ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

অভ্যাস ৭ ॥ করাতটা ধার দাও

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

অভ্যাস ৭ ॥ করাতটা ধার দাও

(চতুর্থ পর্ব) ‘করাত ধার দেয়া’ নিয়ে তিন সপ্তাহ ধরে লিখছি। আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই সবচেয়ে অমূল্য অভ্যাস, যা আমাদের নতুন করে তৈরি করতে পারে, আমাদের শাণিত রাখতে পারে। আপনার জীবনের চারটি দিককে ব্যালেন্স করতে পারলে আপনি আপনার করাতটি আজীবন ধার দিয়ে রাখতে পারবেন। সেগুলো হলো শারীরিক, আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং সামাজিক-আবেগ। ড. স্টিফেন কোভের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে তার সপ্তম অভ্যাসটি হলো ‘শার্পেন দি স’Ñ বাংলায় আমি যাকে বলছি ‘করাতটা ধার দাও’। গাছ কাটলে করাত ভোঁতা হবেই। এটার যে ধার চলে গেছে সেটা অনেকেই বুঝতে পারি না। কিন্তু সেই ভোঁতা করাত দিয়েই গাছ কাটার চেষ্টা করি। পরিশ্রম হয় বেশি, ফলাফল পাওয়া যায় কম। তাই করাত ধার দেয়াটা জরুরী। করাত ধার দেয়ার অভ্যাসটি হলো সপ্তম অভ্যাস। এই অভ্যাসটি মূলত অন্য ছয়টি অভ্যাসকে কাজ করতে সাহায্য করে। এই অভ্যাসটি না থাকলে একটা সময়ে গিয়ে আপনার বাকি অভ্যাসগুলো ভেঙ্গে পড়বে। বাকি ছয়টি অভ্যাসকে সচল রাখার জন্য এই অভ্যাসটি গড়ে তুলুন। গত সপ্তাহগুলোতে লিখেছিলাম শারীরিক, আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং সামাজিক বিস্তার নিয়ে। আজকে লিখছি এর উপসংহারটুকু। অন্যদের স্ক্রিপ্ট পাল্টে দিন আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ মানুষই সামাজিক আয়নাটাকে খুব ভয় পায়। সমাজ তাকে কিভাবে দেখে, তাদের ধ্যান-ধারণা, তার চারপাশের মানুষের চোখগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। খুব কম মানুষ আছে যারা এই সামাজিক আয়নাকে ভেঙ্গে নিজের মতো জীবন পরিচালনা করতে পারেন। যেমনÑ হলিউড-বলিউডের কিছু নায়ক-নায়িকা, বিভিন্ন দেশের শিল্পী, লেখক কিংবা দার্শনিক। এই সংখ্যাগুলোকে বাদ দিলে আমরা সবাই কম-বেশি সামাজিক আয়নার বেড়াজালে আবদ্ধ। তাহলে সামাজিক আয়না তৈরি করে কে? আমরাই তো। সবাই মিলে আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর জন্য আয়না তৈরি করে দিয়েছি এবং তার প্রতিফলনেই সে পরিচালিত হয়। আমরা অন্য মানুষকে প্রভাবিত করতে পারি। তাই আমাদের একটি বাড়তি দায়িত্ব হলো অন্য মানুষের ভেতর যে প্রোএ্যাক্টিভ বিষয়টি আছে সেটা তাকে বুঝতে দিতে পারি। সে যে একজন দায়িত্বশীল মানুষ সেটা তাকে আমরা বুঝিয়ে দিতে পারি। আমরা তার ভেতরের স্ক্রিপ্টটি পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারি। আমরা