ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সিরিয়ার অতীত ও বর্তমান ...

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২৪ আগস্ট ২০১৬

সিরিয়ার অতীত ও বর্তমান ...

মানব সভ্যতার সূচনা যেখানে, সেই মেসোপটেমিয়া ও বৃহত্তর সিরিয়া সভ্যতার দোলনা বলে চিহ্নিত। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব দশ শতাব্দীতে সিরীয় সভ্যতার সূত্রপাত। সভ্যতার সুদীর্ঘ পথ অতিক্রমকালে কখনই জনবসতি বিবর্জিত নগর হয়নি দামেস্ক ও আলেপ্পো। ওসমানিয়া তুর্কিরা সিরিয়া দখল করে ১৫১৬ সালে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধকাল পর্যন্ত চারশ বছর প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সিরিয়া ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ছিল। ১৮৩২ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত, আট বছর মিসরের ইবরাহিম পাশার দখলে ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে, পরাজিত ওসমানিয়াদের মধ্যপ্রাচ্যীয় ভূখ- তথা আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য সাইকস-পিকো নামক ইনট্রিকেসির জালে পূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজ ও ফরাসীদের হাতে পড়ে। এই দুই দেশ মধ্যপ্রাচ্যকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার ম্যান্ডেট পায়। লীগ অব নেশনস অনুমোদন করে। সিরিয়া পড়ে ফ্রান্সের ভাগে। অনেক টানাহেঁচড়ার পর, আরেকটি মহাযুদ্ধ (দ্বিতীয়) শেষে, সিরিয়া অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হয় ১৯৪৬ সালে। ২০১০ সালের শেষে আরব বসন্তের আগমন ঘটে। আরব বসন্তের একমাত্র মন্ত্র রেজিম চেঞ্জ। আরব-বসন্তের অনির্বার প্রবাহ সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ইত্যাদি দেশেও মৃদু দোল দিয়েছিল। তারা কোন না কোনভাবে সামলে ওঠে। পরবর্তী সময়ে আরবীয় বসন্তকে রাখা হয় নির্বাচিত কয়েকটি দেশের জন্য। তিউনিসিয়া, মিসর বা লিবিয়াতেও বাসন্তি হাওয়ার ঝাপ্টা এলে সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশ অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল দিয়ে রেজিম হটাও সমর্থন করে। ইসরাইলও ভিন্ন কৌশল অবলম্বনে উৎসাহিত হয়। সর্বশেষ পালা আসে সিরিয়ার। আরবীয় বসন্তের ব্যানারে, ২০১১ সালের মার্চ মাসে সিরিয়ার দক্ষিণাংশে অবস্থিত ছোট্ট শহর দাঁড়াতে স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদের শুরু“হয়। প্রথমদিকে প্রতিবাদটি বাস্তবিকই আদি অকৃত্রিম স্থানীয়রা শুরু করেছিল। কিন্তু রেজিম চেঞ্জ মন্ত্র কম্প্রোমাইজ করে না। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাসন্তি প্রতিবাদ সংক্রামক ব্যাধির মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের মধ্যে সামরিক বাহিনীর কয়েক অফিসার সরকারী বাহিনী থেকে আনুগত্য প্রত্যাহার করে বের হয়ে আসে। তাদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্ত সিরীয় বাহিনী বা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। কিন্তু তারও কয়েক মাস আগে, ২০১১ সালের আগস্টে জন্ম নেয় ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সিরিয়া, সংক্ষেপে এনসিএস। এনসিএস, ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ইত্যাদির জন্ম এবং হেড কোয়ার্টার ইস্তানম্বুলে। ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের এই ভূমিকা গ্রহণ আকস্মিক নয়। লিবিয়া সঙ্কটের নাটের গুরু ছিল কে? ন্যাটোভুক্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি, আর তা শুরু হয় তুরস্কে। খুব দ্রুত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসীর কাল তালিকায় মোটা অক্ষরে লেখা জাবাত আল-নুসরা নামে একটি দলের বোমাবাজির খবর শোনা যায়। বিদ্রোহীরা এই শহরে সেই শহরে ছড়িয়ে পড়ে। খুব কম সময়ের মধ্যেই আদি অকৃত্রিম সিরীয় প্রতিবাদকারীরাও কোথায় যেন হারিয়ে যায়। লিবিয়ার মতো সিরিয়াও সৌদি আরবসহ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশের কাছে বড় সমস্যা হয়ে রয়েছে। লিবিয়াকে দ্রুত তছনছ করা গেছে, সিরিয়াকেও যাবে না কেন! সর্বসম্মতিক্রমে বাশার আল-আসাদ ও তার সরকারকে সমূলে নির্মূলের দায়দায়িত্ব দেয়া