ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৯ নভেম্বর ২০১৬

সবার মধ্যেই কি এক টুকরো ট্রাম্প জায়গা করে নিয়েছেন?

শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন রাজনীতিবিদের নাম তো আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। এ রকম প্রশ্ন করার একটা কারণ আছে। কয়েক বছর আগে এ প্রশ্ন করলে মির্জা ফখরুল বলতেন, তিনি কে? বাংলাদেশে তো একজনকেই চিনি, তিনি জিয়াউর রহমান। তার সঙ্গে অনেকে একমত হতেন। গত কয়েক বছর আওয়ামী লীগের কল্যাণে শেখ মুজিবুর রহমান নামটা মোটামুটি সবাই জানে। মির্জা ফখরুলদের অনেকে এখন তাকে বঙ্গবন্ধুও বলেন। বাংলাদেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এতেই স্পষ্ট হয়। আওয়ামী লীগাররা ভীষণ ভক্ত বঙ্গবন্ধুর। তাদের সামনে একটু সমালোচনা করে দেখুন বঙ্গবন্ধুর, এখুনি আপনাকে দেশবিরোধী, লেফটি, বিএনপিপন্থী বলতে দ্বিধা করবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের জীবনেতিহাস বা আদর্শের মৌল বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করতে বলুন, আমি নিশ্চিত অধিকাংশই তা পারবে না। আমাদের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের এটিও একটি বৈশিষ্ট্য। তা সেই বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীটা উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। সেখানেও একটি ঘটনার বর্ণনা আছে। ১৯৫৪ সালের মে মাস। মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে তিনি লাট ভবনে গেছেন। শপথ নেয়া শেষ হতেই খবর পেলেন, আদমজী জুট মিলে বাঙালী-অবাঙালী শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা বেধেছে। স্বয়ং ফজলুল হক সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হলেন আদমজী। লাট ভবনের সামনে তখন জনতার ভিড়। শেখ মুজিবকে নিয়ে তারা মিছিল করবে। তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে রওয়ানা হলেন তিনি। আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। ফজলুল হক তার জন্য একটা লঞ্চ রেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি পৌঁছলেন আদমজী। লিখেছেন তিনি, ‘আমার বড় অসহায় মনে হল। আমার সাথে মাত্র দুইজন আর্মড পুলিশ।... এক গাছতলায় আমি আস্তানা পাতলাম। মিলের চারটা ট্রাক আছে, একটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু সংখ্যক লোক পাওয়া গেল, তাদের সাহায্যে যারা মারা গেছে তাদের রেখে আহত লোকগুলিকে এক জায়গায় করে পানি দিতে শুরু করলাম। আমার দেখাদেখি কয়েকজন কর্মচারীও কাজে হাত দিল। এই সময় মোহন মিয়া সাহেব এসে উপস্থিত হলেন।... মোহন মিয়া ও আমি সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিনশতের মতো আহত লোককে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছিলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সমস্ত বাঙালী জনসাধারণ জমা হচ্ছিল মিল আক্রমণ করার জন্য তাদের কাছে গিয়ে আমি বক্তৃতা করে তাদের শান্ত করলাম। তারা আমার কথা শুনল। যদি তারা সঠিক খবর পেত তাহা হলে আমার কথা শুনত কিনা সন্দেহ ছিল। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সমস্ত এলাকা ঘুরে মৃত লাশের হিসাব করলাম একটা একটা করে গণনা করে, তাতে পাঁচশতের উপর লাশ আমি স্বচক্ষে দেখলাম। আরও শ’খানেক পুকুরের মধ্যে আছে তাতে সন্দেহ নেই।’ ঢাকায় ফেরার পর কেবিনেট মিটিং। শেষ হলো একটায়। বের হয়ে দেখেন কয়েকজন কর্মী অপেক্ষা করছেন, তারা খবর দিলেন রাস্তায় বাঙালীরা ভিড় করছে যে কোন সময় দাঙ্গা লেগে যেতে পারে। ‘...কয়েক জনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ...গাড়ি থেকে নেমে সকলকে বুঝাতে লাগলাম এবং অনেকটা শান্ত করতে সক্ষম হলাম। রাত চার ঘটিকায় বাড়িতে পৌঁছলাম। শপথ নেওয়ার পরে পাঁচ মিনিটের জন্য বাড়িতে আসতে পারি নাই। আর দিনভর কিছু পেটেও পড়ে নাই। দেখি রেণু চুপটি করে না খেয়ে বসে আছে, আমার জন্য।’ এ ঘটনাটা কেন লিখলাম? আদমজীতে দাঙ্গা বেধেছে। ঠিক আছে। কিন্তু শপথ নিয়ে সবার হৈ-হুল্লোড় করার কথা। এখন তো প্রচলিত নিয়ম তাই। না পুরো কেবিনেট চলে গেল আদমজী। যে মোহন মিয়া পরে অনেকের অপছন্দের পাত্র হয়েছিলেন সেই মোহন মিয়া ও শেখ মুজিব দাঙ্গারত মানুষদের ৮/৯ ঘণ্টা ধরে শুধু সেবা শুশ্রƒষা নয়, নিরাপত্তাও দিলেন। সারারাত ঘুরে ঘুরে উত্তেজনা প্রশমন করলেন। এর কারণ বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাজনীতির মূল ছিল তখন মানুষের জন্য ভালবাসা। মানবিক বোধ। বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যা বিশ্বাস করি তাই বলি, তাই করি। আরও পরের একটি ঘটনা। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার সময়। তাজউদ্দীন আহমদ তখন খুব সম্ভব প্রচার সম্পাদক। ‘পূর্ববঙ্গ রুখিয়া দাঁড়াও’ লিফটেটটি কর্মীর মতো বিলি করতে গিয়ে গ্রেফতার হলেন। আরও পরে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়ার সময়, তার নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের আদর্শ থেকে একবিন্দু নড়েননি, প্রতিজ্ঞা মতো মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় পরিবার পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। সাধারণের সঙ্গে থেকেছেন। এদের নাম শত চেষ্টা করে ইতিহাস থেকে বাদ দেয়া যাচ্ছে না। সাধারণের মন থেকেও বাদ মুছে ফেলা যাচ্ছে না। রাজনীতি=মানুষের কল্যাণ, রাজনীতি=মানবিকতা, রাজনীতি=আদর্শ, রাজনীতি=বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ। তাদের সময় রাজনীতি মানেই ছিল তা। ॥ দুই ॥ নাসিরনগর, ফরিদপুর, সাটুরিয়ার ঘটনা পুরনো হয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ধারণা, সময় এই ক্ষত সারিয়ে দেবে, সমকালে একটু হৈ হুল্লোড় হবে। কিন্তু কোন ক্ষত একেবারে শুকিয়ে যায় না। নাসিরনগরের ঘটনা এখনও পত্রপত্রিকা, টিভি থেকে সরানো যায়নি। তবে, এত সংবাদপত্র, নানারকমের রিপোর্ট, নানা রকমের বিভ্রান্তি, অনেক পত্রিকা আক্রমণকারীদের নাম উল্লেখ করে না। নেতাদের সংশ্লিষ্টতা অস্পষ্ট রেখে দেয়। সাংবাদিক ও মালিকরাও তো মানুষ, উচ্চাকাক্সক্ষা আছে, স্বার্থ আছে, লোভ আছে। তবে, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকরা জনকণ্ঠের ওপর ভরসা রাখেন। আওয়ামী লীগারদের প্রিয় পত্রিকা প্রথম আলো। সুতরাং, নাসিরনগরে কারা কি করেছে তা জনকণ্ঠের পাঠকরা তাদের বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে পারেন। আমি এটি লেখার আগে রিপোর্টটি পড়ে দেখলাম, আমি যা লিখেছি তার সঙ্গে প্রতিবেদক রাজন ভট্টাচার্যের অনুভবের অমিল নেই। তিনি লিখেছেন, ‘আক্রান্ত হওয়া গ্রামের লোকজন বলছেন, জীবন থেমে থাকবে না। কোন না কোনভাবে ফের সচল হবে সংসারের চাকা। হয়ত সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণও মিলবে। কিন্তু শত শত বছরের সম্প্রীতির জনপদে মৌলবাদী হামলার ঘটনায় হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা কোন কিছু দিয়ে কি পূরণ সম্ভব? এক কথায় উত্তর- না। হয়ত তা আর কোন দিনই হবে না। এ ক্ষত থেকে যাবে চিরকাল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মৌলবাদী হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৫৮টি। ভাঙচুর হয়েছে ১৭টি মন্দির। মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা। হতদরিদ্র পরিবারের আর্থিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। তবে সাধারণ মানুষ বলছেন, সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হবে কয়েক কোটি টাকার বেশি। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা তালিকায় এ চিত্র উঠে এসেছে। তবে ৫২টি বাড়ি ভাঙচুরের কথা তাদের তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। [জনকণ্ঠ, ১৫.১১.২০১৬] ক্ষত সারবে না এ কারণে যে, যারা করেছে তাদের শাস্তি পাওয়া নিয়ে সন্দেহ আছে। জনকণ্ঠের বিশাল রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, এ ঘটনা ঘটিয়েছেন মাধবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আঁখি। আওয়ামী লীগের এই চেয়ারম্যান আঁখি স্বাভাবিকভাবেই তা অস্বীকার করেছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী- ‘স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, হামলার জন্য মাধবপুর থেকে ট্রাক ভাড়া করে সেখান থেকেই লোকজন সংগ্রহ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে এসব লোক জড়ো করা হয়। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামীর অনুসারী। মাধবপুর ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে ভাড়ায় দুটি ট্রাক সরবরাহকারী নুরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অন্তত ১৫টি ট্রাক মাধবপুর থেকে যায়। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে টাকা দেয়া হয়েছিল। ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তো আঁখি সাহেব। আঁখির ইউনিয়ন হরিপুরের বাসিন্দা এই ট্রাক মালিক বলেন, তার দুটি ট্রাকের ভাড়া দেয়া হয়েছিল দুই হাজার টাকা করে। আঁখির কর্মী দোকানদার জাহাঙ্গীর ও সুজন পাঠান মোটরসাইকেলে গিয়ে ট্রাকগুলো নিয়ে আসেন বলে জানান হরিপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক কর্মী। হরিণবেড় বাজারে আল-আমিন সাইবার ল্যাব ও স্টুডিওর সামনের দোকানি অমৃত বিশ্বাস বলেন, দোকান মালিক জাহাঙ্গীর বিএনপির রাজনীতি করেন। তবে ইউপি নির্বাচনের সময় আঁখির সঙ্গে ছিলেন। এখন চেয়ারম্যান আঁখির সঙ্গে তার সখ্য। রসরাজের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে ‘আসামিকে আটককারী’ হিসেবে যে পাঁচজনের নাম এসেছে তাদের মধ্যে শঙ্করাদহ এলাকার ইসমাইলও আঁখির অনুগত বলে জানান তিনি। চেয়ারম্যান আঁখি ট্রাক ভাড়ায় নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও জাহাঙ্গীর ও সুজন যে তার কর্মী তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কারা ট্রাক ধরাইছে আমি জানি না। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোন টাকা দেয়া হয়নি। হেজাবিদের সঙ্গে সমঝোতা করলে নাকি ভোটের বাক্স ভরে উঠবে। আঁখিদের কাছে বার্তা গেছে তাই। সে কারণে বন্ধুদের নিয়ে এ কাজটি তিনি করেছেন। তার সাধারণ সম্পাদকও প্রায় সে রকম বার্তা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা করেছেন, রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের কোন চিন্তা তাদের নেই। সেটি আমরা জানি। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি থেকে কোন নেতা সেটি ঘোষণা করেননি। আওয়ামী লীগের ডানপন্থীরা হেজাবিদের থেকে লেফটিদের বেশি ঘৃণা করে। তাদের অর্থাৎ প্রাক্তন বামপন্থী প্রেসিডিয়াম ও কর্মপরিষদে নেয়ায় অনেকে ক্ষুব্ধ। কিন্তু হেজাবি ও আঁখির সমর্থকরা শুধু প্রতিমা ভাঙ্গেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধুর ছবি [যাদের ঘরে ছিল] ভাঙচুর করেছে। (লেফটিরা এ কাজটি কখনও করেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার তারাই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন যারা আওয়ামী লীগে আছেন তারা আর লেফটি থাকবেন না বলেই তো আওয়ামী লীগে এসেছেন। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি বিকৃত/ভাঙচুরের ঘটনায় আগে মামলা হয়েছে। অন্যরা ভাঙলে হয়ত হত। কিন্তু হেজাবিরা ভাঙলে কেন হবে? চলবে...
×