তাকে একজন নীতিবান, স্বকীয়, মূল্যবান মানুষ হিসেবে তৈরিতে সাহায্য করতে পারি। আর আপনি যেহেতু বিশ্বাস করেন এই গ্রহে সম্পদের পরিমাণ যথেষ্ট (এবানডান্স মেন্টালিটি), তাই কাউকে এটুকু সাহায্য করলে আপনার কিছু কমে যাবে না। বরং এই চর্চার ফলে আপনারও উপকার হবে। কারণ অন্য মানুষগুলোও তখন আপনাকে একটি ইতিবাচক ফিডব্যাক দিতে শুরু করবে। আপনার জীবনে কি এমন ঘটনা কখনও ঘটেছে যে, কেউ একজন আপনাকে বিশ্বাস করেছে, যখন আপনার নিজের ওপরই নিজের বিশ্বাস তৈরি হয়নি? আপনাকে কোন একটা কাজ দিয়ে, কিংবা কোন একটা বড় দায়িত্ব দিয়ে? হয়েছে কখনও এমন? যদি হয়ে থাকে তাহলে এবারে ভেবে দেখুন তো আপনার জীবনে সেটার প্রভাব কেমন? আপনাকে কি পাল্টে দেয়নি সেই ঘটনাটি? আসলে ওই মানুষটি আপনার স্ক্রিপ্ট তৈরি করে দিয়েছিল। জীবনের এই ধাপে এসে ব্যক্তিগতভাবে আমি পেছনের দিকে তাকালে দেখতে পাই বেশ কিছু মানুষ যারা আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, আজও তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যদি তাই হয় তাহলে আপনি নিজে কেন একই কাজটি করছেন না? কারও জীবনের স্ক্রিপ্ট পাল্টে দিচ্ছেন না? আমাদের সামাজিক আয়নাটা খুব ভয়াবহ। এটা যে কোন মানুষের সাহসকে নষ্ট করে দিতে পারে। এমন অসংখ্য মানুষ আছে যারা সামাজিক এই আয়নার জেলখানায় পড়ে গিয়ে নিচু স্তরের জীবনযাপন করছেন; কিন্তু আপনার উৎসাহ তাদের উপরের দিকে নিয়ে আসতে পারে। আপনি যদি কাউকে সেভাবে বিশ্বাস করেন, কারও ওপর বিশ্বাস রাখেন তারা পাল্টে যেতে পারে। আপনি তাদের সহমর্মিতা দিয়ে শুনতে পারেন এবং তাদের ক্ষমতাশালী করে তৈরি করতে পারেন। এর একটি সুন্দর উদাহরণ আছে ‘ম্যান অব লা মাঞ্চা’ নামক গীতিনাট্যে (১৯৬৫ সালে নির্মিত এই গীতিনাট্য নিউইয়র্কের ব্রডওয়েতে ২৩২৮ বার প্রদর্শিত হয়)। এর গল্পটা খুব সুন্দর। একজন মিডিয়াভাল নাইটের (সুপ্রশিক্ষিত যোদ্ধা) একবার এক পতিতার সঙ্গে পরিচয় হয়। পতিতাদের জীবন কেমন সেটা অনুমান করতে পারেন। তার জীবনে আসে অসংখ্য পুরুষ, তাকে ব্যবহার করা যায়; কিন্তু পাশে বসানো যায় না- এই সামাজিক আয়নায় আমরা তাকে বিচার করি। কেউ কেউ থু থু করি। কেউ মায়া করি। এর বাইরে ইতিবাচক আর কিছুই আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু সেই যোদ্ধা ছিলেন একজন কবি। তিনি পতিতার ভেতর ভিন্ন কিছু খুঁজে পেলেন, খুব সুন্দর কিছু, মনোরম কিছু। কবি মেয়েটির ভেতর এক ধরনের অন্তর্নিহিত শক্তি দেখতে পান এবং বারবার তিনি সেটা প্রকাশ করেন। কবি তাকে একটি নতুন নাম দেনÑ ডালশিনিয়া। নতুন নাম তাকে নতুনভাবে পরিচিত করে তোলে। নতুন দিগন্ত খুলে যেতে থাকে। প্রথম দিকে মেয়েটি বিষয়টি মেনে নিতে পারছিল না। তার পুরনো