ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

অভ্যাস ৭ ॥ করাতটা ধার দাও

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ৭ নভেম্বর ২০১৬

অভ্যাস ৭ ॥ করাতটা ধার দাও

(প্রথম পর্ব ) একটি জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনি খেয়াল করলেন, একজন লোক একটি গাছ কাটছে। আপনি তার অবস্থা দেখে থামলেন। তার জন্য আপনার মায়া হলো। দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, কী করছ তুমি? লোকটি গাছ কাটা বন্ধ না করে উত্তর দিল, দেখছ না কী করছি? -সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। -তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন? -বোঝার চেষ্টা করছি। -কী বোঝার চেষ্টা করছ? -তুমি গাছ কাটছ, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। -এখানে আবার বোঝাবুঝির কী আছে? -তোমাকে অনেক বিধ্বস্ত লাগছে। সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। কতক্ষণ ধরে এই কাজ করছ? -পাঁচ ঘণ্টার ওপর হবে। গাছ কাটা অনেক কষ্টের কাজ। জীবনে তো আর তোমাকে গাছ কাটতে হয়নি, বুঝবে কিভাবে? -কিন্তু তুমি কেন কয়েক মিনিট একটু জিরিয়ে নিচ্ছ না? সেই ফাঁকে করাতটাও একটু ধার দিয়ে নিতে পার। আমি নিশ্চিত, এতে তোমার কাজটা দ্রুত শেষ হবে। -করাত ধার দেয়ার সময় আমার নেই। গাছ কাটতেই আমি ব্যস্ত। একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো বিষয়টা। আপনার কি কখনও এমন হয়েছে যে, করাত ধার দেয়ার সময় পাননি; কিন্তু একটু ব্রেক নিয়ে করাতটা ধার দিয়ে নিলে গাছটা আরাম করে কাটা যেত, নাকি গাছ কাটাতেই এত বেশি মনোযোগ যে, এদিকে করাতের ধার চলে গেছে খেয়াল করা হয়নি? এটাই হয় মানবজীবনে। ড. স্টিফেন কোরের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে তার সপ্তম অভ্যাসটি হলো ‘শার্পেন দিস’- বাংলায় আমি যাকে বলছি ‘করাতটা ধার দাও।’ আমরা প্রতিনিয়ত এমন সব কাজ নিয়ে ডুবে থাকি যে, ওই কাজটিই আমাদের ঘিরে রাখে। ওই কাজ থেকে বের হয়ে একটু নিজেকে রিফ্রেশ করে নিলে যে আরও ভালভাবে কাজটি করা যায়, তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। আমরা ভাবি, ছুটি নেয়া বোধ হয় একটি বিলাসিতা। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না যে, একজন খুব পরিশ্রমী মানুষও ছুটি নিয়ে থাকেন এবং নিত্যদিন এমন সব বাড়তি কিছু কাজ করেন যার ফলে তার করাতটা ধারাল থাকে। এই নীতিটাকে বলা হচ্ছে ভারসাম্যভাবে নিজেকে নবায়ন করা। আজকে আমরা সেই অভ্যাসটির প্রথম পর্বটি দেখব। এই অভ্যাসটি মূলত অন্য ছয়টি অভ্যাসকে কাজ করতে সাহায্য করে। এই অভ্যাসটি না থাকলে আপনার বাকি অভ্যাসগুলো এক সময় ভেঙ্গে পড়বে। আপনাকে শিখতে হবে কিভাবে নিজেকে সবসময় তরতাজা রাখতে হয়, কিভাবে নিজেকে নবায়ন করতে হয়। নবায়নের চারটি দিক সপ্তম অভ্যাসটি মূলত আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষকে চারটি বিষয় পরিচালিত করে। এর যে কোন একটিতে ঝামেলা বাধলেই আপনি ভারসাম্য হারাবেন। এই চারটি বিষয় হলো- শারীরিক, আধ্যাত্মিক, মানসিক এবং সামাজিক-আবেগ। যদিও বিভিন্ন দর্শনে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তবে মানুষের জীবন মূলত এই চারটি বিষয় দিয়েই পরিচালিত