ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

বিজয়গাথা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৬

বিজয়গাথা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিকেল চারটা একত্রিশ মিনিট। দীর্ঘ চব্বিশ বছর পর বাঙালীর মুখে আনন্দোচ্ছ্বাসের জলতরঙ্গ হাসি। মুহুর্মুহু করতালি আর ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে মুখরিত পুরো রেসকোর্স ময়দান। এক অভূতপূর্ব সুখৈশ্বর্যময় মুহূর্ত। নয় মাস নয়দিন আগে এই ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রনিনাদ কণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দিয়ে শেকলে আবদ্ধ বাঙালী জাতির মননে চর্চিত দীর্ঘ লালিত মুক্তির স্বপ্ন পূরণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, ঘাসফড়িংয়ের ডানায় যে স্বপ্ন এঁকে তিনি বাঙালী জাতিকে নতুন ঊষার সন্ধান দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণের মাহেন্দ্রক্ষণটি তাই আবেগী দিক দিয়ে তুরীয়ানন্দে ছুটে চলার মতোই হয়েছিল। আবার তেমনি ঐতিহাসিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ঐদিন একদিকে বাঙালী পাকিস্তানী স্বৈরাচারদের রাহুগ্রাস থেকে, রুদ্ধবাক অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে খুঁজে পেয়েছিল নব প্রাণের আবেশ, অন্যদিকে বিশ্বের মানচিত্রে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে জায়গা করে নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ নামের এক নৈর্সগিক ভূখণ্ড তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। লন্ডনের টাইমস পত্রিকা সেই সময় বলেছিল, রক্তই যদি কোন দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকারের মূল্য বলে বিবেচিত হয়, তবে বাংলাদেশ অনেক বেশি দাম দিয়েছে। সেই দামের বিনিময়েই আমাদের মহান বিজয়। লাখো শহীদের লাল রক্তের সঙ্গে গ্রাম-বাংলার সবুজ প্রকৃতি নব সূর্য কিরণে মাখামাখি হয়ে মিলেমিশে লাল-সবুজের কেতন হয়ে, মহানন্দে বাঙালীকে নতুন রঙিন স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন। যে পাকিস্তানী হানাদাররা এদেশের শান্ত-শিষ্ট মানুষকে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে নিষ্পেষণ করতে করতে কঙ্কালসার বানিয়ে ফেলেছিল; বাঙালীর মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে নিজেদের হৃষ্টপুষ্ট করেছিল; বাঙালীকে সবদিক দিয়ে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত করে নব্য দাসে পরিণত করার পাঁয়তারা করেছিল; আর অপারেশন সার্চ লাইট নাম দিয়ে বাঙালীর অস্তিত্বকে চিরতরে পৃথিবী থেকে ধূলিসাৎ করে দিতে নির্মম, অমানবিক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ দিন রেসকোর্স ময়দানে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যে জয় বাংলা ধ্বনিকে তারা ঘৃণা করত, লাখ লাখ মানুষের বিজয়ী মুখের সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে চলছে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি যখন মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে নিজের রিভলবার জমা দেয়, তখন এদেশের লাখো শহীদের আত্মাও যেন বলে উঠেছিল ‘জয় বাংলা’। ঐ মুহূর্তটি বাঙালী জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের সন্ধিক্ষণ। ঐ মূহূর্ত থেকে বাঙালী বুঝেছিল তাদের আর পাকিস্তানীদের নিষ্ঠুর গুলির আঘাতে নিমর্মভাবে প্রাণ হারাতে হবে না; পালিয়ে বেড়াতে হবে না একটুখানি নিরাপদ ঠাঁই পাওয়ার আশায়; বাতাসে লাশের গন্ধ সহ্য করতে হবে না; ড্রেনে মুখ থুবড়ে থাকবে না কোন ধর্ষিতা বোনের বীভৎস দেহ; ডোবায় ভেসে উঠবে না ফুলে-ফেঁপে থাকা থরে থরে লাশ। অবশেষে পাকিস্তানী শোষণ-নিপীড়ন আর দুঃশাসনের কুহেলিকা ভেদ করে চির নিপীড়িত-নিষ্পেষিত বাঙালী যতি টানতে সক্ষম হয়েছে দীর্ঘ চব্বিশ বছরের কৃষ্ণতর অধ্যায়ের। পাকিস্তানীরা সূচনালগ্ন থেকেই এদেশের মানুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে এমনভাবে দাবিয়ে রেখেছিল যেন তারা বাঙালীকে দাসে পরিণত করতে ছিল বদ্ধপরিকর। বাঙালীর মাঝে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যে ঐকতান সেটাকে তারা ভয় পেত। এজন্য তারা বাঙালীর ওপর এক অস্বাভাবিক দুঃসহ জীবনধারা চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গাঙ্গেয় অববাহিকার বাঙালী জাতির মাঝে হাজার বছর ধরে বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে থাকতে যে সংগ্রামী মানসিকতা সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে আত্মস্থ হয়েছিল, সেই মানসিকতার কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অত্যাচারের কঠোর আবরণ বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠে বাঙালী। তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রামের তীব্রতায় পাকিস্তানী শাসকরা যখন বুঝছিল যে, তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন, তখনই তারা লেলিয়ে দেয় নরপিশাচ হানাদার বাহিনী। এরা রাতের গহিন আঁধারে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যাযজ্ঞের খেলায় মেতে ওঠে। এদের সহচর হয় এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর, আলশামস। এদের সম্মিলিত নির্মমতা এতই ভয়াল রূপ ধারণ করে যে, পুরো বাংলাদেশই পরিণত হয় এক ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপে। এতে