ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় (গত বুধবারের পর) স্বদেশে ৫৮ সালে গণতন্ত্র ধ্বংসের সূত্রপাত রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মির্জা দেশে যে সামরিক শাসন জারি করলেন সেই সামরিক শাসন উচ্চাভিলাষী সেনাধিনায়ক জেনারেল আইয়ুব পরবর্তী চার বছর বহাল রাখলেন। ইতোমধ্যে অবশ্য তিনি নানাভাবে তার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন। আইয়ুব খান এই সামরিক শাসনের জন্য ১৯৫৩ সাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে তার আত্মকথায় (ঋৎরবহফং হড়ঃ গধংঃবৎং) বলেছেন। তিনি ক্ষমতা নিয়েই বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন-কমিটি প্রতিষ্ঠা করে চললেন। যেমন- জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি, শিক্ষা সংস্কার কমিশন এবং সংবিধান কমিশন। ১৯৫৯ এবং ১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব মোটামুটিভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হন। তার উদ্যোগে তিনি বৈদেশিক পৃষ্ঠপোষকতাও বর্ধিত হারে আহরণ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি তার ধারণামত গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া শুরু করলেন এবং প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র আইন জারি করেন। এই আইনের অধীনে সারাদেশে শুধু স্থানীয় সরকারের নিম্নতম ইউনিট ইউনিয়ন বোর্ডে নতুন নামকরণ করে ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা নেন। এরকম কোন প্রতিষ্ঠান পশ্চিম পাকিস্তানে এর আগে ছিল না। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানে এ ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠন বিশেষ আগ্রহের সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানে এটা মোটেই নতুন কিছু ছিল না। তবে থানা কাউন্সিল হলো একটি নতুন প্রতিষ্ঠান এবং জেলা ও বিভাগীয় কাউন্সিল সেগুলোও হলো নতুন প্রতিষ্ঠান। এই আইনের বিশেষত্ব ছিল যে, তৃণমূল পর্যায়ে সরাসরি নির্বাচন করে অন্য প্রত্যেকটি পর্যায়ে সরাসরি নির্বাচন প্রক্রিয়া বিতাড়ন। এমনকি যে সর্বোচ্চ প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠিত হলো সেখানেও সকলেই ছিলেন হয় পদের জোরে অথবা মনোয়নের মাধ্যমে। আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের মূলকথা হলো শুধু তৃণমূল পর্যায়ে সত্যিকার নির্বাচন কিন্তু অন্যান্য স্তরে মোটামুটিভাবে মনোনয়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন। আইয়ুবীয় গণতন্ত্রে তাই গণতন্ত্রের লেশমাত্রও ছিল না। মৌলিক গণতন্ত্র অর্ডারের পরে ১৯৬০ সালে আসলো মিউনিসিপ্যাল অর্ডিন্যান্স। এখানেও একই পদ্ধতি বহাল থাকল। ওয়ার্ডগুলোতেও সরাসরি নির্বাচন এবং অতপর উচ্চতর সব পরিষদে মনোনয়ন অথবা পদাধিকার বলে সদস্য পদ প্রাপ্তি। এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬০ সালের শুরুতে দেশব্যাপী সব মৌলিক গণতন্ত্রীদের নিয়ে একটি নির্বাচন পরিষদ গঠন করলেন এবং তাদের ভোটে ১৭ ফেব্রুয়ারিতে তিনি তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্বকে আইনী ভিত্তি প্রদান করলেন। এই তথাকথিত গণভোটে অংশগ্রহণ করলেন ৭৮ হাজার ৭২০ জন ইউনিয়ন কাউন্সিলর এবং সিটি বা মিউনিসিপাল কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ। তাদের সংখ্যা দুই অঞ্চলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৮০ হাজার। যারা ভোট দিলেন তাদের ৭৫ হাজার ২৮৩ জন আইয়ুবের পক্ষে হ্যাঁ-সূচক ভোট দিলেন। আইয়ুবের পদ্ধতিমতো এবং কৌশল অনুযায়ী তিনি তখনই হলেন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। প্রহসন আর কাকে বলে! ১৯৫৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দুটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা পায়- আলাস্কা এবং হাওয়াই। এগুলো আগেই আমেরিকার সঙ্গে ছিল। আলাস্কা এক সময় রাশিয়া সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই এলাকাটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে খরিদ করে। হাওয়াই এক সময় পলিনেশিয়ান একটি রাজ্য ছিল। খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই সেখানে পলিনেশিয়ানরা বসতি স্থাপন করে এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে তাহিতির জনগণ এই দ্বীপে আস্তানা গাড়তে থাকে। সেখানে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল এবং ১৭৭৮ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন জেমস কুক এই দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। তারপর থেকেই মার্কিন এবং ব্রিটিশ জনগণ এই দ্বীপে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ফরাসীরাও উনবিংশ শতাব্দীতে হাওয়াইয়ে আগমন করে। হাওয়াই স্বেচ্ছায় বিভিন্ন আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমেরিকাকে তাদের দ্বীপে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত একটি এলাকা হিসেবে গণ্য হওয়ার পর অবশেষে একটি রাজ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশে এই বছরে আইয়ুব খান তার মৌলিক গণতন্ত্রের আইনটি পাস করেন। যে সম্বন্ধে পূর্ব অনুচ্ছেদেই আলোচনা করেছি। এই বছরে ঢাকায় জাগো আর্ট সেন্টার নামে বিখ্যাত শিল্পী গওহর জামিল একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। আগেই বলেছি যে, ১৯৫৫ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা পায়। সুতরাং জাগো আর্ট সেন্টার হলো দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৬০ সালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ১৪ সেপ্টেম্বর মূলত মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোল উৎপাদনকারী দেশগুলো পেট্রোল রফতানিকারক দেশসমূহের প্রতিষ্ঠান (ঙৎমধহরুধঃরড়হ ড়ভ ঃযব চবঃৎড়ষবঁস ঊীঢ়ড়ৎঃরহম ঈড়ঁহঃৎরবং) ঙচঊঈ স্থাপন করে। এই বছরেই করাচীতে একটি জাতীয় শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হবে। এই আশাটি কিন্তু আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এই বছরেই ইতোপূর্বে যে আইয়ুবীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে সম্বন্ধে মন্তব্য করেছি। আমাদের সিলেটে এই বছর আমার আব্বা আরও কতিপয় শিক্ষা সম্প্রসারণে উদ্যোগীদের সহায়তায় কাজিটুলায় কাজী জালালউদ্দিন মহিলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং উদ্যোক্তারা তাকেই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচিত করেন। এই স্কুলের সঙ্গে আমার আম্মা এবং আব্বা দু’জনেই তাদের সারাজীবন সম্পৃক্ত ছিলেন। আমি ১৯৫৯ সালের এপ্রিল মাসে বাগেরহাটে মহকুমা হাকিম হিসেবে (ঝঁন উরারংরড়হধষ ঙভভরপবৎ– ঝউঙ) দায়িত্ব গ্রহণ করি। ফরিদপুরের সহকারী হাকিম হিসেবে আমার অবস্থানের বিষয়ে আগেই বলেছি। ফরিদপুর থেকে বাগেরহাট যাত্রা ছিল বেশ লম্বা। ফরিদপুর