ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবি মাঠে ছায়ানটের নিবেদন

লাল-সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া বিকেল

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬

লাল-সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া বিকেল

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ বিজয়ের মহা উপলক্ষ। আনন্দঘন দিন। এই দিনে শুক্রবার রাজধানীজুড়ে ছিল উৎসব অনুষ্ঠান। হ্যাঁ, প্রতিবারের মতোই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের আয়োজনটির কথা আলাদা করে না বললেই নয়। গত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও এখানে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে ছায়ানট। বাঙালী সংস্কৃতি ধারণ ও প্রচার প্রকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখা প্রতিষ্ঠান বর্ণাঢ্য পরিবেশনার মাধ্যমে উদ্যাপন করে বিজয় দিবস। আয়োজনের শুরু হয় বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে। তারও আগে থেকে আসতে শুরু করেন ছায়ানটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও সাধারণ দর্শক শ্রোতা। সবারই পোশাকে পতাকার রং। লাল সবুজে সেজে মাঠে প্রবেশ করছিলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। ততক্ষণে সম্পূর্ণ প্রস্তুত মঞ্চ। দারুণ করে গড়ে নিয়েছেন আয়োজকরা। ভূমি থেকে বেশ খানিকটা উপরে। বেদির মতো দেখতে মঞ্চের রং লাল। চারপাশ খোলা মঞ্চটি ঘিরে বসেন ছায়ানটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সবারই পোশাকের রং ছিল সবুজ। মঞ্চ ও শ্রোতাদের এক ফ্রেমে দেখলে বাংলাদেশের পতাকাটি দেখা হয়ে যায়। বিজয় দিবসে মন কেমন যেন আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মাইকে পাঁচ মিনিটের জন্য সবাইকে নীরব হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তারপর যুদ্ধদিনের সেøাগান ‘জয় বাংলা’। গগনবিধারী সেøাগানের মধ্য দিয়ে মঞ্চে উঠে আসেন বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের কিংদন্তি নেত্রী সন্জীদা খাতুন। ছায়ানট সভাপতি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। একই সময় দাঁড়িয়ে পড়েন সবাই। কণ্ঠে তুলে নেন জাতীয় সঙ্গীতÑ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। মঞ্চ থেকে, মঞ্চের চারপাশ থেকে সবাই জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে সুর মেলান। যোগ দেন গ্যালারি ভর্তি দর্শক। লাল সবুজের মাঝে হারিয়ে যাওয়া বিকেল। সেই বিকেলে বাঙালী আবারও নিজ দেশের প্রতি তাদের ভালবাসার কথা জানান। আয়োজনের সূচনা হয় নৃত্যগীতে। এ সময় নিচে বসা গায়ক-গায়িকাদের কণ্ঠে ছিল নজরুলের অমর সৃষ্টি ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম।’ মঞ্চে তখন নৃত্যনন্দনের শিল্পীরা। বিদ্রোহী কবির বলাটি শারীরিক ছন্দে প্রকাশ করে তারা। লম্বা বেণী দুলিয়ে নৃত্যরত মেয়েদের দেখতে নজরুলের গল্পের নায়িকাদের মতো লাগছিল। প্রথম পরিবেশনা শেষ হতেই নতুন যে গান কানে বেজে ওঠে, সেটিও নজরুলের। সঙ্গে গান। জাগরণী এই গানের বাণীÑ দুর্গম গিরি কান্তার মরু...। সঙ্গে চমৎকার কোরিওগ্রাফি। এবার নৃত্য পরিবেশন করে ছায়ানটের ভরতনাট্যম বিভাগের শিল্পীরা। নয় জনের মতো শিল্পী বিশাল মঞ্চের পুরোটা অধিকার করে নেন। এর পর যুগল কণ্ঠে দেশের গান করেন নাসিমা শাহিন ফ্যান্সি ও শারমিন সাথী ইসলাম ময়না। তাদের কণ্ঠে কথা বলেন সুকান্ত। শিল্পীরা প্রতিবাদী কবি থেকে গেয়ে যানÑ অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি...। গান শেষে আবারও নৃত্য। নাচের ভাষায় যুদ্ধদিনের স্মৃতি তুলে ধরতে আসেন শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, ‘জয় মা’ ব’লে ভাসা তরী’ গানের সঙ্গে নাচেন নাচের শিক্ষক। বিশিষ্ট শিল্পীর একক পরিবেশনা। কিন্তু মঞ্চটি তিনি এত সুন্দর ব্যবহার করেন যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। চন্দনা মজুমদারের, আহা, কী দরদী কণ্ঠ! লোক গানের অনন্য সাধারণ শিল্পী বিজয়ের দিনে বেদনায় ভাসান শ্রোতাদের। বাঙালীর আত্মত্যাগের কথা তৃণমূলের সুরে প্রকাশ করেন তিনি। সুরে সুরে বলে যানÑ এই না বাংলাদেশের গান গাইতেরে দয়াল/ দুঃখে আমার পরান কান্দে রে...। গানের পর নাচ নিয়ে আসে নৃত্যম নৃত্যশীলন কেন্দ্র। ‘আমরা তো উজ্জ¦ল সূর্য’ গানের সঙ্গে নাচেন এক ঝাঁক শিল্পী। জাগো আর্ট সেন্টারের শিল্পীদের নৃত্য নদী মাতৃক বাংলাদেশ ও লোক সংস্কৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গানটিও ছিল বিপুল জনপ্রিয়। গ্যালারি ভর্তি দর্শকও সুর মিলিয়ে গান, কলকল ছলছল/নদী করে টলমল/ঢেউ ভাঙে ঝড় তুফানেতে/নাও বাইওনা মাঝি বিশম দৈরাতে...। বিজয় উৎসবে ছিল ব্রতচারী নৃত্যের ব্যতিক্রমী পরিবেশনা। ‘বাংলা মার দুর্নিবার আমরা তরুণ দল’ গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন একদল শিল্পী। উৎবের শেষ অংশে এসে মঞ্চে ওঠেন স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী শাহিন সামাদ। বিশিষ্ট এই শিল্পী গেয়ে শোনান তার নতুন একটি গান ‘এই পৃথিবীটা যদি হয়’। অনুষ্ঠানে নাচ গানের পাশাপাশি ছিল কবিতা। সৈয়দ শামসুল হকের ‘ব্রহ্মপুত্রের প্রতি’ আবৃত্তি করেন লিয়াকত খান। সঙ্গে ছিল নৃত্যানন্দের কোরিওগ্রাফি। কবিতার সঙ্গে এমন কোরিওগ্রাফি মুগ্ধ হয়েই উপভোগ করেন দর্শক। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল আরও বেশি কিছু পরিবেশনা। বৈকালিক পরিবেশনায় বাঙালী, বাঙালীর সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রধান বিষয়। গান কবিতা নৃত্যের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রতি অনুরাগের কথা জানান শিল্পীরা। বিজয় দিবসে এখন যে কর্পোরেট আগ্রাসন, অন্যের আচার, যে হৈ হুল্লোড়, তাল লয় ছন্দের বাইরে গিয়ে যে চিৎকার, তার বিপরীতে দেশপ্রেমে উজ্জ্বল একটি বিকেল উপহার দেয় ছায়ানট। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ শুধু ছায়ানটের পক্ষেই সম্ভব।
×