ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দীপংকর গৌতম

তারাকান্দরের গণহত্যা পাক বর্বরতার অজানা অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

তারাকান্দরের গণহত্যা পাক বর্বরতার অজানা অধ্যায়

মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলন। অযুত বছর ধরে মানুষের কাক্সিক্ষত সাধ- স্বাধীনতা। এ জন্য বাঙালী লড়েছেও বহুদিন বহুকাল। মুক্তি সংগ্রামের শুরু তাই ১৯৭১ সালে নয়। কৈবর্ত বিদ্রোহ থেকে তেভাগা, টংক নানাকার, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বা মীর নিসার আলী তিতুমীরের সংগ্রাম-স্বাধীনতা যুদ্ধের থেকে আলাদা কিছু নয়। মানুষ স্বাধীনতার লক্ষ্যে যুগের পর যুগ লড়াই সংগ্রাম করে আসছিল। ১৯৭১ সাল ছিল যার শেষ পরিণতি। এই পরিণতির শুরু হয়েছিল একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাত্রি থেকে। অপারেশন সার্চলাই নামের গণহত্যাকে সফল করতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মেতে ওঠে হত্যা, খুন ও ধর্ষণের নারকীয় খেলায়। নির্মম গণহত্যায় মেতে ওঠে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্যাম্প স্থাপন করে চালায় হত্যাযজ্ঞ এবং অত্যাচার-নির্যাতন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস। তারা পাকিস্তানী সেনাদের সাহায্য করার জন্য শুধু হুকুমের অপেক্ষা করত। আস্থাভাজন দালাল হওয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। গোপালগঞ্জ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) রাজনৈতিকভাবে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর জš§ভূমি বলে এই এলাকা এবং এলাকার মানুষ পাকিস্তানীদের বড় টার্গেট ছিল। এখানে যুদ্ধের নৃশংসতা যেমন বীভৎস ছিল, তেমনি প্রতিরোধও ছিল ইতিহাস খ্যাত। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতন এ অঞ্চলে পাশবিকতার যেকোন মাত্রাকেই হার মানিয়েছিল। পাকিস্তানী বর্বরবাহিনী এ অঞ্চলের মুক্তিসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মোটেও কায়দা করে উঠতে পারছিল না। এ কারণে পাকিস্তানী বর্বরেরা এ অঞ্চলে তাদের অপারেশন কে বেশি ভয়াবহ করতে তুলতে মরিয়া ছিল। বেসামরিক লোকদের হত্যা- এত নারকীয় করে তোলা হতো যা দিয়ে তারা মুক্তিসেনাদের ভীতি প্রদর্শন করতে চাইত। একাত্তরের শেষদিকে সমগ্র গোপালগঞ্জ পাকিস্তানী সৈন্যদের মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। এ কারণেও পাকিস্তানী বাহিনী গোপালগঞ্জের ওপর ছিল খুবই ক্ষিপ্ত। তাদের একের পর এক নাকানি চোবানি ও পরাজয় তাদের হিংস্র করে তুলেছিল। যে জন্য তারা মানুষ পেলেই কোন কথা ছাড়াই হত্যার উৎসবে মেতে উঠত। বধ্যভূমি তৈরি করায় উঠেছিল তাদের নৈমিত্তিক ঘটনা। তারা প্রায় প্রতিদিন এক-একটি সবুজ-শ্যামল, ছায়াঢাকা পাখি ডাকা জনপদকে শ্মশানে পরিণত করত। তাদের হিংসার আগুনে সবুজের এই উপত্যকা খাক হয়ে গিয়েছিল। বাতাসে ছিল আতঙ্ক আর বারুদের গন্ধ। তারা এক-একটি জনপদকে ভাগাড়ে পরিণত করেছিল। নয় মাসের যুদ্ধের সেই আতংকিত প্রহরবেষ্টিত রাত শেষ হতো, আতংক আর আর্তনাদে। দিনের শুরুও হতো সেভাবেই। সারা দেশকে একটা বধ্যভূমিতে পরিণত করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীই শুধু না। ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস কখনো বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠত। এ কারণেই মাত্র ৯ মাসে তারা ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যা করতে পেরেছিল। তাদের ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ৪ লাখের বেশি বাঙালী নারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন ভয়াবহ গণহত্যা দুনিয়ার আর কোথাও সংঘটিত হয়নি। এই গণহত্যা ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত মাইলাই গণহত্যা বা চেক প্রজাতন্ত্রের লিডিস গণহত্যার চেয়েও ভয়াবহ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদ সংগ্রহের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রথম তিন মাসেই এখানে মাইলাই ও লিডিসের মতো শখানেক বড় গণহত্যার তথ্য জানতে পারেন নিউজউইকের এক সাংবাদিক। ডেট লাইন তারাকান্দর মধুমতি পাড়ের জেলা গোপালগঞ্জ। ছায়াসুনিবিড়, শান্তির নীড় জেলার ধান ও জিওল মাছের গোলা খ্যাত কোটালীপাড়া উপজেলা। বিল অধ্যুষিত এ জনপদের কান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম তারাকান্দর। অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের অবস্থান তারাকান্দ বিলের পাড়ে। গ্রামের কাছেই মধুমতির শাখা নদী ঘাঘর। ঘাঘর নদী ঘেঁষেই গোপালপুর গ্রাম। অদূরে কুরপালা। রাজাকার অধ্যুষিত গ্রাম বলে এ গ্রামের কাছ দিয়ে কেউ যেত না ১৯৭১ সালে। বলে জানান, সত্তরোর্ধ রমজান মিয়া। কুরপালা মাদ্রাসায় হার্মাদ পাকিস্তানীদের ক্যাম্প ছিল। এখান থেকে সব নারকীয় ঘটনা চালানো হতো। পাশের গ্রাম গোপালপুরেও পাকিস্তানী সামরিক হার্মাদরা তাদের এ দেশীয় দালালদের বাড়িঘরে যেত। গোপালপুর ও কুরপালার ঘাতক দালালরা তারাকান্দর, ধারাবাসাইল, কান্দি মাচারতারা যে হিন্দু মালাউন অধ্যুষিত সেটা বোঝাতে পেরেছিল সহজেই। তাই শুরু থেকেই এ গ্রাম ছিল আক্রমণের জন্য নির্ধারিত। কুরপালা বা গোপালপুর থেকে তাকালে দেখা মেলে তারাকান্দর গ্রামের। বিলের মধ্যে ডুবে থাকা গ্রাম। দূর থেকে ধূ ধূ করে। মাঠ ভরা ধান। একটু বাতাসেই আদূরে আমন ধান নুয়ে পড়ে। ধানসিঁড়ি হয়ে যায়। শিশু ধানের ক্ষেত দেখে জীবন জুড়িয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে এ গ্রামের মানুষেরা বুঝতো যে গোপালপুর, কুরপালার এক শ্রেণীর জালিয়াতরা তাদের বাড়িঘর দখল করতে চাইতে পারে। কিন্তু অন্য সময়ের মতো এবারও তারা প্রতিরোধ করবে। মেশিন গান, এলএমজি বা রাইফেলের শক্তি তারা জানে না। তারা তাদের শক্তির কথা জানত। তাই ঢাল, সড়কি, কাতরা, বল্লম, রামদা নিয়ে প্রস্তুতি নিত শত্রুদের প্রতিরোধ করতে। তারপর দিন এলো। শুয়োরমুখো দিন বাংলা ১৯ জ্যৈষ্ঠ। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কান্দি ইউনিয়নের ভূমিজ মানুষেরা দেশীয় অস্ত্রের মজুত গড়ে তোলে তারাকান্দর ‘বালা বাড়ি’ তে। এখান থেকেই নেয়া হচ্ছিল প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ। ততদিনে কুরপালায় মিলিটারি ক্যাম্প বসেছে, কাকডাঙ্গা-গোপালপুরে রাজাকার, আলবদর বাহিনী সমগ্র কোটালীপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। মাঝবাড়ি, হিরনে পিস কমিটি হয়েছে। তারাশীর বেবাজিয়া সম্প্রদায় নিম্নবর্গের বিধায় তারা চূড়ান্ত হামলার চেষ্টা করছে। যে যার মতো লুটপাট ডাকাতি করছে হিন্দুবাড়িতে। স্থানীয় লোকের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থান থেকে আশ্রয় নিতে আসা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ওই বাড়িতে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিতে আসছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। এ খবর যায় পার্শ্ববর্তী গোপালপুর পূর্ণবতী গ্রামের রাজাকার-আলবদরদের কাছে। এরপর তারা কোটালীপাড়া থানা থেকে তিনটি গানবোটে ঘাঘর নদী দিয়ে ১১ পাকিস্তানী সেনা গোপালপুর আসে। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে অপেক্ষা করছিল স্থানীয় দোসর রাজাকার আহমদ চেয়ারম্যান, আফতাব উদ্দিন, বারেক মাস্টার, সোবহানসহ আরো অনেকে। তাদের ইশারায় পাকিস্তানী বাহিনী প্রস্তুতি নেয় তারাকান্দর আক্রমণের। একপর্যায়ে ভারি মেশিনগানের গুলি ও মর্টার শেল ছুড়তে থাকে তারাকান্দরের দিকে। মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় এলাকা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কার্তিকের ঝরা ধানের মতো পড়ে থাকে মানুষের লাশ। মাত্র এক কিলোমিটার ব্যবধানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হাজার খানেক মানুষ পাকিস্তানী বাহিনীর ভারি অস্ত্রের সামনে আর টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। অস্ত্র রেখে পেছন দিকে যে যেভাবে