ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নামীদামী কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসিতে ফল বিপর্যয় মেধাবীদের

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩ অক্টোবর ২০১৬

নামীদামী কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসিতে ফল বিপর্যয় মেধাবীদের

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নামীদামী কলেজ হিসেবে পরিচিত অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই কেবল এসএসসিতে সর্বোচ্চ স্কোর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি করছে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পছন্দ সেই হাতেগোনা কয়েকটি কলেজই। যে কোন মূল্যে সেখানে ভর্তির জন্য অপেক্ষায় থাকেন তারা। কিন্তু খোদ সরকারের এক গবেষণা প্রতিবেদনের চিত্র উল্টে দিয়েছে সব হিসাব-নিকাশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, নামীদামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যারা বেশি পরিচিত তাদের অধিকাংশ কলেজই এসএসসির সর্বোচ্চ মেধাবীদের ভর্তি করালেও এইচএসসিতে সর্বোচ্চ ফল করতে ব্যর্থ হচ্ছে। নামীদামী কলেজে গিয়ে এইচএসসিতে আগের জিপিএ-৫ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা! ফলে যত সংখ্যক জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে এইচএসসিতে তাদের অনেকেই জিপিএ-৫ পাচ্ছে না। অথচ নামীদামী কলেজের প্রথম সারিতে থাকা এসব কলেজের বিপরীত চিত্র দেখা গেছে তুলনামূলকভাবে কম নামডাক থাকা দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির কলেজগুলোতেই। যাদের নামডাক খুব একটা নেই এসব কলেজে এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পেয়েও ঠিকই অসংখ্য শিক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষায় ভাল প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রেও আধিক্য থাকে অপেক্ষাকৃত ছোট কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদেরই। গবেষণার সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারের এ গবেষণা প্রতিবেদন পরিষ্কার করেছে, নানা কারণে নামী কলেজের স্বীকৃতি পাওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান ভাল শিক্ষার্থীদের বেছে বেছে ভর্তি করালেও তাদের শিক্ষাদান পরিস্থিতি ভাল নয়। শিক্ষার্থীদের প্রতি নামী অনেক প্রতিষ্ঠান যতœবান নয়। সর্বোচ্চ মেধাবীদের ভর্তি করিয়ে দায়িত্ব শেষ করে নামীদামী প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই। ফলে এসএসসিতে জিপিএ-৫ নিয়ে সেখানে ভর্তি হলেও এইচএসসিতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছে সে ভাল ফল। বিপরীত দিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির কম নামডাক থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিবাচক শিক্ষাব্যবস্থার সুফল পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীদের ভর্তি করিয়েও এইচএসসিতে ভাল ফল করছে এসব প্রতিষ্ঠান। নামী প্রতিষ্ঠানে যেখানে জিপিএ-৫ কমছে, সেখানে কম নামডাক থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়ছে জিপিএ-৫। গবেষণা প্রতিবেদন পাওয়ার পর রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছে পুরো শিক্ষা প্রশাসন। শিক্ষাবিদরা নামী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের সুপারিশ করেছেন। সেখানে নজরদারি বৃদ্ধিরও সুপারিশ করেছেন তারা। একই সঙ্গে তারা বলেছেন, অনেক নামী কলেজ ভাল শিক্ষার্থী ভর্তির ফলে যে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, গবেষণা প্রতিবেদন তারই প্রমাণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের করা এক গবেষণায় উঠে এসেছে এইচএসসির ফলের ভিত্তিতে করা ব্যতিক্রমী এ তথ্য। গবেষণায় ২০১৩ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হওয়া নামীদামী ১০ কলেজকে সামনে আনা হয়েছে। ২০১৫ সালের এইচএসসির