ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের মরা খালে ফিরবে যৌবন

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

বরিশালের মরা খালে ফিরবে যৌবন

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ তিনি কোন জনপ্রতিনিধি কিংবা বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দা নন। কর্মের সুবাদে তিনি এখন বরিশালে রয়েছেন। এর আগে তার চেয়ারে ছিলেন অনেক কর্তাব্যক্তি। তারা কী করেছেন তা বরিশালবাসী সবারই জানা। সরকারী বদলিযোগ্য চাকরি, তাই তারা অন্যত্র চলে গেছেন। এভাবেই হয়ত এখন যিনি রয়েছেন তিনিও একদিন অন্যত্র চলে যাবেন। তখন শুধু তার স্মৃতিই বয়ে বেড়াবে বরিশালবাসী। সদা সর্বদা বরিশালের উন্নয়ন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, নৌপথ ব্যবহারের মাধ্যমে সড়কপথের ওপর চাপ কমানো, বরিশাল নগরবাসীর স্থায়ী দুঃখ জলাবদ্ধতা দূর করাসহ এককালের নদী-খালের শহর বরিশালের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে যিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তিনি হলেন বরিশালের ডিজিটাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান। জেলাব্যাপী ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের পাশাপাশি সম্প্রতি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে প্রায় দশ হাজার মানুষকে একত্রিত করে নগরীর প্রধান জেল খাল থেকে অবৈধ দখল-দূষণ ও উদ্ধারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তার ব্যতিক্রমধর্মী এ সফল উদ্যোগের ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোন করেও জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামানকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসেই এবার তিনি (জেলা প্রশাসক) নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২২টি মরা খাল দখল-দূষণমুক্ত ও পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ওই সব খাল চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানো হবে। পরবর্তীতে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী খালের সীমানা চিহ্নিত করার পর খালের মধ্যে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। গত ৪ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের সভাকক্ষে এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, এলজিইডিসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের উর্ধতন কর্মকর্তা এবং উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জমান জনকণ্ঠকে জানান, এক সময় বরিশাল নগরীর পারিচিতি ছিল নদী-খালের শহর হিসেবে। অব্যবস্থাপনা ও নজরদারির অভাবে প্রতিটি খাল দখল ও দূষণে নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রতিটি খাল আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। অতিসম্প্রতি জেল খাল দখলমুক্ত করতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সফলতা অর্জন করায় সরকারের উচ্চমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তাই নগরীর অন্যান্য খাল পুনরুদ্ধার ও সংস্কার করে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। নগরীর সবগুলো খাল এ প্রকল্পের আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে গত ৪ অক্টোবর সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা করা হয়েছে। সভায় নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২২টি খাল চিহ্নিত করার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আহসান হাবীবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সূত্রমতে, নগরীর মধ্যকার ২২টি খাল হলোÑ নগরীর ১, ২, ৭, ৮, ৯, ১৯ ও ২০নং ওয়ার্ডের জেল খাল, যা কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে নথুল্লাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত। ১২, ১৪, ২৩, ২৪ ও ২৫নং ওয়ার্ডের সাগরদী খাল, যা কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে চৌমাথার ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত। নগরীর ১, ৩ ও ২৯নং ওয়ার্ডের লাকুটিয়া খাল, যা মরকখোলা পুল থেকে আবেদ আলী শাহ মাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। নগরীর ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের আমানতগঞ্জ খাল, যা কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে মহাবাজ পর্যন্ত