ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ত্যাগের উৎসবের মহিমায়

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ত্যাগের উৎসবের মহিমায়

অর্ধশতাব্দীরও আগের কথা। কৈশোর পেরিয়েছি। কোরবানির ঈদ সামনে। আমার জেঠাজি ও বড় চাচা (আমাদের চাঁদপুর অঞ্চলে বাবার বড় ভাইকে জেঠাজি এবং ছোট ভাইকে চাচা বলে ডাকা হয়) কোরবানির গরু কিনতে হাটে যাচ্ছেন। তাদের পেছন পেছন ছুটলাম। প্রথমে মানা করলেও পরে মেনে নিলেন। মনে আছে সেবার আমাদের যে গরুটি কেনা হয়েছিল তার দাম ছিল ৩১০ টাকা। একেবারে বাজারের মাথা। খবরটি গ্রামময় ছড়িয়ে পড়েছিল- বড় মিয়া ৩১০ টাকা দিয়া কোরবানির গরু কিনেছেন। দলে দলে লোক আসছেন দেখতে। আমাদের গরু সবচেয়ে বড় সবচেয়ে দামী। ভালই লেগেছিল মানুষের ওই গরু বিষয়ক আলোচনা। মনের মধ্যে এক ধরনের অহংবোধেরও সৃষ্টি হয়েছিল। আজ এত বছর পর বুঝতে পারছি কি ছেলেমানুষই না ছিলাম সেদিন। কেননা কোরবানির তাৎপর্য লোক দেখানোর জন্য নয়, অহংকারের তো নয়ই। কোরবানি ইসলামী শরিয়ার ৫টি স্তম্ভের অন্যতম : ১. ইমান, ২. নামাজ, ৩. রোজা, ৪. হজ ও ৫. যাকাত। একজন সচেতন মুসলমান মাত্রই ইসলামের এই পাঁচটি স্তম্ভ সম্পর্কে অবগত আছেন বা আছি। অবগত না থাকাটা সবার বড় দৈন্য ও ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অপূর্ণতা। এই ৫টির মধ্যে প্রথমত ৩টি ধনী-দরিদ্র আমির-গরিব সকল মুসলমানের জন্যে সমানভাবে ফরজ বা অবশ্য পালনীয়। চতুর্থ এবং পঞ্চম এই দুটি কেবল সামর্থ্যবানদের ক্ষেত্রে ফরজ। সবার জন্যে ফরজ নয়। যদিও আজকাল দেখা যায় কেউ সরকারী হজ টিমে অন্তর্ভুক্তির জন্যে ধরাধরি করছেন, আবার জামায়াতের মতো সংগঠন (তাদের তো অর্থের অভাব নেই) কিছু কিছু এলিটকে হজে পাঠায় তাদের অর্থে ও পরিচর্যায়। অথচ ইসলাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে একজন মানুষের কি পরিমাণ সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকলে হজ ফরজ হয়। তেমনি ৫ম স্তম্ভ যাকাতও। তবে একটি কথা মানতেই হবে- নিয়ত পরিষ্কার থাকলে (বিশ্বাস করি তা আছেও) হজের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একজন মুসলমানের মনোজগত যে শুদ্ধাচারের অনুভূতি জন্ম নেয়, বিশেষ করে প্রথমে গিয়েই ওমরাহ হজ পালন, জমজমের পানি পান করা, তারপর মীনা-আরাফাত-মুজদালিফা, মানারাত এভাবে হজের একেকটি স্তর অতিক্রম করার মধ্যে এক ধরনের মনোজাগতিক তৃপ্তির সৃষ্টি হয়। যার মূল্য ্অনেক। মূল্য এবং তাৎপর্যবহ। পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ায় সায়ী করার পর কোরবানি দেয়ার মধ্যে আরও বড় ধরনের তৃপ্তি রয়েছে। বিশেষ করে আখেরী নবী তথা সকল নবীর পুরোধা ব্যক্তিত্ব হযরত মুহম্মদ মুস্তফা (সা)-এর রওজা মোবারকের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে পারা বা দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার। এতে মনের আনন্দ যেন বহুগুণ বেড়ে যায়। একজন মুমীন মুসলমানই কেবল এই আনন্দ উপভোগ করতে পারেন বা করতে পারছেন। আমাদের মতো আম মুসলমানও হজ করি। আমাদের হজ কতখানি আল্লাহ পাক কবুল করেন তা কেবল তিনিই জানেন। আমরা জানি হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নির্দেশ দিয়েছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি দিতে। ইব্রাহীম (আ.) তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হিসেবে পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)কে কোরবানি দেবার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তখন হযরত ইসমাইল (আ.) পিতাকে চোখ বেঁধে