ফলের সঙ্গে আগের ফলের পর্যালোচনা করা হয়। একই সঙ্গে এইচএসসিতে বেশি জিপিএ-৫ পাওয়া ১০ কলেজের ফলের তুলনা করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত বা ছোট কলেজেই ভর্তির তুলনায় পরবর্তীতে জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে। আর এসএসসিতে জিপিএ-৫ নিয়ে নামীদামী কলেজে ভর্তি হলেও এইচএসসিতে তাদের অনেকেই জিপিএ-৫ হারিয়ে ফেলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৩ সালে সরকারী বিজ্ঞান কলেজে এক হাজার ২০০ আসনের সবগুলোতেই জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছিল। অথচ তারাই যখন ২০১৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় বসে তখন দেখা গেল, ওই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই জিপিএ-৫ পায় মাত্র ২৭৩ জন। অর্থাৎ এ কলেজ থেকে জিপিএ-৫ হারিয়ে ফেলেছে ৯২৭ জন। নটর ডেম কলেজে ২০১৩ সালে ভর্তি হয় এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া দুই হাজার ১৩৫ শিক্ষার্থী, যাদের প্রায় সকলেই সকল বিষয়ে এ-প্লাস, যাকে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা বলে থাকেন গোল্ডেন জিপিএ-৫। দুই হাজার ৬০১ আসনের মধ্যে দুই হাজার ১৩৫ জন জিপিএ-৫ ভর্তি করে নটর ডেম। অথচ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পায় তাদের মধ্যে মাত্র এক হাজার ৬৩৭ জন। অর্থাৎ আগের জিপিএ-৫ হারিয়ে ফেলে ৪৯৮ শিক্ষার্থী। আরেক প্রতিষ্ঠান রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ। সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে ভাল ফল করে আলোচনায় থাকে প্রায় প্রতি বছরই। অথচ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে, এ প্রতিষ্ঠানও ভাল শিক্ষার্থীর আগের ভাল ফল ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ২০১৩ সালে এখানে এক হাজার ২৪৯ আসনের মধ্যে এক হাজার ১১৯ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। অথচ এইচএসসিতে তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে মাত্র ৭২২ জন। জিপিএ-৫ হারায় ৩৯৭ শিক্ষার্থী। শহীদ বীরউত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজে এক হাজার ১১০ আসনের মধ্যে ৬৬৫ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পায় মাত্র ২৬৮ জন। আগের ভাল ফল হারায় ৩৯৭ জন। বিসিআইসি কলেজে এক হাজার ৩১০ আসনের মধ্যে জিপিএ-৫ নিয়ে ভর্তি হয় ৫০৬ জন। কিন্তু এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পায় মাত্র ২২৪ জন। অর্থাৎ জিপিএ-৫ হারায় ২৮৩ জন শিক্ষার্থী। সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ হারায় ২৭৯ জন, বেগম বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা কলেজে আগের জিপিএ-৫ হারায় ২৪৭ জন, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজে এসএসসির জিপিএ-৫ হারায় ২২৩ জন। একই ভাবে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ ২০৭ জন এবং রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে জিপিএ-৫ হারায় ১৯৭ জন। এদিকে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে কম নামডাক থাকা অনেক প্রতিষ্ঠানে, যে চিত্রকে আশাপ্রদ বলে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেখানে জিপিএ-৫ না কমে বরং বাড়ছে। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ২০১৩ সালে এক হাজার ৩৮৭ আসনের মধ্যে জিপিএ-৫ নিয়ে ভর্র্তি হয় ৫৭৩ শিক্ষার্থী। বাকি শিক্ষার্থীরা চার, সাড়ে চার বা তারও কম জিপিএপ্রাপ্ত ছিল। অথচ এইচএসসির ফলে গিয়ে দেখা যায়, ওই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই জিপিএ-৫ পায় এক হাজার ৫৭ জন। অর্থাৎ এখানে জিপিএ-৫ বেড়েছে ৪৮৪ জন। ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ৭৮৮ আসনের মধ্যে জিপিএ-৫ নিয়ে ভর্তি হয় ২১৫ জন। বাকিরা ছিল কম স্কোরধারী। অথচ এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পায় ৬৮৫ জন, জিপিএ-৫ বাড়ে ৪৭০ জন। ক্যামব্রিয়ান কলেজে এক হাজার ৪১ আসনের মধ্যে জিপিএ-৫ নিয়ে ভর্তি হয় ২৯৭ জন। বাকিরা ৫-এর কম, এমনকি জিপিএ-৪-এরও কম স্কোর ছিল অনেকের। অথচ এইচএসসিতে গিয়ে দেখা গেল, এখানে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৮৯ জন। অর্থাৎ আগে জিপিএ-৫-এর কম পেলেও এখানে ভর্তির পর এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৯২ শিক্ষার্থী। সামসুল হক খান স্কুল এ্যান্ড কলেজে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ বৃদ্ধি পায় ১৯১ জনের, বিএন কলেজ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জিপিএ-৫ বাড়ে ৭৮ জনের, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৫ জন, আমিরজান কলেজে ২৯ জন, বিএএফ শাহীন কলেজে ২৪ জন, বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজে ১১ জন ও কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে জিপিএ-৫ বৃদ্ধি পায় ১০ শিক্ষার্থীর। এ গবেষণাকাজের সঙ্গে ছিলেন মাউশি অধিদফতরের মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন বিভাগের উপ-পরিচালক কামাল উদ্দিন হায়দার। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাইরে থেকে যে তথ্যই আমরা দেখি না কেন, আসলে কোন কলেজের পড়ালেখার অবস্থা কেমন তা বোঝার জন্যই এ গবেষণা করা হয়েছিল। এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পেয়েও এইচএসসিতে যে ভাল ফল পাওয়া যায় তা অনেক কলেজই প্রমাণ করেছে। আবার নামীদামী কলেজে ভর্তি হলেই যে জিপিএ-৫ পাওয়া যাবে তাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে কোন্ কলেজ কিভাবে পড়ালেখা করাচ্ছে তার ওপরই ভাল ফল নির্ভর করে। কম মেধাবীদের ভর্তি করিয়েও এইচএসসিতে ভাল ফল করার কারণ হিসেবে ক্যামব্রিয়ান কলেজের কর্ণধার লায়ন এমকে বাশার বলছিলেন, আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছিলাম কোন প্রতিষ্ঠান কম মেধাবীদের নিয়েও ভাল ফল করছে, ফলের উন্নতি হচ্ছে তা দেখা দরকার। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের নামীদামী বলে দাবি করে কিন্তু বেছে বেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি করছে ঠিকই। কিন্তু ভর্তি করিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে তারা। পড়ালেখা দিতে তাদের সেখানে আর দায়িত্ব থাকে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমরা সব সময় খেয়াল রাখি এবং চেষ্টা করি কম মেধাবীরা ভর্তি হলেও যেন তারা এখানে আসার পর আরও ভাল করে। আমরা চেষ্টা করি, বাড়তি দায়িত্ব নেই। আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্য একটাই লক্ষ্য যে, আমাদের এখানে যেহেতু কম জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে সেহেতু আমাদের অনেক বেশি কাজ করতে হবে, যাতে জিপিএ-৫ বাড়ে। সরকারের গবেষণার প্রেক্ষিতে ভর্তি পদ্ধতিতেও কিছু পরিবর্তন আনার সুপারিশ করেছেন অনেকে। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ একরামুল কবীর বলছিলেন, আমার মনে হয় নামীদামী হিসেবে যাদের আমরা চিনি-জানি তাদের অনেকেই শিক্ষার্থী ভর্তির পর তাদের প্রতি সেভাবে যতœবান হচ্ছে না। এ কারণে জিপিএ-৫ সেখানে কমছে। আবার যেসব প্রতিষ্ঠানে ভাল পড়ালেখা হচ্ছে সেখানে ভাল ফল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এখন যেহেতু ফলের ভিত্তিতে ভর্তি সেহেতু সব ধরনের স্কোরধারীদের ভাগ করে ভর্তি করা দরকার। যেমন একটি কলেজে কেবল জিপিএ-৫ নয়। বলা দরকার সমপারিমাণ ৪ পাওয়া শিক্ষার্থী, সাড়ে ৪ বা তিন ও সাড়ে তিন বা অন্য স্তরের শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে হবে। তাহলে সব স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়েই পড়ালেখা চালাতে হতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কম মেধাবীদের ভর্তি করে যদি বেশি ভাল ফল করা যায় তবেই তো সেটা ভাল প্রতিষ্ঠান।
×