পারে পালাতে থাকে। এই সুযোগে স্থানীয় রাজাকার, আলবদররা পাকিস্তানী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে পড়ে তারাকান্দর গ্রামে। প্রতিরোধকারী যোদ্ধাদের ফেলে আসা রামদা, কুড়াল, বল্লম দিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা। বেলা ১১টায় শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে হত্যাযজ্ঞ। শহীদ হন দুই শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ। সেই নৃশংসতার নীরব সাক্ষী পুরো তারাকান্দর গ্রাম, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ এবং সেই সময় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য। তারাকান্দর গ্রামের নটোবর রায়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বাড়ির সামনে পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একটা ডোবার মধ্যে পালিয়েছিল নয়জন। তাদের কাউকে গুলি করে, কাউকে কুপিয়ে, চোখ তুলে নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা। তাদের মধ্যে ডহরপাড়া গ্রামের নরেন দাঁড়িয়া, তাঁর স্ত্রী, মা এবং চিন্তা দাঁড়িয়া ও তার ছেলে ছিল।’ এ ছাড়া ছিল দর্শন রায়, তার স্ত্রী ও মেয়ে এবং মনমোহন রায়ের ছেলে হরলাল রায়। সেই ভয়াল দৃশ্যের কথা এখনো মনে পড়লে যেন আঁতকে ওঠেন তিনি। তারাকান্দর খালের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণু রায়ের স্ত্রীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। এভাবে তারাকান্দর বৈদ্যবাড়ি, রায়বাড়ি, বিশ্বাসবাড়ির দক্ষিণ পাশের মাঠে ও পুকুরপাড়ে সারি সারি লাশ দেখা যায়। যে শহীদদের লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় তাদের মধ্যে রাধিকা বৈদ্য, বিশ্বনাথ বৈদ্যর স্ত্রী পরিষ্কার বৈদ্য এবং তার দুই মেয়ে, পচু ম লের স্ত্রী, কুটিশ্বর ম ল, লক্ষ্মণ বিশ্বাস, দীনেশ হালদার, পোকাই, কালু বালা, বিমল ঢালীর মা, মহেন্দ্র বৈদ্য, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে এবং রাজেশ বাড়ৈর স্ত্রী। এ ছাড়া নাম না-জানা এলাকা ও এলাকার বাইরের বহু লোককে সেদিন এই তারাকান্দর বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এর পাশাপাশি নারী নির্যাতন, লুটপাট ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা। মন্দিরে, বাড়ির মধ্যে, পথে-ঘাটে ছড়িয়ে ছিল রাশ আর লাশ। সেই যুদ্ধের একজন অকুতোভয় যোদ্ধা জগদীশ বৈদ্য। বয়স তার ৭০ ছুঁই ছুঁই। শত্রুর তাড়া খেয়ে ওইদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন একটা কচুরিপানা ভর্তি ডোবার মধ্যে। তার এক হাতে রামদা, অন্য হাতে বল্লম (এক ধরনের দেশীয় অস্ত্র)। শত্রুরা তার হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে একই উপর্যুপরি কুপিয়ে চলে যায়। কিন্তু ৩৪টি কোপ খেয়েও বেঁচে আছেন জগদীশ বৈদ্য। জীবনের নিরাপত্তার জন্য পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের বাসুন্দিয়া আশ্রয় নেন। সেখানে এখন দিনমজুরি করে সংসার চলে তার। ভিয়েতনামের মাইলাই বা চেকের বধ্যভূমি ও গণহত্যার চেয়ে তারাকান্দ কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত জগদীশ বৈদ্যরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। কোনো শহীদের নাম কেউ মনে রাখেনি। তাদের নাম ঠাঁই পায়নি ইতিহাসেও। এমনকি তারাকান্দর এই গণহত্যার কথা মানুষ জানেও না। আজ পর্যন্ত এ শহীদদের নামে কোনো স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। গোপালগঞ্জ জেলার বৃহত্তর বধ্যভূমি এখন তারাকান্দরে, কিন্তু এ ইতিহাস সবার অজানা। স্বাধীনতার এত বছর পরও এই গণহত্যার ইতিহাস অজানা থেকে গেছে। ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই মেলেনি তারাকান্দরে গণহত্যার। এই শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা না হলে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে না একাত্তরের এই বীরত্বগাথা। স্বাধীনতার চেতনা বিকাশে এ কাজটি খুবই জরুরী।
×