স্ক্রিপ্ট তাকে পরিচালিত করার চেষ্টা করছিল। কবিকে তার বাস্তববিবর্জিত ফ্যান্টাসির মানুষ মনে হয়েছিল। কিন্তু কবি সব সময় একই ব্যবহার করেছেন। তার ব্যবহার ও বিশ্বাসে কোন পরিবর্তন নেই। কবি শর্তহীন ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকেন এবং একটা সময়ে তার পুরনো স্ক্রিপ্ট পাল্টাতে শুরু করে। এটা তার ভেতর থেকে প্রকৃত মানুষটাকে বের করে নিয়ে আসে। তার ভেতরের সম্ভাবনাকে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে। মেয়েটি সাড়া দিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে মেয়েটি তার জীবনযাপন প্রক্রিয়া পাল্টাতে শুরু করে। সে নতুনভাবে সবকিছু দেখতে ও বিশ্বাস করতে শুরু করে। অনেকটা সময় কেটে গেছে। কবির বয়স হয়েছে। মেয়েটি তার পুরনো জীবনে ফিরে যেতে শুরু করে। কবি তার মৃত্যুশয্যায় তাকে ডেকে পাঠান। তাকে সেই বিখ্যাত সুন্দর গানটি শোনানÑ ‘দি ইমপসিবল ড্রিম’। মেয়েটির চোখের দিকে তাকান; তারপর তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন, ‘কখনই ভুলে যেও না, তুমি ডালশিনিয়া।’ এই একই কাজটি আমরা স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, সহকর্মী, অফিসের স্টাফ- সবার সঙ্গে করতে পারি। আমরা তাদের অতীতকে মনে না রেখে তার ভেতর যে ভবিষ্যতের বীজ বোনা রয়েছে সেটাকে লালন করতে পারি। তাদের বিশেষ কিছু দিয়ে ‘লেবেল’ না করে তাদের একটি নতুন জীবন উপহার দিতে পারি। তখন তারা একজন স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী, স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষে পরিণত হতে পারে। জার্মানির লেখক গোথে শিখিয়েছেন, ‘একজন মানুষ যেমন, তার সঙ্গে যদি তেমন ব্যবহারটাই কর, তাহলে সে আগের মতোই থাকবে। একজন মানুষের সঙ্গে যদি এমন ব্যবহার কর যা সে হতে পারে, কিংবা তার হওয়া উচিত, কিছুদিন পর সে ওটাই হয়ে যাবে এবং যা তার হওয়া উচিত ছিল।’ আপনি যদি আপনার সন্তানের সঙ্গে প্রতিদিন এমনভাবে ব্যবহার করেন যে, সে একজন ভাল মানুষ দেখবেন সে একদিন ভাল মানুষই হয়ে যাবে। উর্ধগামী প্যাঁচ বাংলাটা একটু কঠিন ঠেকছে। ইংরেজীতে একে বলা হয়েছে ‘আপওয়ার্ড স্পাইরাল’। একটা ঘূর্ণির প্যাঁচের মধ্য দিয়ে আপনি উপরে উঠে যাবেন- এমন একটা তত্ত্ব এবং প্রক্রিয়া। এটা আপনাকে প্রতিনিয়ত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে। আপনি যদি এই ঘূর্ণির ভেতর দিয়ে ক্রমাগত উপরের দিকে উঠে যেতে চান তাহলে আপনাকে মানবজীবনের আরেকটি বিষয়কে আয়ত্তে আনতে হবেÑ সেটা হলো আপনার ‘বিবেক’। এই একটি মাত্র বিষয় আপনাকে উপরের দিকে টেনে তুলতে সাহায্য করবে। বিবেক হলো মানুষের এমন একটি প্রতিভা যা দিয়ে সে বুঝতে পারে কোন্ কাজটি