মিলিয়ে গত পাঁচ মাসে বিক্রি হয়েছে ২০,৩১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-নবেম্বর) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট বিক্রি এসেছিল ১১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদহার কমে আসায় মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে, যা সঞ্চয়পত্রের সুদের তুলনায় অনেক কম। আগে পাঁচ বছর মেয়াদি এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত। ২০১৫ সালের মে মাসে সুদহার কমানোর পর পাওয়া যাচ্ছে ৯১২ টাকা। তারপরও সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ এ খাতে বিনিয়োগ কমেনি, উল্টো বাড়ছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। সুদের হার কমানোর পরও বিক্রি না কমায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধার করেছিল। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে এই লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিক্রি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি তার চেয়েও ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বেড়ে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকায় পৌঁছায়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে সরকারকে। জানা যায়, দেশে বর্তমানে ৪ ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর মধ্যে ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ৩ বছর মেয়াদি ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ৫ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পরিবার সঞ্চয়পত্রের মাসিক মুনাফা ৯১২ টাকা, ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ২ হাজার ৬২২ টাকা, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের তিন মাস অন্তর মুনাফা ২ হাজার ৯৪০ টাকা। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ২ শতাংশ কমানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার সঞ্চয়পত্রে ঋণের সুদ বাড়িয়েছে দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়া মানে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া। সুদ পরিশোধের কারণে সরকারের উন্নয়ন বাজেট কমে আসবে। সুদহার কমানোর পরও ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হারের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকেই ঝুঁকছে মানুষ বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতে সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। এই গবেষকের মতে, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আশার তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় গত অর্থবছরজুড়েই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাহিদা ছিল কম। চলতি অর্থবছরেও একই ধারা অব্যাহত। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) দেশের তফসিলী ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন ঋণ করেনি সরকার। উল্টো আগের নেয়া ঋণের প্রায় ১০ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা শোধ করেছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক (-) ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা।
×