ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ইলেকটোরাল কলেজ ভোট

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ইলেকটোরাল কলেজ ভোট

বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে বিশ্ববাসীর উৎকণ্ঠা যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র দুটি পদ্ধতিগত ব্যবস্থায় চলে আসছে। একটি হলো- পার্লামেন্টারি ফরম অব গবর্নমেন্ট। এতে প্রধানমন্ত্রী সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যেমন- যুক্তরাজ্য। অপরটি হলো প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গবর্নমেন্ট। এতে প্রেসিডেন্ট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও আমেরিকা প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গবর্নমেন্টে বিশ্বাসী তথাপি আমেরিকান নাগরিকরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে পারে না। তারা কেবল তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত করে থাকেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই মূলত তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে থাকেন। তাই অনেক সময় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রাথমিক পর্যায়েই থেকে যায়। আমেরিকার সংবিধান রচয়িতারা মনে করেছিলেন এত গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ সরাসরিভাবে নির্বাচিত হলে দেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। অর্থাৎ কোন অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন। তাই নির্বাচিত যোগ্য এবং দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরাই আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে থাকেন। ইংল্যান্ডকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়ে থাকে। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট বলে কিছু নেই। মূলত গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রে কোথাও ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পদ্ধতি বলে কিছু নেই। আমেরিকা গোটা বিশ্বের কাছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃত। গণতন্ত্রের পুরোধা, ঐতিহ্যের প্রতীক, গর্বিত মুরব্বি আর উপদেশদাতা যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দেশটির নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। তিনি নির্বাচিত হন ইলেকটোরদের ভোটে। সাধারণ নাগরিকরা ইলেকটোরদের নির্বাচন করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের মোট আসন সংখ্যা ৫৩৮। এই নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল আসন অর্জন করতে হবে। প্রতিটি রাজ্যের জন্য ইলেকটোরাল আসন সংখ্যা রাজ্যটির জন্য বরাদ্দকৃত সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের মোট আসন সংখ্যার সমান। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের ভোট গণনা পদ্ধতি দুটি। একটি হলো মাথাপিছু ভোট, যাকে বলে পপুলার ভোট। অপরটি হলো রাজ্যভিত্তিক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মার্কিন গণতন্ত্রে পপুলার ভোটের চেয়ে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সর্বাধিক পপুলার ভোট অর্জন করলেও তাকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। কিন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট (২৭০) অর্জন করতে সক্ষম হলেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিশ্চয়তা দান করে। উল্লেখ্য, ২০০০ সলে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী আল-গোর ওই সময়ে সর্বাধিক পপুলার ভোট পেয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলের জর্জ বুশ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়েছিলেন ২৭১টি। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ১টি বেশি। আর এতেই তিনি আল-গোরকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত ভাষা দুটি। একটি ইংরেজী, অপরটি হলো স্প্যানিশ। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু ধর্ম এবং বহু বর্ণের সংমিশ্রণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি। একে কসমোপলিটান দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এত ভাষাভাষীর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাই একে ‘ল্যান্ড অব ইমিগ্র্যান্ট’ বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের এই বহুজাতিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ক্ষমতার ভারসাম্যতা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই এই বিশেষ পদ্ধতি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের অন্তর্ভুক্তি। প্রেসিডেন্ট চার বছর, সিনেটর ছয় বছর এবং কংগ্রেসম্যান দুবছর মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে দুটি করে সর্বমোট একশ’টি সিনেটর পদ। সিনেটর পদ নির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু কংগ্রেসম্যান পদ জনসংখ্যাভিত্তিক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আনুপাতিক হারে কংগ্রেসম্যান বৃদ্ধি পেতে থাকে। বর্তমানে গোটা আমেরিকাতে চার শ’ পঁয়ত্রিশটি কংগ্রেসম্যান পদ রয়েছে। পাঁচ শ’ আটত্রিশটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। এই পাঁচ শ’ আটত্রিশটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট মানেই একশ’ সিনেটর এবং চার শ’ পঁয়ত্রিশটি কংগ্রেসম্যান। উল্লেখ্য, তিনটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ওয়াশিংটন ডিসি থেকে নির্ধারিত হয়। যা হোক, বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বিশ্বের সব দেশের জন্যই অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। এ নির্বাচনের ফল আগামী চার বছর বিশ্বের সব দেশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কমবেশি প্রভাব ফেলবে। তবু আমেরিকার জনগণের গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সর্বশীর্ষে। বিশ্বকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগব্যাধির কবল থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, দায়িত্ব ও কর্তব্য অধিক। মূলত আজকের এ আমেরিকার উন্নয়নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল অভিবাসীরই বিন্দু বিন্দু শ্রম, ঘাম ও যথেষ্ট ত্যাগ- তিতিক্ষা রয়েছে- এ কথা অনস্বীকার্য। সন্ত্রাস নির্মূলের নামে গোটা বিশ্বকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়া বা জড়িয়ে ফেলা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পক্ষে সমীচীন হবে না। বরং সমগ্র বিশ্বের মানুষ কিভাবে সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে সেই দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্বদানের দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে গ্রহণ করতে হবে। আগামীতে যিনিই প্রেসিডেন্ট হবেন তার গতিশীল নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নীরবচ্ছিন্ন শান্তি কামনা করছি।
×