পুরো বিশ্ববাসীই হতবদ্ধি হয়ে যায়। কিন্তু বাঙালী দমে যায়নি। তারা দমবার পাত্রও নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শকে, চেতনাকে বুকে ধারণ করে দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করতে বাঙালী শতগুণ বেগে জ্বলে ওঠে। সম্মুখ সমরে কিংবা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে একের পর এক হানাদার ও তাদের দোসরদের পরাজিত করতে থাকে। এজন্য বিলিয়ে দিতে হয়েছে লাখো শহীদের প্রাণ। ভারত বাঙালীকে পরম বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কোটির ওপর শরণার্থীকে তারা যুদ্ধের পুরোটা সময় আশ্রয় দিয়েছিল, ভরণপোষণ দিয়েছিল। অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থকড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল তারা। তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় বীর বাঙালী কোণঠাসা করে ফেলেছিল পাকিস্তানী হানাদারদের। ডিসেম্বরের শুরু“ থেকেই বাঙালীর বিজয় ডঙ্কা বাজতে শুরু করেছিল। যখন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, তখন পরিস্থিতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর সেই সুযোগে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানীদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও কোন মনোবল ছিল না। অসত্যের ওপর ভর করে আর কতক্ষণইবা লড়াই করা যায়! মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পর্যুদস্ত ও হতোদ্যম হয়ে পড়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী। পনেরোই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয় নিয়াজির অনুরোধে। ষোলোই ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল নাগরা নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে নিয়াজি রাজি হয়ে যায়। লেজ গুটিয়ে পালানোর কোন উপায়ই যখন খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন নাগরার এই আহ্বান তার কাছে ছিল চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। যা হোক, পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের কথা প্রচার হয়ে যাওয়ার পর একের পর এক ট্রাকে করে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকে। সবার মুখে অনাবিল হাসি। বাঙালীর সেই সময়ের হাসির সঙ্গে পৃথিবীর আর কোন মানুষের হাসির তুলনা হতে পারে না। যেই রেসকোর্স ময়দান সকালের দিকে ছিল জনশূন্য, সেই ময়দান বেলা তিনটা বাজতে না বাজতেই লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। চারটা একত্রিশ মিনিটে যখন নিয়াজি তিরানব্বই হাজার সৈন্যসমেত আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে তখন কেবল রেসকোর্স ময়দানই নয়, যেন পুরো ধরণীজুড়েই শুরু হয় হর্ষধ্বনি। ঐ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান, যার মধ্যে দিয়ে এক স্বাভাবিক সত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত, মানস ও জাতিগত অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কেবল ধর্মকে পুঁজি করে কোন দুটি পৃথক অঞ্চলের একত্রীকরণ ঠিক হতে পারে না, সেই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হলো দুই শ’ ছেষট্টি দিনের সেই ভয়াল যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে তাসের ঘরের মতোই সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে জাতির পিতার সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ঐ সময় সদ্য প্রয়াত কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে। তাঁর মৃত্যুর পর পুরো জাতি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল গহিন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। গণতন্ত্র হয়ে গিয়েছিল লুপ্ত। এই বিষয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী টাইম ম্যাগাজিন ১৯৮২ সালের ৫ এপ্রিল তাদের একটি বিশেষ সংখ্যায় বলেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দশ বছরের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আমল ছিল সর্বপ্রথম এবং দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আমল। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ও প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে হত্যার পর হঠাৎ গণতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে। ঐ সময়টা ছিল বাঙালী জাতির জন্য নরকতুল্য। সেই সময়টাতে বাঙালীর হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছিল, যে আক্ষেপ-হতাশা তাদেরকে ঘিরে ধরেছিল সেটারই প্রতিধ্বনি খুঁজে পাওয়া যায় আশি সালের দিকে লেখা হেলাল হাফিজের ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতার তিন ছত্রে। তিনি লেখেন- কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ভূমিহীন মনুমিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে/বাঁচবে যুদ্ধের শিশু সসম্মানে সাদা দুধে-ভাতে। এই আক্ষেপ, এই বেদনা ছিল পঁচাত্তর পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, মানুষকে আবারও অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর করে। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় সেবার তা সম্পন্ন করা না গেলেও এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×