ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘চিত্রনায়ক হতে না পারায় আক্ষেপ নেই’

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১২ অক্টোবর ২০১৬

‘চিত্রনায়ক হতে না পারায় আক্ষেপ নেই’

বয়সটা তাঁর ৫৫। যদিও দেখে এর অর্ধেক মনে হয়। সুদর্শন। বাড়ি ঢাকার ধানম-িতে। ‘জেবি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ’ ফুটবল উপলক্ষে দলের সঙ্গে আছেন চট্টগ্রামে। ফুটবলার ছিলেন। শুরুটা করেন ঢাকার মাঠে। শেষটা হয় চট্টগ্রামের মাঠে। চাকরি করেছেন। আবারও ফুটবলে ফিরেছেন। সফলও হয়েছেন। এখন বিভিন্ন কারণে তাঁর ক্লাব পার করছে ক্রান্তিকাল। তারপরও আশাবাদী তিনি। যার কথা বলছি, তিনি আনোয়ারুল করিম হেলাল। বাংলাদেশ ফুটবলের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত শক্তি শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের ম্যানেজার। হেলাল হতে চেয়েছিলেন চিত্রনায়ক! কিন্তু হননি। হতে চেয়েছিলেন তারকা ফুটবলার। সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছেটাও রূপ নেয়নি বাস্তবে। প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্না ছিলেন হেলালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই গল্পটা কেমন? ‘মান্না ছিল টাঙ্গাইলের ছেলে। খুলনাতে বড় হয়েছে। আমাদের দুজনের এক কমন ফ্রেন্ডের (বাবু, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) মাধ্যমে ওর সঙ্গে পরিচয়, এক আড্ডা থেকে, সেই আশির দশকের শুরুর দিকে। মান্নার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে এফডিসিতে যখন ‘নতুন মুখের সন্ধান’ করা হচ্ছিল, তখন আমরা দুজনেই সেখানে গিয়েছিলাম। ওই সময়টাতে তখন ফুটবল খেলি ধানম-ি ক্লাবে এবং জীবনের সেরা ফর্মে। ’৮৬ ঢাকা লীগে আমি ১৪ গোল করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলাম। আমার চেয়ে তিন গোল বেশি করেছিলেন আবাহনীর শেখ মো. আসলাম।’ যখন রূপালী পর্দায় অভিনয় করার সুযোগ হলো। তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে অবশ্য বিনা অডিশনেই নায়ক হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলো। ‘মান্না ও আমি দুজনেই দেখতে ছিলাম হ্যান্ডসাম ও লম্বা, কথা বলতাম শুদ্ধ ভাষায়, ফ্যাশন-ট্যাশন করতাম। মেয়েরা তো পাগল ছিল আমার জন্য! আমি অবশ্য তাদের পাত্তা দিতাম না (আপনি তো এখনও দারুণ হ্যান্ডসাম ... এটা বলতেই লজ্জায় লাল হলেন হেলাল!)!’ যাহোক, অভিনয় করবেন, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। কিন্তু বাদ সাধলেন ক্লাব সভাপতি খাইরুল আনোয়ার পিয়ারু (হেলালের আপন বড় ভাই)। তিনি হেলালকে নানাভাবে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মাথা থেকে ঝেড়ে নামালেন সিনেমার ভূত। কাজেই সেলুলয়েডের ফিতায় ঠাঁই পাবার সেখানেই ঘটল স্বপ্নের ইতি! মান্না সিনেমায় চলে গেলেন। শুরুর দিকে অনেক সিনেমার দৃশ্যেই দেখা যাবে মান্না ট্র্যাকসুট পড়ে অভিনয় করছেন। ‘ওগুলো সে মাঝে মাঝে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেত। তবে ব্যস্ততার কারণে এবং সময়ের পরিক্রমায় ওর সঙ্গে আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমে যায়।’ হেলালের স্মৃতিচারণ। হেলালের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু পাইওনিয়ার ফুটবলের ডায়নামো স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে, ১৯৮০ সালে। তারপর তৃতীয় বিভাগের দল লালবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলেন। ‘আমার ওস্তাদ ছিলেন মালা ভাই। তিনি আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে প্রথমেই আমাকে দলের ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিলেন। সেবারই আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়। আমাদের দলে তখন কায়সার হামিদ, নাজুসহ অনেক ফুটবলার। যারা পরে ঢাকার ফুটবলের তারকা হয়েছে।’ শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবের সঙ্গে কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন? ‘লালবাগের হয়েই দ্বিতীয় বিভাগের লীগে খেলি। অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। রানার্সআপ হই। তখন আমাদের ১৯৮১ সালে ফেডারেশন কাপে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। তাতে আমরা কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত খেলি। প্রতিপক্ষ আমারই এলাকার ক্লাব ধানম-ি! তাদের ৪ গোলে হারাই। ম্যাচে আমার ছিল জোড়া গোল। এরপরই আমার ওপর চোখ পড়ে ধানম-ি ক্লাবের, মানে পিয়ারু ভাইয়ের। ব্যস, যোগ দিলাম সেখানে। ওটাই আমার শেষ ক্লাব। মালা ভাই অনেক চেষ্টা করেছেন আমাকে তাঁর দলে নিতে, আমি যাইনি। মানে যেতে পারিনি আর কি। ধানম-ি ক্লাবই পরে শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাবে রূপান্তরিত হয় ২০১০ সালে, ক্লাব সভাপতি মনজুর কাদেরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।’ খেলোয়াড়ি জীবনের অবসান ঘটল কিভাবে? ‘১৯৮৬ সাল। ধানম-ি ক্লাবের হয়ে ঢাকা লীগের মৌসুম শেষ করেছি। চলে এলাম চট্টগ্রামে এখানকার লীগ খেলতে। আমার দল ব্রাদার্স ইউনিয়ন। তখন আবাহনীও আমাকে তাদের হয়ে খেলতে ৫০ হাজার টাকার চুক্তি করে। টাকাও পাই। পরে এ নিয়ে তো বিরাট গ-গোল! এ ঝামেলা মেটান আ জ ম নাছির উদ্দিন (বর্তমানে মেয়র)। উনি তখন ব্রাদার্স ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যাহোক, আবাহনীকে টাকা ফেরত দিয়ে দিই।’ তবে এত সহজে ব্যাপারটা হজম করতে চায়নি আবাহনী সমর্থকগোষ্ঠী। তারা হেলালকে নানা রকম হুমকি দিল। চট্টগ্রামে নাকি খেলতেই আসতে দেবে না। বাস আটকে ভেঙ্গে দেবে! ‘ভয় পেয়ে গেলাম। ঠিক করলাম চট্টগ্রাম যাব না। তখন নাছির ভাই নিজ উদ্যোগে আমাকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসেন এবং ব্রাদার্সে সই করান। কেউ আর কিছু বলেনি।’ ব্রাদার্সের হয়ে টানা ছয় ম্যাচ খেলেন হেলাল। কোন পয়েন্ট হারায়নি দলটি। ষষ্ঠ ম্যাচে দলের নির্ভরযোগ্য ফরোয়ার্ড চুঁই আরিফ ব্যথা পেয়ে মাঠ ছাড়ে। আর সপ্তম ম্যাচে হেলাল (প্রতিপক্ষ আগ্রাবাদ নওজোয়ান)। ঘটনার বর্ণনা দেন হেলাল, ‘ব্যথা পাই ডান পায়ে। লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ওটাই ছিল ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। ১৫-২০ দিন হাঁটতে পারিনি। চট্টগ্রামেই ছিলাম। তারপর পিয়ারু ভাই এসে আমাকে ঢাকা নিয়ে গেলেন। অপারেশন করালাম। এরপর আবার চেষ্টা করলাম খেলায় ফিরতে। ট্রেনিং শুরু করলাম। যখনই পুরোপুরি সেরে উঠেছি, তখনই আবার লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেল, এবার বাঁ পা! এই ঘটনায় মন পুরোপুরি ফুটবলের ওপর থেকে উঠে গেল। চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আর খেলবোই না! অথচ তখন আমার বয়স মাত্র ২২-২৩! আরও কিছুদিন খেললে নিশ্চিতভাবেই আবাহনী-মোহামেডানে বা জাতীয় দলে খেলার ডাক পেতে পারতাম। তারকা ফুটবলার হয়তো হতে পারতাম, কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল।’ আজ এত বছর পর আবারও সেই স্টেডিয়ামে এসেছেন হেলাল। এবার দলের ম্যানেজারের ভূমিকায়। সেই শেষ ম্যাচের স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে তাঁকে। খেলোয়াড়ি জীবন খতম। পেট চলবে কি করে? ১৯৯১ সালে হেলাল যোগ দিলেন একটি ব্যাংকে। ‘পোষায় না বলে এক বছর পর ছেড়ে দিলাম। ওই বছরই বিয়ে করি। ব্যবসায় নামলাম। আজ আল্লাহর রহমতে একটা পর্যায়ে এসেছি।’ তবে ফুটবল না খেললেও নিজের অজান্তেই আবারও ফুটবলের সঙ্গে ভালমতোই জড়িয়ে পড়েন হেলাল। ‘ধানম-িতে যেহেতু আমার বাসা, ধানম-ি ক্লাবের যেকোন খেলা হলেই দেখতে আসতাম। ২০০৪ সালে সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে মেরে ফেলে পিয়ারু ভাইকে। এক বছর পর্যন্ত মনোকষ্টে ক্লাবেই যাইনি। তখন ক্লাবে ও এর আশপাশের পরিবেশটা হয়ে ওঠে অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসেবে! তখন ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াসুর রহমান বাবু আমাকে একপ্রকার জোর করেই ক্লাবে নিয়ে আসেন এবং ক্লাবের পরিবেশটা আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সাহায্য চান। তখন আমরা আরও কজন মিলে ক্লাবটার হাল ধরলাম।’ শেখ জামাল ধানম-ি কিভাবে শক্তিশালী দল হয়ে উঠলো? ‘২০০৭ সাল। আমাকে ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হলো। সেবারই ক্লাব সভাপতির দায়িত্বে নিয়ে আসলাম মনজুর কাদের ভাইকে। একসময় ফুটবল সংগঠক ছিলেন, পরে দীর্ঘসময় বিরতির পর আমাদের এই ক্লাবের মাধ্যমেই আবারও ফুটবলে ফেরেন। তিনি আমাকে চ্যাম্পিয়ন দল গড়ার কথা বলেন। ধানম-ি ক্লাব তখন প্রিমিয়ার লীগ খেলতে শুরু করেছে। কিন্তু দল শক্তিশালী না। ফুটবল থেকে দূরে থাকায় তখন কোন ফুটবলারকেই সেভাবে চিনতাম না। খোঁজ নিলাম। সে সময়ের সুপারস্টার গোলরক্ষক আমিনুলের সন্ধান পেলাম। তাকে খেলতে রাজি করালাম। ভাল টাকা দিলাম। এবং আমিনুলকেই দায়িত্ব দিলাম সে যেন সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে আসে। আমিনুল তাই করল। ওই সময়ে জাতীয় দলে খেলা ১৮-২০ তারকা ফুটবলারকে ম্যানেজ করে অসাধ্য সাধন করল! সেই থেকে আমাদের সাফল্যের শুরু। এদেশের ফুটবলে জামালই তখন সবচেয়ে বড় বাজেটের দল গড়ে এবং ফুটবলারদের সর্বোচ্চ পেমেন্ট দেয়ার প্রথা চালু করে। মোট কথা, ক্লাব ফুটবলের সিস্টেমটাই বদলে দেই আমরা।’ শেখ জামালকে সফলতা এনে দিতে গিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি গেছে হেলালের। অনেক সময় দিয়েছেন (এখনও দিচ্ছেন)। নিজের ব্যবসার দিকেও ঠিকমতো সময় দিতে পারেননি। অনেক টাকার ক্ষতিও হয়েছে এজন্য। কিন্তু ফুটবল যার রক্তে, অস্থি-মজ্জায়, সে কি এসব পরোয়া করে? হেলাল অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা, ‘আমি এখানে পড়ে আছি শুধু একটা মানুষের জন্য। তিনি মনজুর কাদের। তাঁর মতো ফুটবল-পাগল মানুষ আরও কটা থাকলে দেশের ফুটবলের চেহারাই পাল্টে যেত। কাদের ভাই আমাকে অনেক আদর করেন। তাঁর মাঝে আমি যেন পিয়ারু ভাইকে খুঁজে পাই!’ আবেগে গলা ধরে আসে হেলালের। ক্যারিয়ারের স্মরণীয় গোল? ‘ধানম-ির হয়ে খেলার সময়টাতে আমরা খেলতাম রেলিগেশন সেভ করার জন্য! সেটাই ছিল প্রধান সংগ্রাম। আজাদ স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে খেলা (সম্ভবত ১৯৮৪-৮৫ সালে)। যারা হারবে, তারাই রেলিগেশনে পড়ে যাবে। বুঝতেই পারছেন, কেমন টেনশনের ম্যাচ! বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ওই ছোট দলের ‘বড়’ ম্যাচ দেখতেই হাজির হয়েছে ১৫ হাজার দর্শক! খেলার আগে ড্রেসিংরুমে পিয়ারু ভাই বললেন, হেলাল, আমার রেলিগেশন নামের ক্যান্সার হয়েছে, এখন তোর দায়িত্ব গোল নামের অপারেশন করে আমাকে বাঁচানো! কিভাবে বাঁচাবি, তুই জানিস! খুবই আবেগপ্রবণ ও উজ্জীবিত হলাম। ম্যাচে ২-১ গোলে জিতি। ম্যাচে ১০ মিনিটের দিকে বিপক্ষ দলের আলমগীর আমাকে বুকে তীব্র লাথি মারে। মাঠেই পড়েছিলাম দশ মিনিট! তারপরও কষ্ট করে পুরো ম্যাচই খেলি। এবং দলের হয়ে প্রথম গোলটিই করি। জিতে আমরা রেলিগেডেট হওয়া থেকে বেঁচে যাই। এছাড়া বেঁচে যাই নিজ ক্লাবের সমর্থকদের হাতে গণধোলাই খাওয়া থেকেও! তাদের প্ল্যান ছিল, হারলে এলাকায় ঢোকামাত্রই আমাদের সাইজ করবে! জেতার জন্য আর মার খেতে হয়নি, বরং পাই প্রশংসা-ভালবাসা। ওই ম্যাচের কথা জীবনেও ভুলব না। মজার ব্যাপার- ওই যে আজাদ রেলিগেটেড হলো, সেই থেকে আজ পর্যন্ত তারা আর উঠতে পারেনি!’ নায়ক হতে পারেননি। তারকা ফুটবলার হওয়ার আগেই সেই স্বপ্ন শেষ। আফসোস হয় না? হেলালের স্বগোক্তি, ‘মোটেও না। অভিনয়ের চেয়ে ফুটবলকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। খেলাটাও বেশিদিন খেলতে পারিনি। কিন্তু একটা ক্লাবের সফল ম্যানেজার তো হতে পেরেছি। এটাই তৃপ্তির। এমন সফলতা আরও চাই।’ আইনী জটিলতায় আট ফুটবলার হারিয়ে শক্তিমত্তা কমে যাওয়া শেখ জামালের ম্যানেজার হেলালের এই স্বপ্ন কি পূরণ হবে?
×