ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

নাসিরের বীরোচিত ফেরা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১২ অক্টোবর ২০১৬

নাসিরের বীরোচিত ফেরা

নাসির হোসেনের ক্ষেত্রে যা হয়েছে সেটি বিরল। এভাবে দিনের পর দিন দলে রেখেও মাঠে না নামানোর উদাহরণ বিশ্ব ক্রিকেটে খুব বেশি নেই। আবার একজন খেলোয়াড়কে খেলানো নিয়ে ভক্ত-অনুরাগী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেভাবে ফুঁসে ওঠে সেটিও কম বিরল নয়! ঘরের মাটিতে দুর্বল আফগানিস্তানের বিপক্ষে একটি ম্যাচ ও ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে হারের পর সেই প্রশ্ন আরও বড় হয়ে ওঠে। অনেকেই তার বাইরে থাকা সহজে সহজভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। প্রথমত সাব্বির রহমানের ওয়ান-ডাউনে উঠে আসার পর টেল-এন্ডে ব্যাট হাতে একজন ‘সলিড ফিনিশারের’ অভাব। প্রতিপক্ষ হিসেবে আফগানিস্তান আর ইংল্যান্ড যেমন এক নয়, তেমনি মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত যে নাসির-মাহমুদুল্লাহর বিকল্প হতে পারেন না, সেটি বুঝতে ক্রিকেট বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, নাসির বাংলাদেশের সেরা ফিল্ডারদের একজন, প্রয়োজনে ব্রেক থ্রু এনে দিতে বল হাতে তার অফস্পিনটা বেশ কার্যকর। সর্বোপরি তিনি একজন দুর্দান্ত এ্যাথলেট। সুযোগ পেয়েই নিজেকে প্রমাণ করেছেন নাসির। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দুর্দান্ত জয়ের পথে পারফর্ম করে ভক্তদের চাওয়ার মূল্য দিলেন। ভয়ঙ্কর ইংল্যান্ড ব্যাটিং-লাইনের সামনে মাত্র ২৩৯ রানের লক্ষ্য দিয়ে জয় পেতে বল হাতে অসাধারণ কিছুই করতে হতো। মাশরাফি কি করেছেন, সেটি সবাই দেখেছেন। নাসিরের বোলিং ফিগার ২০-১-২৯-১। ইকোনমি ২.৯০, যা বাংলাদেশী বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে কম। সাজঘরে ফিরিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে জ্বলে ওঠা মঈন আলীকে। তার আগে ব্যাটিংয়ে অবদান অনেক। ২৭ বলে ২৭ রানের ইনিংসটা হয়ত মাশরাফি-তা-বে ঢাকা পড়ে গেছে। অষ্টম উইকেটে ৬৯ রানের জুটি, পুরো ইনিংসেই সর্বোচ্চ। ১৬৯ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ার বাংলাদেশের অলআউট হওয়াটা সময়ের ব্যাপারই মনে হচ্ছিল। বিপর্যয়ের এই করুণ ছবি বদলে দিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান মাশরাফি-নাসিরের ওই জুটি। যার ওপর ভর করে ২৩৮ রানের সম্মানজনক স্কোর। মাশরফির বলে ইংল্যান্ডের শেষ ক্যাচটা (আদিল রশীদের) নাসিরই নিয়েছেন। নাসির ব্যাটিং করেন, বোলিং করেন, ফিল্ডিং করেন। এক নাসির থাকা মানে তো দলে দুই খেলোয়াড়ের সেবা পাওয়ার মতো। অথচ এই নাসির অনেক দিন ধরে অচ্ছুত। দলে থাকেন ঠিকই, একাদশে সুযোগ পান না। জানুয়ারিতে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে টি-২০ সিরিজ, ফেব্রুয়ারি-মার্চে এশিয়া কাপ ও টি-২০ বিশ্বকাপটা প্রায় বসেই কেটেছে তাঁর। লম্বা বিরতির পর খেলতে নেমে সব অবজ্ঞার কী জবাবটা কিভাবেই না দিলেন। তার আগে একেবারে নাগাল থেকে ফসকে যাওয়া প্রথম ওয়ানডের কথা মনে করলে নাসিরের জন্য এখনও হাহাকারটা প্রবল হয়ে ওঠে। মিরপুরে খেলা দেখে ফেরা অনেক দর্শক সেটি বলছিলেন। জয়ের জন্য শেষ ৫৪ বলে চাই ৪৫ রান, হাতে ৬ উইকেট। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যেখে মনে হচ্ছিল, ইংলিশরাও হয়ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ৪২ ওভারের তৃতীয় বলে সাকিব (৭৯) আউট হলেই বা কি? অপরপ্রান্তে সেঞ্চুরিয়ান ইমরুল কায়েস, হাতে ৫ উইকেট। ম্যাচ তো বাংলাদেশ জিততে যাচ্ছে। কিন্তু ১৭ রানের মধ্যে বাকি সব উইকেট হারিয়ে ২৮৮Ñএ অলআউট, ২১ রানের হার। যার শুরুটা রানের খাতা খোলার আগেই মোসাদ্দেকের (০) ওই বোল্ড দিয়ে...। নাসিরের জন্য হাহাকারটা বড় হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় ১৮ বলের ১১টিতেই ব্যাটে-বলে সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ মোশাররফ! টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে হৃদয় খান খান করে দেয়া ১ রানের সেই হার, ঘরের মাটিতে আফগান-লজ্জা (গিনিপিগদের কাছে এক ম্যাচে হার তো লজ্জারই সামিল!), অতঃপর প্রথম ওয়ানতে এভাবে ইংল্যান্ডকে জয় উপহার দেয়া, দলে একজন দক্ষ ‘ফিনিশারে’ অভাব যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নিকট অতীতে সাফল্যের রঙিন বছরগুলোতে প্রতিনিয়ত নাসির যেখানে সফলতম নাম। ইংল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচে ওভাবে হারের পর একাদশে তার জায়গা না হওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। সাবেক জাতীয় ক্রিকেটার ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার আতহার আলী যেমন বলছিলেন, ‘ভবিষ্যতের কথা ভেবে মোসাদ্দেককে সুযোগ দেয়া ঠিক আছে। কিন্তু একাদশে নাসিরকে প্রয়োজন। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং তিন বিভাগেই সে দারুণ। সেক্ষেত্রে মোশাররফকে বসানো যেতে পারে।’ কাকতালীয়, ঘুরে দাঁড়ানো দ্বিতীয় ম্যাচে সেটিই হয়েছে! প্রথম ম্যাচে ৩ ওভারে ২৩ রান দিয়ে চরম ব্যর্থ স্পেশালিস্ট স্পিনার মোশাররফ ব্যাটিংয়ে ১৮ বলে করেন ৭ রান। ফিল্ডিংয়ে বেন স্টোকসের তুলে দেয়া সহজ ক্যাচ যেভাবে ফেলেছেন সেটি রীতিমতো অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। জীবন পেয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ইংলিশ অলরাউন্ডার। মূলত নাসিরের পরিবর্তে মোসাদ্দেককে খেলানো হচ্ছিল। আফগানিস্তানের বিপক্ষে অভিষেকে ভাল করলেও ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম ওয়ানতে ৯ ওভারে ৫০ রান দিয়ে উইকেটশূন্য। ব্যাটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শূন্যহাতে সাজঘরে ফিরেছেন ২০ বছর বয়সী তরুণ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবে পা রেখেছেন। এত বড় দলের বিপক্ষে চাপটা যে তিনি নিতে পারেননি সেটি স্পষ্ট। অথচ নাসিরের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যায় ম্যাচের খারাপ সমেয় দাঁড়িয়ে যাওয়ার অনেক নজির তার রয়েছে। একজন ‘ফিনিশার’ নাসিরের বিকল্প এখনো খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। বিশ্লেষকরা তাঁকে সময়ের সফল ফিনিশার বলে মনে করেন, সেই তাঁকে দিনের পরদিন বসিয়ে রাখাটা ছিল হতাশার। দেরিতে হলেও যে থিঙ্কট্যাঙ্কদের কানে পানি ঢুকেছে, সেটিই বড় কথা। ‘ব্যাটিং তো অবশ্যই ভাল করেছে। কঠিন ওই সময়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেছে। আমরা সব সময় চাই ৫০ ওভার একটা খেলোয়াড় ব্যাটিং করুক। বোলিং তো আমি মনে করি অসাধারণ। ১০ ওভারে মাত্র ২৯ রান, পাশাপাশি একটি উইকেটও পেয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু চাওয়া কঠিন। সব মিলিয়ে নাসির পেশাদারি পারফর্মেন্স করেছে এক বছর পর ফিরে।’ মিরপুরে জয়ের পর বলেন অধিনায়ক মাশরাফি। আজ শেষ ম্যাচে নাসির আরও বেশি করে জ্বলে উঠবেন, সিরিজ জেতাবেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড়তোলা ভক্তদের তেমনটাই চাওয়া।
×