হয়। আপনার জীবন কোন না কোনভাবে এই চারটি প্যারামিটার দিয়ে ঘিরে রাখা। এই চারটি বিষয় ঠিক থাকলেই আপনি বাকি অভ্যাসগুলো অর্জন করতে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারবেন। এটাই হলো আপনি মূল মানুষটা। দার্শনিক হার্ব শেফার্ড একটি সুস্থ ভারসাম্যপূর্ণ জীবনকে চারটি মান দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেছেন- পার্সপেক্টিভ (পরিপ্রেক্ষিত, যা মূলত আধ্যাত্মিক), অটোনমি (ব্যক্তিস্বাধীনতা, যা মূলত মানসিক), কানেকটেডনেস (সংযুক্ত থাকা, যা মূলত সামাজিক) এবং টোন (শারীরিক দৃঢ়তা, যা মূলত শারীরিক)। বিশ্ববিখ্যাত দৌড়বিদ, ডাক্তার ও দার্শনিক জর্জ শীহানও জীবনের চারটি ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করেছেন- একজন ভাল প্রাণী হওয়া (শারীরিক), একজন ভাল কারিগর হওয়া (মানসিক), একজন ভাল বন্ধু হওয়া (সামাজিক) এবং একজন সাধু হওয়া (আধ্যাত্মিক)। কোন ভাল প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এই চারটি মূলমন্ত্রের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয়ে থাকে। তারা এই চারটি বিষয় দলের মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয় যেন মানুষের ভেতর এক ধরনের ভারসাম্যতা চলে আসে। তারা বোঝাতে সক্ষম হয়- অর্থনৈতিক (শারীরিক); মানুষকে কিভাবে বিবেচনা করতে হয় (সামাজিক); কিভাবে মানুষ নিজেকে তৈরি করে (মানসিক); এবং কিভাবে একটি প্রতিষ্ঠান চাকরির সুযোগ করে দেয়, সেবা প্রদান করে এবং সমাজে অবদান রাখে (আধ্যাত্মিক)। সপ্তম অভ্যাসটি মূলত মানুষের জীবনের এই চারটি মোটিভেশনকেই প্রকাশ করে। এটা বলে দেয়, আমাদের জীবনের এই চারটি খাতকে প্রতিনিয়ত এবং নিয়মমাফিক কিভাবে বুদ্ধিদীপ্ত ও ভারসাম্যতা বজায় রেখে প্রকাশ করা যায়। তবে এই অভ্যাসটি তৈরি করতে আপনাকে প্রোএক্টিভ হতে হবে। করাত ধার দিতে হলে আপনাকে ‘দ্বিতীয় কোয়ার্ডেন্ট’-এ সময় দিতে হবে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রথম কোয়ার্ডেন্টটি হলো ‘জরুরী’ বিষয়গুলো ভর্তি। আপনাকে গিয়ে ওগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে না, ওগুলোই আপনার ওপর এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনি জরুরী বিষয়গুলো কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। আর এই জরুরী বিষয়গুলো এমন যে, ওটা আপনাকেই করতে হবে। আপনি অন্য কারও ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না। কিন্তু আপনি যদি দ্বিতীয় কোয়ার্ডেন্টে সময়টা ব্যয় করেন তাহলে আপনাকে অনেক জরুরী বিষয়ের মুখোমুখি হতে হবে না। এখানে আপনি নিজের সারাজীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগটা করতে পারেন। এটা হলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় একক বিনিয়োগ। আর কোন খাতে এত বড় বিনিয়োগ আসলে আপনি করবেন না। কারণ, এই বিনিয়োগটা আপনার জীবনের ওপর বিনিয়োগ, আপনার শরীর, মন, দর্শনের ওপর বিনিয়োগ। আমরা নিজেরাই আমাদের দক্ষতার জন্য দায়ী। আমরা কতটা ইফেক্টিভ হতে চাই তার পুরোটাই নির্ভর করবে এখানে কতটা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তাই আপনার জীবন থেকে কিছুটা সময় প্রতিদিন বের করতে হবে, যা আপনার করাতকে ধার