নিতে বললেন, যেন মনের মধ্যে এতটুকু দুর্বলতা সৃষ্টি না হয়। আল্লাহ পাক হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর আনুগত্য দেখে মুগ্ধ হন এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর পরিবর্তে একটি দুম্বা এনে শুইয়ে দেন এবং তাই জবেহ হয়ে যায়। এই ঘটনার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো : ১. আমাদেরও এই বিশ্ব ব্রহ্মা-ের স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি পুরোপরি আনুগ্যত বা Complete surender to the almighty Allah. ২. আমাদের প্রিয় বস্তু পরিত্যাগ- এ ক্ষেত্রে ধর্মের দৃষ্টিকোণ ওলামা-এ-কেরাম বলতে পারবেন। একজন আম মানুষ হিসেবে আমি মনে করি আমাদের মধ্যে যে কতগুলো লোভ লালসা আছে সেগুলোর কোরবানি দেয়া বা পরিত্যাগ করাও কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য। যেমন: ১. অর্থ লোভ, ২. সম্পদের লোভ, ৩. হজ করলে মানুষ হাজী বা আলহাজ বলবে, এই লোভ, ৪. নামের আগে বা পরে হাজী আলহাজ লেখা যাবে, ৫. হজ করলে ভোটের রাজনীতির জন্য সুবিধা, ইত্যাদি...। এ কথাগুলো এ জন্যে বলা যে, যারা হজ করেন তারা মীনা থেকে শুরু করে সায়ী পর্যন্ত সবাই একই কাপড় পরা। এখানে আমির-গরিব কোন ভেদাভেদ নেই। মুজদালিফায় সবাই একই পোশাকে মাটির উপর খোলা আকাশের নিচে কিছু সময়ের জন্যে নিদ্রা, এ অনুভূতি কেবল মৃত্যুর পর কবরে শয়নের সাথেই তুলনা করা যায়। ভুল হলে আল্লাহ পাক মাফ করবেন। যে কথাটি বলতে চাই তা হলো হযরত ইসমাইল (আ.)কে কোরবানির জন্যে নিয়ে গেলে শয়তান ইসমাইল (আ.)-এর মাতা হযরত বিবি হাজেরা (আ.)কে ধোঁকা দিতে চাইলে তিনি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ একটি অধ্যায় বা হজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জানি না, ওলামায়ে কেরাম কি বলবেন? আমার মনে হয় এই পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের একটি প্রতীকী শিক্ষা দেয়া হয়েছে। যেমন আজকে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যদি কাউকে দলে টানতে চায় তাহলে আমি মনে করি তাকে ঘৃণা করা দরকার। প্রতিরোধ করা দরকার। হজ ছাড়া অন্য সময় পাথর নিক্ষেপের সুযোগ নেই। তবে আমরা তো ইসলামের অপব্যাখ্যাকারীদের ঘৃণা করতে পারি, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনা করতে পারি। তাদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারি। নিদেনপক্ষে তাদের থেকে দূরে থাকতে পারি। একই সঙ্গে নিজের মধ্যকার পশুবৃত্তি, লোভ-লালসা, অন্যায়, অবৈধপথে সম্পদ আহরণ, ঘুষ, দুর্নীতি, নারীর প্রতি সহিংসতা পরিহার, মিথ্যে বলে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ভোট আদায়, অর্থাৎ ভাল মানুষের ভান করা ইত্যাদি মানুষের মধ্যকার খারাপ রিপুগুলোকে কোরবানি দিতে পারি। অর্থাৎ ত্যাগ করতে পারি। আমি ইসলামের অন্যান্য ফরজ বা আরকান আহকাম পালন করলাম না, অথচ বাজারের সবচেয়ে দামী সবচেয়ে বড় গরুটি কোরবানি দিলাম। কোরবানির তাৎপর্যের সাথে কতখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ তা আমাদের ভাবা দরকার। একটি টিভি চ্যানেলে দেখলাম এবার এক কোটি চামড়া সংগ্রহ করা হবে। অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের দেশে এক কোটি পশু কোরবানি হবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিরই পরিচায়ক। এখন প্রয়োজন শুধু ভাল মানুষ হওয়া। এবার মিডিয়ায় অর্থাৎ টেলিভিশনে দেখলাম একটি গরুর দাম হাকা হচ্ছে ২০ লাখ টাকা, আরেকটির দাম ১২ লাখ টাকা। গরু দুটি কত টাকা বিক্রি হয়েছে তা দেখতে পাইনি। কিন্তু যিনি ২০ লাখ টাকা বা ১২ লাখ টাকায় গরু দু’টি কিনেছেন তারা একদিকে ভালই করেছেন। কোরবানির নিয়ম অনুযায়ী মাংস সমান তিন ভাগ করতে হবে- তার মধ্যে একভাগ নিজের খাবারের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এবং এক ভাগ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বিলাতে হবে। এখানে একটি তাৎপর্য হলো গরিব-মিসকিন, যারা বড়লোকদের বাড়ির জিয়াফত ছাড়া কখনও গরুর গোস্ত খাবার সুযোগ পায় না, তারা ঈদ-উল-আযহার কোরবানির সুযোগে ভাল তাজা গরুর অতি উত্তম মাংস খাবার সুযোগ পায়। তবে হ্যাঁ আজকাল মানুষ যেভাবে বিষাক্ত ইনজেকশন বা কেমিক্যালযুক্ত খাবার খাইয়ে গরু মোটা-তাজা করছে তাতে অনেকের মাংস খাবারে স্বাদ মিটে যায়। যে ব্যবসায়ীরা মাছ, মাংস, ফল-ফলাদি, শাক-সবজি, এমনকি দুগ্ধজাত খাবারসহ সবরককম খাবারে ফরমালিন মেশায়, তাদের কাছে ধর্মই বা কি, ঈদ-উল-আযহার ত্যাগের মহিমার তাৎপর্যই বা কি? কোন মূল্য নেই। টার্গেট কেবল পয়সা কামানো। অবশ্য দু’চারজন ভাল মানুষ যে নেই তা নয়, তবে তারা পেছনের সারির বাসিন্দা। জীবন দিয়েও সামনে আসতে পারে না। আজকের বাংলাদেশে যে সংকট সবচেয়ে প্রকট তা হলো সত্যিকার ইসলামের আলোকে জীবনযাপন, সমাজ-নামাজ, রাজনীতি-সংস্কৃতি সবকিছুর চর্চা করা। দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর লোক মানুষ হত্যা করে বেহেশত কিনতে চাচ্ছে। তাদের মগজ এমনভাবে ধোলাই হচ্ছে যে, তারা তা বিশ্বাস করে। এটি রীতিমতো ‘ডেঞ্জারাস’ একটি ব্যাপার। তাদের ভাষায়, একটি মুরতাদ হত্যা করতে পারলে সরাসরি বেহেশতে যাওয়া যায়। তাদের কাছে নিজের মৃত্যুও মৃত্যু নয়- দুনিয়া এবং বেহেশতের মাঝখানে একটি মুহূর্ত। সমাজ, দেশ এবং সর্বপোরি ধর্মের জন্য। পবিত্র ইসলামের জন্য এ যে কত বড় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা তা আমরা কতজন বুঝতে পারি। যে মানুষের মধ্যে মৃত্যুভয় থাকে না, সে ধর্মের নামেই হোক বা অন্য কোন অন্ধবিশ্বাসের নামেই হোক, একটি জাতি বা রাষ্ট্রের জন্য তা রীতিমতো দুশ্চিন্তার বিষয়, যদিও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার জাতিকে এই দুশ্চিন্তা থেকে অনেকাংশে মুক্তি দিয়েছেন, একেবারে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। এজন্য প্রয়োজন সত্যিকার দেশপ্রেম এবং সত্যিকার ধর্মচর্চা। আর এ জন্য নবীকুলের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হযরত মুহম্মদ (সা) জীবন ও আচার-আচরণ আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। কারণ, তাকে বলা হয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সর্বোত্তম উদাহরণ। মাইকেল এইচ হার্ট নামের একজন আমেরিকান ঐতিহাসিক ও গবেষক বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ওপরে জরিপ ও গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন যে, ঐ ১০০ জনের মধ্যে মুহম্মদ (সা) সর্বশ্রেষ্ঠ। যেমন তিনি এভাবে মূল্যায়ন করেছেন : ¸ choice of muhammad to lead the list of the worlds most influential persons may surprise soon readers and way be questionad by others, but he was the only man in history who was supremely successful on both the religions and secular levels of humble origin muhammad founded and promulgated one of the worlds great religions and became on immensely effective popular leaders. Today their team lenturies after his death, his influence is still powerful and pervasiveÕ. ঢাকা- ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×