সঠিক নীতির সঙ্গে যায়, আর কোন্গুলো সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আর যখন আমরা সেটা বুঝতে পারি এবং বিবেক সঠিকভাবে তৈরি হয়ে থাকে, তা আপনাকে উপরে টেনে তুলবেই। একজন খেলোয়াড়কে যেমন নার্ভ নিয়ে শিক্ষা দেয়া জরুরী, একজন বুদ্ধিজীবীর যেমন মনের শিক্ষাটা জরুরী, একইভাবে একজন প্রোএ্যাক্টিভ হাইলি-ইফেক্টিভ মানুষের জন্য ‘বিবেকের’ শিক্ষাটা খুব জরুরী। বিবেক তৈরির জন্য শিক্ষা এবং ট্রেনিংয়ের জন্য অনেক বেশি মনোযোগ প্রয়োজন, অনেক বেশি ভারসাম্যপূর্ণ শৃঙ্খলার প্রয়োজন এবং পরিশেষে একটি সৎ জীবনযাপন প্রয়োজন। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণাকারী সাহিত্য পাঠ, মানুষের কল্যাণ নিয়ে ভাবনা করা এবং সর্বোপরি একটা ঐকতান রেখে চলতে পারা শেখা। জাঙ্ক খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম না করা যেমন একজন ক্রীড়াবিদকে নষ্ট করে দিতে পারে, তেমনিভাবে অশ্লীল, স্থূল কিংবা পর্ণোগ্রাফি মানুষের ভেতরের উচ্চমার্গীয় বিষয়গুলোকে মেরে ফেলে অন্ধকার বিষয়গুলোকে জাগিয়ে তোলে। তখন আর বিবেক কাজ করে না। আপনি যখন একজন সচেতন মানুষ হবেন তখন আপনাকে অবশ্যই জীবনের উদ্দেশ্য এবং সেটাকে যাপন করার কিছু নীতিমালা ঠিক করে নিতে হবে। অন্যথা একটা খালি জায়গা তৈরি হবে এবং আমরা আমাদের সচেতন জীবনকে হেরে যেতে দেখব সেইসব প্রাণীর কাছে যারা কেবল টিকে থাকা এবং বংশ বিস্তার করার জন্য বেঁচে থাকে। মানুষ হিসেবে আপনিও সেই প্রাণীদের দলে থাকতে পারেন। যেসব মানুষ এমনভাবে টিকে থাকে তারা আসলে বেঁচে থাকে না, তাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়। তারা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল জীব, তারা জানেই না যে, তাদের ভেতর কী এক দারুণ ক্ষমতা ছিল, যা সুপ্তই রয়ে গেছে। সেই ক্ষমতা তারা কখনই ব্যবহার করতে পারে না। এই গুণটি তৈরি করার কোন শর্টকাট পদ্ধতি নেই। ফসলের সেই সূত্র এক্ষেত্রে প্রযোজ্যÑ তুমি সেই ফসলই ঘরে তুলবে যা তুমি বপন করেছ; এর কমও নয়, এর বেশিও নয়। একইভাবে সুবিচারের বিধিও অপরিবর্তনীয়। আমরা প্রতিনিয়ত যত বেশি সঠিক নীতির কাছাকাছি যেতে পারব আমাদের সিদ্ধান্ত তত বেশি ভাল হবে। আমাদের বিবেককে যত বেশি শেখাতে পারব এবং যত বেশি তাকে মেনে চলব আমরা এই ঘূর্ণির তত বেশি ওপরে উঠে যাব এবং প্রতিনিয়ত ওপরে ওঠা অব্যাহত রাখতে আমাদের প্রতিনিয়ত শিখতে হবে, অঙ্গীকার করতে হবে এবং সেটা করতে হবে। ইংরেজীতে আমরা বলতে পারিÑ লার্ন, কমিট এ্যান্ড ডু। ক্রমাগত আপনি শিখবেন, প্রতিজ্ঞা করবেন এবং সেটা করে ফেলবেন। শিখবেন, প্রতিজ্ঞা করবেন এবং কাজটি করবেন। ২৬ নবেম্বর ২০১৬ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×