দিয়ে যাবে। জীবনের চারদিক প্রকৃতির যেমন চারদিক, জীবনেরও রয়ে গেছে চারটি দিক- শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক। এর প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদা করে লিখব পরের সপ্তাহে। তাতে বিষয়গুলো কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং কিভাবে আপনার কর্মকা-ে নিয়ে আসা যাবে, সেটা বুঝতে সুবিধা হবে। তবে এ পর্বে শুধু সংক্ষেপে এটুকু বলে রাখা যেতে পারে যে, শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে আপনি যা করতে চান তা করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে আপনাকে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং পাশাপাশি আপনার স্ট্রেসকে ম্যানেজ করতে হবে। আমাদের অনেকেই আছেন স্ট্রেস ম্যানেজ করতে না পারার কারণে শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। মানিসকভাবে আপনি সুস্থ না হলে তো কোন কথাই নেই। আপনি মোটামুটি পাগল হিসেবেই বিবেচিত হবেন। আমাদের ভেতর এমন অসংখ্য পাগল রয়েছেন, যারা নিজে বুঝতে পারেন না। আমরা পাগল বলতে পুরোপুরি উন্মাদকে বুঝি, যখন তাকে পাবনায় পাঠাতে হবে। সেটা হলো একদম পাগল। কিন্তু আপনি যদি পঞ্চাশ ভাগ পাগল হন কিংবা এর থেকে একটু কম বা বেশি? ভেবে দেখেছেন কখনও? মানিসকভাবে আপনি কি ভারসাম্য? বই পড়া, ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারা, ভালভাবে পরিকল্পনা করতে পারা, লেখালেখি করা ইত্যাদি আপনাকে মানসিকভাবে ভারসাম্য থাকতে সাহায্য করতে পারে। আধ্যাত্মিক বিষয়টি নিয়ে অনেকের ভেতর ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন এটা সাধু সন্ন্যাসীদের কাজ। কিন্তু প্রতিটি মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই আধ্যাত্মিক। তার ভেতরে এই গুণটি অবস্থান করে। আপনি এটাকে স্বীকার করেন আর না-ই করেন, এটা আপনার ভেতরে আছে। যে কারণে মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করে, নামাজ পড়ে, হজে যায়, পূজা করে, মন্দিরে যায়, ধ্যান করে। এই পৃথিবীর যাবতীয় সফল এবং ইফেক্টিভ মানুষরাই কোন না কোন ফর্মে মেডিটেশন করে, ধ্যান করে। পরিশেষে মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। এটাকে আপনি অবজ্ঞা করতে পারবেন না। অনেককেই দেখি, সমাজ থেকে নিজেকে উইথড্র করে নেন, একা থাকার পরিকল্পনা করেন। তারা মূলত সামাজিকভাবে দৈন্য। তারা নিজেদের অস্তিত্বের একটি বিরাট অংশকে অস্বীকার করছে। আপনার চারটি স্তম্ভের একটিকে হারিয়ে ফেলছেন। আমার আশপাশের অনেককেই বলতে শুনি, আমি সামাজিক না, এটা আমার ভাল লাগে না। তারা তাহলে কেন বেঁচে থাকেন? নিজের জন্য? এর থেকে বড় স্বার্থপরতা আর কী হতে পারে! যে মানুষ কেবলমাত্র নিজের জন্য বেঁচে থাকে সে আসলে বেঁচে থাকে না, বাঁচতে জানেই না, বাঁচার অর্থ জানে না। তার ভেতর মানুষকে দেয়ার কিছু নেই, তার ভেতর সহমর্মিতা নেই, সে সিনারজি তৈরি করতে পারে না, সে এক ধরনের হতাশা নিয়ে জীবনযাপন করে। শরীর নামের একটি যন্ত্রে কেবল অক্সিজেন টেনে নিয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়ার নাম জীবন নয়! বাকিটা নিয়ে লিখব পরের সপ্তাহে। ০৬ নবেম্বর ২০১৬ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×