ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

শান্তি চুক্তির জালে কলম্বিয়ার শান্তি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

শান্তি চুক্তির জালে কলম্বিয়ার শান্তি

জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস, কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি। এ বছরের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। নিজ দেশে চলে আসা ৫২ বছর ধরে চলমান গৃহযুদ্ধ নিরসনে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ঋঅজঈ-এর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য তার এই পুরস্কার লাভ। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি কিছু প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে তার নিজ দেশেও রয়েছে নানা মত। চুক্তির শর্তগুলো নিয়েও উচ্চারিত হচ্ছে নানা প্রশ্ন। পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি কি হবে? দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধে রত গেরিলারা স্বাভাবিক জীবনে কতটা খাপ খাওয়াতে পারবেন? যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিচারের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে চুক্তিতে, তা কতটা সম্ভব? ড্রাগ লর্ড ও তাদের অনুগতদের কতটা পোষ মানানো সম্ভব হবে? এমন হাজারো প্রশ্নের পাশাপাশি, নিজ দলের ও মূল ধারার নাগরিকদের সেন্টিমেন্টও তাকে বিবেচনায় নিতে হবে। বিষয়টি এখন এভাবে বলা যায়, নোবেল শান্তি পুরস্কার তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আরও বড় চ্যালেঞ্জের সামনে। যে কারণে তার এই পুরস্কারপ্রাপ্তি সেই কারণটিকে তাকে বাস্তবতায় রূপ দিতে হবে। তাকে পাড়ি দিতে হবে কণ্টক বিছানো দীর্ঘ পথ। প্রমাণ করতে হবে পুরস্কারের যথার্থতা। কলম্বিয়া লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম জনঅধ্যুষিত দেশ। বলা হয় বর্তমানে জীবিত বেশিরভাগ লাতিন আমেরিকানের চেয়ে কলম্বিয়ায় চলে আসা গৃহযুদ্ধের বয়স বেশি। এই যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার জীবন। বাস্তুচ্যুত হয়েছে মিলিয়নের বেশি মানুষ। বাধাগ্রস্ত হয়েছে উন্নয়ন। এই গৃহযুদ্ধের মূল প্রতিপক্ষ ছিল রেভিলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অব কলম্বিয়া (ফার্ক)। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে এটি ছিল স্তালিনপন্থী প্রান্তিক সেনাবাহিনী। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তীতে সেটি জড়িয়ে পড়ে মাদক বাণিজ্য, চাঁদাবাজির মতো অপরাধে। সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে ঋঅজঈ-এর সঙ্গে কার্টাজেনাতে এক ডজন রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। প্রথম জটিলতা অক্টোবর ২ এ এই চুক্তিকে ঘিরে জনমত যাচাইয়ের জন্য নির্বাচনী ফলাফল। খুব সামান্য ব্যবধানে (০.৫০%) কলম্বিয়ার সাধারণ নাগরিকেরা এই চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেছে। যা অনেক সাধারণ কলম্বিয়ানের সঙ্গে অবাক করেছে সারা বিশ্বকে। প্রেসিডেন্ট সান্টোস দীর্ঘ ছয় বছর ব্যয় করেছেন ফার্ক-কে নিরস্ত্রীকরণে। তার সামনে জনমত যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতাও ছিল না। কিন্তু এই চুক্তির পক্ষে জনমত শান্তি প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে শক্তি যোগাত। আপাত দৃষ্টিতে তিনি একটি বাজী ধরেছিলেন এবং হেরে গেছেন। যুদ্ধবিরতি ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বর্ধিত হয়েছে। বর্তমান অবস্থাতেও রাষ্ট্রপতি সান্টোস ও ফার্ক নেতারা শান্তি স্থাপনে একমত। তারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে চাইছেন না। সান্টোস যুদ্ধবিরত বজায় রাখার ও যে কোন মূল্যে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হতে পার্এেই চুক্তির বিতর্কিত অংশগুলো নিয়ে পুন:আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসা। সান্টোস বলেছেন, “আমি হ্যাঁ এবং না এই দু’পক্ষেরই মতামত শুনব। এবং অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে একটি ঐক্যমত আসা খুব জরুরী।” এই প্রত্যাখ্যান উদ্রেক করেছে আরও কিছু প্রশ্নের দু’মাসে আগের