ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর যুগান্তকারী অবদান

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর যুগান্তকারী অবদান

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। এই নয় মাসে আমরা পেয়েছিলাম অনেক বিদেশী বন্ধুত্বের হাত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান বাঙালী জাতির হৃদয়ে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্যের এক নিবিড় সেতুবন্ধ। এই সেতুবন্ধ তৈরির অগ্রদূত ছিলেন বিশ্বরাজনীতির অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা, সর্বোপরি মানবীয় অনুভূতি আমাদের মহান মু্িক্তযুদ্ধে ব্যাপক গতির সঞ্চার করে এবং সফল অপেক্ষাকৃত দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরম আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভের লক্ষ্যে পরিচালিত বাঙালী জাতির মরণপণ লড়াইয়ের দিনগুলোর, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী নিজ দেশের অভ্যন্তরে তো বটেই, বিশ্বের সর্বত্র বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, সংগঠন ও রাষ্ট্রের সমর্থন- সহযোগিতা চেয়েছেন আমাদের অনুকূলে। দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সফল করতে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি সাহায্য করেছিলেন। তাছাড়া বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থী ভারতের পশ্চিম বাংলা, অসম, ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে খাবার ওষুধ আর প্রয়োজনীয় সবকিছুর তদারকি করেন তিনি। বিভিন্ন সময় তিনি এসব শরণার্থী শিবির পরিদর্শনও করেন। পাশাপাশি পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা বন্ধ করা, স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্বজনমত গঠনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দূতিয়ালী ও নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা কোনদিনই ভোলার নয়। তাই দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস পর পাকিস্তানী বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশের পথে পা বাড়িয়ে এ দেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে লন্ডনে যান। লন্ডন থেকে তিনি প্রথমে দেশে স্বজনদের সঙ্গে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে তাঁর আমন্ত্রণে বেশ উৎসাহের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফর করেন। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ইন্দিরার বাংলাদেশ সফরের দিনটিতে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এ সময় সারাদেশের শহর, বন্দর, গ্রামসহ সব জনপদ, এমনকি যানবাহনগুলো পর্যন্ত ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী অমর হোক’ লেখাবিশিষ্ট পোস্টারে ছেয়ে যায়। উভয় দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে মৈত্রীয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিচলভাবে সমর্থন দিয়ে মারাত্মকভাবে ঝুঁকি নিয়েছিলেন, বিশেষ করে পাকিস্তান ও তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে গুরুতর বিবাদে জড়িয়ে পড়ার ভয়ানক বিপদ সত্ত্বেও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপ ও চীনের মনোভাব উপেক্ষা করে তিনি অবিচল থেকেছেন। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেবা করায় ইন্দিরা গান্ধীর এ কাজকে যীশু খ্রিস্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন নোবেলজয়ী মাদার তেরেসা। ‘তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান’ শীর্ষক একটি বইয়ে তেরেসা এ বিষয়টি ্্উল্লেখ করেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতার সম্মাননা’ জানান তাকে (মরণোত্তর)। পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ ওয়ার অ্যান্ড সেসেশন : পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতার ভিত্তি কাজে লাগিয়ে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারতেন, এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর বাবার মতোই কুশলী ছিলেন, যিনি আবার খাপ খাইয়ে নিতে পারতেন। বিশেষ করে, পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে তিনি এই কুশলতার পরিচয় দেন, ১৯৭১ সালের আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে।’ এছাড়া মানবাধিকার রক্ষার জন্য অবস্থান নেওয়ার ইতিহাস ভারতের আছে। বস্তুত, সেই ১৯৪৯ সালে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘যেখানে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার হুমকির মুখে পড়বে বা যেখানে আগ্রাসন হবে, সেখানে আমরা নিরপেক্ষ থাকতে পারি না, আমরা নিরপেক্ষ থাকব না।’ ইন্দিরা গান্ধীও এই ধারা অনুসরণ করেছেন। তিনি নির্দ্বিধায় বাংলাদেশের মানুষের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পন্ডিত নেহরুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দরদী মানবীর অবদানের কথা অম্লান থাকবে চিরদিন। ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। বিজয়ের মাসে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করি।
×