ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩ অক্টোবর ২০১৬

বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশে বর্তমানে বিবাহিত নারীদের প্রায় ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার। জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে তারা স্বামীর মাধ্যমে অথবা অন্য কারও দ্বারা শারীরিক, মানসিক, যৌন কিংবা অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ভায়োল্যান্স এ্যাগেইনস্ট উইম্যান-২০১৫’ (নারীর প্রতি সহিংসতা) শীর্ষক হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই তথ্য ওঠে এসেছে। দ্বিতীয়বারের মতো এ ধরনের জরিপ করল বিবিএস। এর আগে ২০১১ সালে করা প্রথম জরিপ মতে, বিবাহিত নারীদের প্রায় ৮৭ শতাংশ কোন না কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার ছিল। নতুন জরিপের তথ্য অনুযায়ী, চার বছরে শারীরিক নির্যাতন ছাড়া দেশে সার্বিকভাবে নারী নির্যাতনের হার কমেছে। রবিবার শেরেবাংলা নগরের এনইসি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল হক সরদার প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি জানান, শারীরিক, যৌন, অর্থনৈতিক, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ এবং আবেগীয় নির্যাতনকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এজন্য সারাদেশের ২১ হাজার ৭৭৫ জন নারীর সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ২০১৫ সালের ১৩ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে দেখা গেছে, বিবাহিত নারীদের প্রায় ৫০ শতাংশ জীবনে কমপক্ষে একবার স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আর প্রায় ৭৩ শতাংশ নারী বলেছেন, জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে একবার হলেও তারা নির্যাতিত হয়েছেন। তবে নির্যাতিত হলেও এই নারীরা নির্যাতনের কথা কাউকে জানাননি। আবার শ্বশুর-শাশুড়ির পরিবর্তে নিজের মা-বাবার দ্বারা বেশি নির্যাতনের শিকার হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে জরিপে। স্বামী বাদে নিজের মা-বাবার দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রায় ১৫ শতাংশ নারী। শ্বশুর-শাশুড়ি দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রায় ১০ শতাংশ নারী। এছাড়া নিজের ভাই-বোনের দ্বারা প্রায় ৭ শতাংশ এবং স্বামীর বড় বোন/নিজের দুলাভাইয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩ শতাংশ এবং প্রতিবেশীর মাধ্যমে প্রায় ৯ শতাংশ নারী কোন কোন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের পর আইনী সহায়তা নিয়েছেন এমন বিবাহিত নারীর সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। আর সরকারী ২৪ ঘণ্টার টোলফ্রি হেল্পলাইন ১০৯২১ সম্পর্কে জানে এমন নির্যাতিত মহিলার সংখ্যা মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, হেল্পলাইনের বিষয়টি এখনও ব্যাপকভাবে প্রচার পায়নি। তবে নারী নির্যাতনের হার ধীরে ধীরে কমছে। শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন না হলে পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালায়। তাই এ দুটি ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নারী ও মেয়ে শিশুর পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীরাও নির্যাতনের শিকার। এই বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিতে হবে। জরিপ মতে, উপার্জনের টাকা স্বাধীনভাবে খরচ করতে পারেন এমন নারীর সংখ্যা প্রায় ১৬ শতাংশ। মুসলিম রীতি অনুযায়ী স্ত্রীর দেনমোহরের অর্থ পরিশোধ করা স্বামীর অবশ্য কর্তব্য। তবে জরিপে অংশ নেয়া মাত্র ১৪ শতাংশ বিবাহিত মুসলিম নারী স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহরের সম্পূর্ণ অর্থ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। আর দেনমোহরের অর্থ আংশিক পেয়েছেন এমন মুসলিম নারীর সংখ্যা ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষিত স্বামী ও শিক্ষিত স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে নির্যাতন করার প্রবণতা এবং নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা কম। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আগে মেয়ে সন্তান হলে ছেলে সন্তানের জন্য পুরুষরা একাধিক বিয়ে করতেন। এখন মেয়ে সন্তানের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। এখন নারী উপার্জন করছে। শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে নারী নির্যাতন কমার সম্পর্ক আছে। মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। সারাদেশে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও সচেতন করতে হবে। জরিপে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৫ এই চার বছরে বিবাহিত নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন কমলেও শারীরিক নির্যাতন বেড়েছে। ২০১৫ সালে প্রায় ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৭ শতাংশ বিবাহিত নারী। ২০১১ সালে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের এই হার ছিল যথাক্রমে প্রায় ৪৮ শতাংশ ও ৩৭ শতাংশ। জরিপে বলা হয়, বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মধ্যে স্ত্রীর আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নির্যাতন করা হয় তা ১৫ শতাংশ। এছাড়া জরিপের তথ্য অনুযায়ী ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনে শিকার। জাতীয় পর্যায় ও গ্রাম পর্যায়ে বিবাহিত নারীদের নির্যাতনের হার প্রায় কাছাকাছি। গ্রামের ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনের কোন না কোনভাবে স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ে এই হার ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ। শহরে এই হার ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক নির্যাতনের ক্ষেত্রেও জাতীয় ও গ্রামীণ স্তরের চিত্র প্রায় অভিন্ন। গ্রামের ১২ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার। শহুরে বিবাহিত নারীদের মধ্যে এই হার ১০ দশকি ২ শতাংশ। জাতীয়ভাবে এই হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
×