বিস্তৃত। নগরীর ১২, ১৩ ও ১৪নং ওয়ার্ডের নাপিতখালী খাল, যা মেডিক্যালের পেছনের বাউন্ডারি থেকে সাগরদী খাল পর্যন্ত বিস্তৃত। কীর্তনখোলা নদী হতে সার্কিট হাউসের পাশ দিয়ে সদর রোড-বিবির পুকুর পর্যন্ত বিস্তৃত ১০, ১৬নং ওয়ার্ডের ভাটার খাল। ১৬, ২৬ ও ২৭নং ওয়ার্ডের ভাড়ানী খাল। কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ৯, ২৩, ২৫ ও ২৬নং ওয়ার্ডের চাঁদমারী খাল। বরিশাল-বানারীপাড়া রোড হতে কুদঘাটা পর্যন্ত ২৭নং ওয়ার্ডের ভেদুরিয়া খাল। ২৯ ও ৩০নং ওয়ার্ডে ইছাকাঠী উত্তর কড়াপুর রাস্তাসংলগ্ন খাল। সিএ্যান্ডবি রোড থেকে ভেদুরিয়া খাল পর্যন্ত ৩০নং ওয়ার্ডের কলাডেমা খাল। চৌমাথা থেকে ভাঙ্গার পুল পর্যন্ত ২২, ২৩ ও ২৭নং ওয়ার্ডের নবগ্রাম খাল। সোনা মিয়ার পুল থেকে কালিজিরা নদী পর্যন্ত ২৬নং ওয়ার্ডের হরিণাফুলিয়া খাল। ৯, ২৩, ২৫ ও ২৬নং ওয়ার্ডের পুডিয়া খাল। পুরানপাড়া রাস্তা থেকে মহাবাজ পর্যন্ত ৩ ও ৪নং ওয়ার্ডের সাপানিয়া খাল। শেরেবাংলা সড়ক থেকে ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত ৪নং ওয়ার্ডের জাগুয়া খাল। নথুল্লাবাদ ব্রিজ থেকে নবগ্রাম পর্যন্ত উত্তর নবগ্রাম সাগরদী খাল। কাশিপুর স্কুল থেকে ভেদুরিয়া খাল পর্যন্ত কাশিপুর খাল। ঠাকুরবাড়ি থেকে দরগাহবাড়ি পর্যন্ত টিয়াখালী খাল। নতুন হাট থেকে বিশ্বাসবাড়ি পর্যন্ত ঝোড়াখালী খাল। ভেদুরিয়া খাল থেকে ডেইরি ফার্ম পর্যন্ত সোলনা খাল। সরেজমিন লাকুটিয়া খালের নতুন বাজার মড়কখোলার পুল থেকে বাঘিয়া মুসলিম গোরস্তান পর্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তা এবং খালপাড়ের মধ্যে খালি জায়গা রয়েছে মাত্র ৩ থেকে ৭ ফুট। এ জায়গা খাল বা রাস্তার মালিকানাধীন, ব্যক্তি মালিকানাধীন কোন জায়গা নয়। অথচ এ জায়গাসহ খালের প্রায় অর্ধেকজুড়ে অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে কয়েক শ’ বসতঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে বেশকিছু ঘর পাকা পিলার বসিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে। খালের অধিকাংশ এলাকার অবস্থা এতই খারাপ যে, দেখলে খালের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করে যাওয়া বরিশাল নদী-খাল রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিপলু জনকণ্ঠকে বলেন, নগরীর ভেতরে মোট খাল ছিল ২৩টি। এরমধ্যে একটি খাল ভরাট করে সড়ক করায় ওই খালটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তাই ২২টি খাল চিহ্নিত করার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক ও সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামানকে সদস্য সচিব করে কমিটি গঠন করা হয়। আগামী সাত দিনের মধ্যে সবগুলো খাল চিহ্নিত করার পর সেখানে সাইনবোর্ড লাগানো হবে। তিনি আরও জানান, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা ও কালভার্ট করায় ভাটার খাল ও সাগরদী খালের নবগ্রাম অংশ (বটতলা বাজার থেকে সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ পর্যন্ত) খালটি বিলীন হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে জেলা পরিষদ ও সিটি কর্পোরেশনসহ যে কোন সরকারী দফতরের খালের ওপর উন্নয়নকাজ করতে হলে অবশ্যই জেলা প্রশাসককে অবহিত করতে হবে। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑ জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা, সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান, বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক শহিদুল ইসলাম, পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক নজরুল ইসলাম প্রমুখ। সভা শেষে খাল উদ্ধারের একমাত্র উদ্যোক্তা ডিজিটাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, জেল খাল উন্নয়নের ২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের সঙ্গে বরিশাল জেলা সদরের সকল খাল উন্নয়নে জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করে বৃহৎ প্রকল্প প্রস্তাব প্রেরণের সদয় আদেশ দিয়েছে সরকার। তাই নগরীর অনুমোদিত মাস্টারপ্ল্যান, খালসমূহের তালিকা ও তফসিল এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে সমন্বয় সভা করা হয়েছে। সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে জনগণের ২২টি খাল উদ্ধার, পরিচ্ছন্ন, উন্নয়ন, ব্যবহার উপযোগীকরণসহ দৃষ্টিনন্দন করার মাধ্যমে পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা হবে।
×