প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধবিরতি কি বজায় রইবে? ফার্ক নেতারা কি তাদের ৬০০০ সদস্যের অস্ত্র সমর্পণ প্রক্রিয়াটি নিয়ে অগ্রসর হবেন? বর্তমানে কলম্বিয়ায় অবস্থানরত জাতিসংঘ মিশনের ভূমিকা কি হবে? শান্তি চুক্তির বিরোধিতাকারীদের রয়েছে কিছু নিজস্ব যুক্তি। তাদের মতে এই চুক্তি যুদ্ধাপরাধীদের দিচ্ছে বিশেষ সুবিধা। এই চুক্তির আওতায় ফার্ক নেতারা যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক ধ্বংসলীলা পরিচালনার কিংবা অপহরণের; তারা একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সামনে অপরাধ স্বীকার করে এড়াতে পারবেন জেল গমন। সরকারের পক্ষে মধ্যস্থতাকারীরা বলছেন সমঝোতা স্থাপনে এ ধরনের বিশেষ সুবিধা প্রদানের বিকল্প ছিল না। কিন্তু চুক্তির বিরুদ্ধবাদীরা মাদক পাচার, অপহরণ, চাঁদাবাজির মত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কারাগারে দেখতে চান। চুক্তির শর্তানুযায়ী অস্ত্র সমর্পণকারী গেরিলাদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রদানের বিরুদ্ধে তারা। চুক্তিতে সংগঠনটিকে রাজনীতি করার অধিকার যেমন দিয়েছে তেমনি দিয়েছে কলম্বিয়ান কংগ্রেসে ১০টি আসনের নিশ্চয়তা। চুক্তি বিরোধীরা মানবতাবিরোধী অপরাধের জড়িত ফার্ক নেতাদের কংগ্রেস সদস্য হিসেবে দেখতে চাইছেন না। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট সান্টোস শান্তি চুক্তি স্থাপনে যতটা সময় দিয়েছে, সে তুলনায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগী ছিলেন না। যাক লম্বিয়ার অর্থনীতিকে করেছে দুর্বল। সব মিলিয়ে শান্তি চুক্তির প্রত্যাখ্যান এক অজনপ্রিয় রাষ্ট্রপতিকেই উপস্থাপন করছে। ক্ষত অনেক গভীর। পূরণে সময় লাগতেই পারে। তবে আশার দিকটি হল ফার্ক নিষ্ক্রিয় হলে কলম্বিয়ান সেনাবাহিনী এখন অন্যান্য অস্ত্রধারী গ্রুপ, সংগঠিত মাদক চক্র নির্মূলে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারবে। যদিও এই চুক্তি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিচারের কেন্দ্রে। তাদের মতে এই চুক্তি অপরাধকে পুরস্কৃত করবে। ফার্ক নেতারা কলম্বিয়ান এ্যাটর্নী জেনারেলের আনা অভিযোগের মুখোমুখী হবেন। যা হতে পারে কেবল আনুষ্ঠানিকতা। কিন্তু এটিও স্বীকার করতে হবে তারা প্রচলিত আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। এটিও এক ধরনের সাফল্য বলেই বিবেচিত হচ্ছে। লক্ষ্য যখন ‘রিস্টোরেটিভ জাস্টিস’। কোন আদালত মৃতকে পারে না তার স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু শাস্তি হিসেবে ফার্ক নেতারা তাদের পেতে রাখা মাইন অপসারণ বা তাদের তছনছ করা গ্রামগুলো পুনর্গঠনে শ্রম দিতে পারেন। বর্তমান সমঝোতায় আসতে সরকারকে দীর্ঘ চার বছর ব্যয় করতে হয়েছে ধারাবাহিক আলোচনায়। মনে রাখতে হবে ফার্ক দুর্বল হলেও পরাজিত হয়নি। চুক্তি প্রত্যাখ্যান মানে নতুন রক্তপাতের সম্ভাবনা। শান্তি রাতারাতি আসার নয়। সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর পুনর্গঠনের আশ্বাস দিয়েছে। ফার্ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পুনর্গঠনে সহযোগিতার। যাকে ড্রাগ থেকে দূরে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাষ্ট্রপতি সান্তোস কোকোর বদলে অন্য কোন ফসল চাষের জন্য আশ্বাস দিয়েছেন বিশেষ সুবিধা প্রদানের। চুক্তিটি সফল করার জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নও একান্ত জরুরী। অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও এই চুক্তির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, ফার্ক মেনে নিয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আইনের শাসন ও বাজার অর্থনীতি এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন বলেই বিবেচিত হচ্ছে সব মহলে। প্রশ্ন অনেক। উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে জমা। একটি চুক্তি কলম্বিয়ান নাগরিকদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে দীর্ঘ ৫২ বছরের রক্তাক্ত অধ্যায় সমাপ্তির। পথ দীর্ঘ, কণ্টকাকীর্ণ, শান্তি মূল্য দাবি করেÑ তার পরও প্রত্যাশা শান্তির। কলম্বিয়ার সাফল্য হতে পারে গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট ও টাইম
×