ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

তামিম ইকবাল- ইংলিশ বোলারদের যম

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২ নভেম্বর ২০১৬

তামিম ইকবাল- ইংলিশ বোলারদের যম

সময়ের বিবর্তন বুঝি এমনই! ২০১৫ সালের শুরুতেও সমালোচনায় বিদ্ধ ছিলেন তামিম ইকবাল। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে প্রায় প্রতি ম্যাচেই ইনিংসের শুরুতে দলকে ডুবিয়েছিলেন। যে কারণে অনেক বাংলাদেশী ভক্ত বিরক্তি ও আক্রোশের সুরে সে সময় বলেছিলেন, ‘তামিমকে দল থেকে বাদ দেয়া উচিত। মাঠে তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয় খেলার প্রতি সে সিরিয়াস না। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই এমন দেখা যাচ্ছে। অন্য কাউকে তার বদলে সুযোগ দিলে ভাল করবে মনে হয়।’ বিশ্বকাপের হতাশা ভুলতে মোটেও কালক্ষেপণ করেননি তামিম। নিজ দেশে বিশ্বকাপ পরবর্তী ওয়ানডে সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফিরে পান নিজের চেনা ছন্দ। পাকীদের হোয়াইটওয়াশ করার পথে তিন ইনিংসের দুটিতে শতক ও অপরটিতে অর্ধশতক হাঁকান। শুরুর প্রসঙ্গটিই তাই বলতে হচ্ছে। সময়ের ব্যবধানে সেই তামিমই এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভরসার নাম। পাকীদের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং পারফর্মেন্স ভারতের বিপক্ষেও অব্যাহত রাখেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সদ্য শেষ হওয়া ওয়ানডে ও টেস্ট সিরিজেও ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ছিলেন ২৭ বছর বয়সী এই মহাতারকা। বিশেষ করে টেস্ট সিরিজে ইংলিশ বোলারদের যম হিসেবে আবির্ভূত হন চট্টলার এই তরুণ। মিরপুরে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের ভিত গড়ে দেন তামিমই। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে রানের দিক থেকে শীর্ষে বাংলাদেশী ওপেনার তামিম। শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই নয়, পুরো সিরিজেই সবচেয়ে বেশি রান করেছেন তুখোড় এই বাঁহাতি ওপেনার। চার ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি ও হাফসেঞ্চুরির সাহায্যে তামিম করেন সর্বোচ্চ ২৩১ রান। ওপেনিংয়ে তামিমের এই ধারাবাহিক পারফর্মেন্সের ফল পাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। শুরুতে তামিমের গড়ে দেয়া ভিতের উপর দাঁড়িয়ে দারুণ সব জয় পাচ্ছে দল। ক্রিকেটের জনকদের আভিজাত্যের টেস্টে মাটিতে নামানোর মূল কারিগরই তিনি। দুই ইনিংসেই ব্যাট হাতে তুলাধোনো করেছেন ইংলিশ বোলারদের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এমন জ্বলজ্বলে ব্যাটিং তামিমের চিরায়াত স্বভাব। ম্যাচের ফলাফল যেমনই হোক। দলের ব্যাটিং যত খারাপই হোকÑ তামিম সবসময়ই দুর্বার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। টেস্ট ক্রিকেটে বরাবরই শক্তিমত্তায় অনেক এগিয়ে ইংলিশরা। কিন্তু সেই টেস্ট ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ হিসেবে তাদের পেলেই যেন ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠেন তামিম। বাংলাদেশের পক্ষে তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই সর্বাধিক রানের মালিক এ বাঁহাতি ওপেনার বারেবারেই এ প্রমাণ দিয়েছেন। ইংলিশ বোলারদের কাছে মাঠের মোকাবেলায় তাই একেবারে চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছেন তিনি। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামেও সেটার প্রমাণ দিয়েছেন তামিম। সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের প্রথমদিনেই ক্যারিয়ারের অষ্টম এবং ইংলিশদের বিপক্ষে তৃতীয় সেঞ্চুরি আদায় করে নেন তিনি। ১০৪ রান করার পর বিদায় নেন তামিম। এর মাধ্যমে যে কোন প্রতিপক্ষের চেয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সর্বাধিক রানের রেকর্ড গড়েন তিনি। পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও খেলেন ৪০ রানের জ্বলজ্বলে ইনিংস। তামিম এই শুরুটা করেন ২০১০ সালে ‘ক্রিকেট মক্কা’ ঐতিহাসিক লর্ডসে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরিটা (ক্যারিয়ারের তৃতীয়) হাঁকিয়ে ছিলেন সেই টেস্টে। ১০৩ রানের ইনিংস উপহার দেয়ার পরের টেস্টে ম্যানচেস্টারেও ১০৮ রানের ইনিংস উপহার দেন তামিম। এরপর আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা হয়নি তামিমের। দীর্ঘ ৬ বছর ৫ মাস পর আবার প্রতিপক্ষ হিসেবে ইংল্যান্ডকে পেলেন তিনি। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই আবার জ্বলে উঠলেন, ৭৮ রানের দারুণ এক ইনিংস খেললেন। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ৭ সেঞ্চুরির মালিক তামিম বেশ আগেই হয়েছেন। তবে টানা ১৪ মাসেরও বেশি সময় টেস্ট খেলেনি বাংলাদেশ দল। তবে এমন দীর্ঘ বিরতির পরও মধুর প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নৈপুণ্যে হেরফের ঘটেনি তামিমের। চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য তেমন সুবিধা করতে পারেননি, ৯ রানেই বিদায় নেন। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টেই আবার জ্বলে উঠেন। প্রথম ইনিংসের শুরুতেই উদ্বোধন সঙ্গী ইমরুল কায়েসকে হারিয়ে ফেলেন। তাতে বিচলিত হননি একটুও। সাবলীল ভঙ্গিমা নিয়েই মোকাবেলা করেন ইংলিশদের বোলিং আক্রমণ। দ্বিতীয় উইকেটে মুমিনুল হক সৌরভের সঙ্গে ১৭০ রানের বড় জুটি গড়েছেন। এটি টেস্টে দ্বিতীয় উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে চতুর্থ সেরা। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটিই সেরা জুটি দ্বিতীয় উইকেটে। এর আগে হান্নান সরকার ও হাবিবুল বাশার ১০৮ রানের জুটি গড়েছিলেন ২০০৩ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরি পেয়ে যান তামিম। তবে এরপর বেশিদূর যেতে পারেননি। ১৪৭ বলে ১২ চারে ১০৪ রান করার পর সাজঘরে ফিরে যান। তবে বাংলাদেশকে দারুণ একটা অবস্থান তৈরি করে দিয়ে যান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটি তামিমের তৃতীয় সেঞ্চুরি। আগের দুটি করেছিলেন টানা দুই টেস্টে ইংল্যান্ডের মাটিতে। এবার তাদের বিপক্ষে প্রথম দেশের মাটিতে শতক হাঁকান। যে কোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তার সর্বাধিক। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কা ব্যতীত বাকি সব দলের বিরুদ্ধেই টেস্টে শতক হাঁকিয়েছেন। এর মধ্যে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে আছে ২ সেঞ্চুরি। তবে যে কোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মোট রান করার দিক থেকে এখন ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই সর্বাধিক তামিমের। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ টেস্টের ১২ ইনিংসে ৬১.৩৩ গড়ে তিনি করেছেন ৭৩৬ রান। এই ৬ টেস্টেই অন্তত একটি পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস আছেই। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৮ টেস্টে ৪২.৮৭ গড়ে করেছেন ৬৮৬ রান। সবচেয়ে বাজে অবস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ৬ টেস্ট খেলে মাত্র ১৬.৬০ গড়ে মাত্র একটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে করতে পেরেছেন ১৬৬ রান! ক্যারিয়ারে যত রান করেছেন এর মধ্যে সিংহভাগই করেছেন তিনি ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করে। ২১ টেস্টে আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে তিনি ৪৭.৩০ গড়ে ৬ সেঞ্চুরি ও ৯ হাফসেঞ্চুরিসহ করেন ১৮৪৫ রান। আর ফিল্ডিংয়ের পর ব্যাটিংয়ে নেমে ২৩ টেস্টে ৩৪.০৪ গড়ে করেছেন ১৪৬৪ রান। সবমিলিয়ে এখন ৪৪ টেস্টে ৪০.৩৫ গড়ে তার রান ৮ সেঞ্চুরি ও ১৯ হাফসেঞ্চুরিসহ ৩৩০৯। এটি ছিল ঘরের মাটিতে তামিমের পঞ্চম সেঞ্চুরি। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশের মাটিতে এই প্রথম শতক হাঁকালেন তামিম। যাদের বিপক্ষে ১১ ইনিংস খেলে ৫টিতেই অর্ধশতক আর ৩ শতক এখন তার। বাকি তিন ইনিংসে তিনি করতে পেরেছেন ১৪, ২ ও ৯। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র চার সেঞ্চুরি পেয়েছে বাংলাদেশ দল। তামিম ছাড়া আরেকটি শতক পেয়েছেন জুনায়েদ সিদ্দিকী। ২০১০ সালের মার্চে তিনি চট্টগ্রামে ১০৬ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন।
×