থেকে একটি ট্রেনে গোয়ালন্দ হয়ে খুলনা পৌঁছতে বেশ লম্বা সময় লাগে। সম্ভবত একটি ট্রেনে ফরিদপুর থেকে গোয়ালন্দ যাই অপরাহ্নে কোন সময়ে। গোয়ালন্দে ট্রেন পরিবর্তন করে খুলনাগামী ট্রেনে আরোহন করি প্রায় দুপুর রাতে এবং খুলনায় পৌঁছি পরের দিন দ্বিপ্রহরে। সেদিন খুলনা সার্কিট হাউসে অবস্থান করি এবং খুলনার জেলা প্রশাসক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জমির উদ্দিন আহমেদ বললেন যে, আমার কোন সময় ব্যয় না করে বাগেরহাটে যাওয়া উচিত। পূর্ববর্তী মহকুমা হাকিম এ. এস. নূর মোহাম্মদ, সিএসপিকে জনগণের দাবির মুখে তড়িঘড়ি করে বদলি করা হয়। সেখানে একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাময়িক দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আরও বললেন যে, একজন নতুন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট জমশেদ আহমেদ সেখানে কয়েকদিন আগে নিযুক্ত হয়েছেন এবং তার সহায়তা আমার জন্য খুব কার্যকর হবে। আমার মনে হয় আমি পরের দিন সকালেই বাগেরহাটে যাই। বাগেরহাটে যাওয়ার জন্য প্রথমেই আমাকে ফেরি দিয়ে রূপসা নদী পার হতে হলো। সেখানে একটি ছোট ট্রেনে আরোহণ করে প্রায় দেড়/দুই ঘণ্টায় বাগেরহাটে পৌঁছতে হলো। এ রকম ট্রেন আমি আর কোনদিন দেখিনি এবং এইটি ছিল বাংলাদেশের একমাত্র ন্যারোগ্যজ ট্রেন। এই ট্রেনলাইনটি মার্টিন কোম্পানি কোন এক সময় নির্মাণ করে এবং এটি এভাবেই থেকে যায়। তার কম্পার্টমেন্টগুলো ছিল ছোট আকারের এবং তার ইঞ্জিনও ছিল অন্য রকমের। সুতরাং এখানে অন্য কোন সূত্র থেকে ইঞ্জিন অথবা ওয়াগন বা কোচ আমদানির সুযোগ ছিল না। ন্যারোগ্যজ ট্রেন বহুদিন আগেই অবিভক্ত ভারতবর্ষ, বার্মা এবং অন্যান্য দেশ থেকে বিতাড়িত হয় এবং এই ধরনের ট্রেন তখন কোথাও নির্মিত হতো না। এই ট্রেনটি সম্বন্ধে আরও কিছু বলা প্রয়োজন। যেহেতু ট্রেনের ইঞ্জিন এবং কম্পার্টমেন্টগুলো ছিল পুরনো এবং ট্রেনলাইনটিও বেশ পুরনো ছিল এবং কোন অংশই প্রতিস্থাপন করা যেত না সেজন্য এই ট্রেন সার্ভিসটি ছিল অত্যন্ত ঝামেলাপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। প্রায়ই রাস্তার কোথাও ট্রেন থেমে যেত এবং সেটাকে চালু করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অনেক সময় ইঞ্জিনে পানি ঢালতে হতো। আমি নিজেও এই কাজে কয়েকবারই ব্যস্ত থাকি। একটা বিকল্প উপায় ছিল স্থলপথে খুলনা থেকে বাগেরহাট ভ্রমণ। এই রাস্তাটি মাত্র ৩০ কিলোমিটারের মতো লম্বা ছিল। কিন্তু অনেক জায়গায় সত্যিকার অর্থে কোন রাস্তা ছিল না; পাঁয়ে চলার পথটাই রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কোন কোন জায়গায় ইটের খোয়া রাস্তাটিকে বেশ যুৎসই করে রাখে। আমার মনে হলো যে, ট্রেন লাইন উঠিয়ে দিয়ে রেলের রাস্তাটি অবলম্বন করে একটি মহাসড়ক নির্মাণ করা যায় এবং সে রকম একটি প্রস্তাবও আমি তখন পেশ করি। আমার সৌভাগ্য ছিল যে, পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের নবগঠিত পরিবহন ডিপার্টমেন্টে উপসচিব হই। আমি সেই পদে থাকাকালে খুলনা-বাগেরহাট রেললাইনকে ব্রডগ্যজে উন্নীত করার এবং একইসঙ্গে খুলনা-বাগেরহাট স্থলপথকে সুদৃঢ় করার কাজটি শুরু করি। পরবর্তীকালে এই রেললাইনটি ব্রডগ্যজে রূপান্তরিত হয় এবং খুলনা-মংলা হাইওয়ে নির্মিত হয়। রূপসার উপরে একটি সেতু দিয়ে খুলনা থেকে সরাসরি এখন মংলা যাতায়াত করা হয়। বাগেরহাটে যাওয়া এখন অনেক সহজ এবং সময়ও অনেক কম লাগে। চলবে...
×