ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

মালিকানাতেনারীর ক্ষমতায়ন জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

মালিকানাতেনারীর  ক্ষমতায়ন জরুরী

কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় ভূমিই উৎপাদনের প্রধান হাতিয়ার। সমাজের অর্ধাংশ নারী হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন এই ভূমিতে নারী-পুরুষের অংশীদারিত্বের বিস্তর ফারাক। স্বামী কিংবা পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যৎকিঞ্চিত অংশ জোটে নারীদের। বিয়ের পর পিতার অংশের দখলিস্বত্ব ক্রমান্বয়ে ভাইদের ক্ষমতায় চলে অলিখিতভাবে। কিন্তু কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় নারী শ্রমের কোন বিকল্প নেই। ফসলের বীজ বোনা থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত যে অমানুষিক শ্রম-বিনিয়োগ করতে হয় সেখানে নারী-পুরুষের তেমন কোন বৈষম্য নেই। ব্যবধান শুধু শ্রম-মজুরি কিংবা দখলদারিত্বে। অথচ সেই পুরোকাল থেকে কৃষি সভ্যতায় নারী অবদান অনস্বীকার্য। ফসল উৎপাদনের বীজ বপন থেকে শুরু করে কৃষির হরেকরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ গৃহিণী নারীদের দ্বারাই সম্ভব হয় বলে ইতিহাসে বিধৃত আছে। আর সভ্যতার চরম উৎকর্ষের যুগে, কৃষি শিল্পের আধুনিকায়নের এই সমৃদ্ধ অবস্থায় নারীরা কৃষি ভূমির স্বত্ব থেকে এখনও অনেকাটাই দূরে। ইতিহাসে বলা আছে এক সময় এই মালিকানার ব্যাপারটি নাকি পুরোপুরিই নারীদের হাতে ছিল। সম্পত্তি সমর্পণ এবং বংশপঞ্জি সবই মায়ের দিক থেকেই বিবেচনা করা হতো। সভ্যতা প্রযুক্তিসহ তার আনুষঙ্গিক সমস্ত উপাদান নিয়েই সামনের দিকে নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্ধাংশ নারীরা শুধু বৈষম্যের শিকারই হচ্ছেন না তাদের মৌলিক অধিকার থেকেও দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। যা সামগ্রিক উন্নয়নের পথে একটি বিরাট অন্তরায়। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত এদেশের ভূমি ব্যবস্থায় একতরফা পুরুষ মালিকানার সমালোচনা করে নারীর অধিকারও নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, শ্রম-মজুরি এবং মালিকানায় লিঙ্গ-বৈষম্যের অবসান না হলে কৃষি উন্নয়ন থেকে শুরু করে সামগ্রিক ব্যবস্থার ছন্দপতন ঘটবে যা দেশের সমৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে। নারীরা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীও হচ্ছে ক্ষমতায়ন কিংবা কর্তৃত্বের কাঠামোতে নিজেদের অংশীদারিত্ব বাড়ছে। কিন্তু গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থায় যে মালিকানাস্বত্ব যা দেশের উৎপাদনের সিংহভাগ সেখানে নারীর অধিকার প্রায়ই অনিশ্চিত। বিয়ের আগে পিতা বিয়ের পরে স্বামী এবং সবশেষে পুত্রের অধীনে নারীদের জীবন একসময় দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। শেষ জীবনে বৃদ্ধাশ্রমই হয় তাদের অন্তিম ঠিকানা। বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য যে বৃদ্ধাশ্রমের সিংহভাগই নারী। তারা শুধু যে গ্রামগঞ্জ থেকে আসা তা নয় একসময় বিত্তশালী সফল কর্মজীবী মহিলা যারা শিক্ষক থেকে আরম্ভ করে সরকারী উচ্চ পদে বহাল ছিলেন। শেষ সম্বলটুকু না থাকায় তাদের প্রভাবে নতুন এক জীবনের দ্বারস্থ হতে হয় যা তার পূর্বের অবস্থার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এটাই বাংলাদেশের পুরো ব্যবস্থার একটি সার্বিক চিত্র। নারীর মালিকানা এবং ক্ষমতায়নের এই অব্যবস্থাকে উত্তরণ করতে না পারলে দেশের প্রবৃদ্ধির যথাযর্থ সাফল্যের পথে বাধার সৃষ্টি হবে। কৃষি জমিতে নারীরা তাদের পর্যাপ্ত শ্রম দিচ্ছে কিন্তু অধিকার নির্ণীত হচ্ছে সেই পুরনো সাবেকী পন্থায়। নতুন নতুন উদ্ভাবনা শক্তিসহ শ্রমের নানাবিধ উপকরণে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির জোরালো ছাপ পড়ছে কিন্তু পিছিয়ে পড়া নারী কৃষক কিংবা শ্রমিকের ক্ষমতায়নের ওপর চলছে নানামাত্রিকে বিধিনিষেধের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খল। যার থেকে বের হয়ে আসা সত্যিই দুঃসাধ্য। সমাজ কাঠামোর একেবারে ভেতরে গেড়ে বসা এসব দুর্ভেদ্য অপশাসন থেকে সামগ্রিক উৎপাদনের মালিকানাকে নতুন মাত্রা দিতে না পারলে বিদ্যমান সমস্যার কোনই সুরাহা হবে না। কারণ অধিকার এবং স্বাধীনতা যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে যে কোন ব্যবস্থাই সফলভাবে এগুতো পারে না। যে উৎপাদনের মূল হাতিয়ারে মেয়েদের অধিকার অর্জিত হয় না, তাদের কোন দাবি থাকে না সেখানে শুধু কায়িক শ্রম দেয়া কলুর বলদের মতো। পিতা, স্বামী কিংবা শ্বশুরের ভিটেমাটি থেকে আরম্ভ করে কৃষি ভূমি, মাছ আবাদ এবং পশুপাখি লালন-পালনের মতো জরুরী অর্থনৈতিক কর্মপ্রক্রিয়ায় নারী শ্রম একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য শক্তি। আর এই শক্তিমত্তার সঙ্গে মালিকানা স্বত্বটি যদি সেতুবন্ধন তৈরি করে তাহলে উৎপাদনের গতি যেমন নিরন্তর হবে তেমনি নারীর ক্ষমতায়নও নিশ্চিত হবে। যার গতি সঞ্চার হবে পুরো আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে। যা আসতে হবে একেবারে সমাজের মূল শেকড় থেকে। নারীর অধিকার কর্তৃত্ব, ক্ষমতায়ন, সম্মান, মর্যাদা সবই সমাজ প্রচলিত অন্যান্য নিয়মনীতির মতোই অনিবার্য এবং আবশ্যক। শুধু আইনী কিংবা বিচারিক ব্যবস্থায় এই অসম বণ্টনের কোন সুরাহা হবে না, পারস্পরিক সমঝোতা, সহমর্মিতা, একে অন্যের প্রতি অধিকার সচেতনতা সর্বোপরি দায়িত্ববোধের মতো মানবিক সম্পর্ক এই অসম ব্যবস্থা থেকে সবাইকে বের করে আনতে পারে।
×