হয় তুরস্ককে। সিরিয়ার কথা চিন্তা করেই লিবিয়ার আরবীয় বসন্তের দিনগুলোতে অস্ত্রশস্ত্র ও আল-কায়েদা যোদ্ধাদের মজুদ রাখা হয়েছিল। তুর্কি-সিরিয়া বরাবর দীর্ঘ সীমান্ত উন্মুক্ত। ফলে সঙ্কট শুরু হলে তুরস্ক হয়ে সেগুলো সিরিয়াতে পাচার হতে থাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে দুই-আড়াই বছর পার হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু আসাদ তো সরছে না! তুরস্ক গা লাগিয়ে ঠিকমতো হোমওয়ার্ক সম্পাদন করছে না বলে সমালোচনা হতে থাকে। এর পরের কথাগুলো সবারই কম বেশি জানা বর্তমানে সিরিয়ার উদ্বাস্তু সমস্যা আজ বোধহয় আর কেবল সমস্যা হিসেবে আটকে নেই। সিরিয়া শরণার্থীদের ক্রমেই কঠোর হয়ে ওঠা জীবন হোক কিংবা ছোট্ট আয়লনের জলে ভেসে ওঠা মৃতদেহ, সিরিয়ার ট্র্যাজেডি বোধহয় শেষ হওয়ার নয়। এই ছিন্নমূল মানুষের জীবনের কিছু ছবি যখন হঠাৎ ভেসে ওঠে সংবাদমাধ্যমে, তখন তাঁদের অজান্তেই হয়ত তাঁরা তৈরি করে শিরোনাম। অজান্তেই তাঁদের করুণ অবস্থা দেখে চোখের জল ফেলছে গোটা বিশ্ব। ধুলোয় ঢাকা খালি পা দু’টো চেয়ারের সামনে ছড়ানো। এ্যাম্বুলেন্সের কমলা চেয়ারটা বছর পাঁচেকের খুদে শরীরের তুলনায় অনেকটাই বড়। কপাল থেকে গড়িয়ে নামা রক্ত ঢেকে দিয়েছে মুখের একটা দিক। চুলের ওপরেও পুরু ধুলোর চাদর। সদ্য মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার আতঙ্ক ছায়া ফেলেছে চোখে মুখে। আলান কুর্দির পরে ওমরান দাকনিশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় নতুন মুখ! গত ১৭ আগস্ট বুধবার রাতে রুশ বিমান হানায় ভেঙে পড়ে ওমরানদের বাড়ি। ধ্বসংস্তূপের তলা থেকে তাকে বার করে আনেন উদ্ধারকারীরা। তার পর এ্যাম্বুলেন্সে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। তখনই তোলা হয়েছিল ভিডিওটি। সিরিয়ার সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা সেই ভিডিও ইন্টারনেটে পোস্ট করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায় সেটি। ঠিক যেমন হয়েছিল সিরিয়ার আর এক শিশু, আলান কুর্দির ছবিও। ওমরান এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও আলানকে ছেড়ে যেতে হয় এ পৃথিবী। সিরিয়া ছেড়ে পালাতে গিয়ে শরণার্থী বোঝাই নৌকা উল্টে ডুবে গিয়েছিল বছর তিনেকের আলান কুর্দি। তারপর তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে তার দেহ ভেসে ওঠে। সৈকতে পড়ে থাকা আলানের সেই ছবি স্মৃতি থেকে ধুয়ে যাওয়ার আগেই ভেসে উঠল আরও একটি অসহায় শিশুর রক্তাক্ত মুখ। ওমরানদের বাড়ি আলেপ্পোর কাতেরজি জেলায়। সিরিয়ার অন্যতম বড় শহর আলেপ্পো এক সময় দেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। ২০১১ থেকে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে বাকি সিরিয়ার মতোই গুঁড়িয়ে গিয়েছে শহরটি। বৃহস্পতিবার ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছে আলেপ্পো মিডিয়া সেন্টার নামে সিরিয়ার একটি সরকারবিরোধী সংগঠন। ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, ধ্বংসস্তূপ থেকে ওমরানকে উদ্ধার করে এ্যাম্বুলেন্সের পেছনের আসনে বসানো হচ্ছে। তার কপাল ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কিছুটা যেন হতবাক হয়ে বসে আছে পাঁচ বছরের খুদে। কয়েক সেকেন্ড পরে হাত বুলিয়ে মাথা থেকে রক্ত মোছার চেষ্টা করল সে। হাতে লাগা রক্তের দিকে তাকিয়ে রইল কিছু ক্ষণ। তার পর রক্তমাখা হাতটা এ্যাম্বুলেন্সের সিটে মুছে ফেলল। পরে তার পাশে এনে বসানো হয় আরও দুটি আহত শিশুকে। ভিডিওটি তোলেন মহম্মদ রাসলান নামে এক চিত্র সাংবাদিক। বিমান হানার খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন রাসলান-সহ কয়েক জন সাংবাদিক। উদ্ধার কাজে হাত লাগান তারাও। রাসলান জানান, ধ্বংস্তূপের তলা থেকে প্রথমেই উদ্ধার করা হয় ওমরান, তার বাবা ও তার তিন বোনকে। রাসলানের কথায়, ‘আমরা একের পর এক আহতকে ধ্বংসস্তূপ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ছোটদের সঙ্গে সঙ্গে এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়। তবে ওমরানের মায়ের গোড়ালি কংক্রিটের চাঁইয়ে আটকে গিয়েছিল বলে তাকে বার করতে একটু সময় লেগেছিল।’ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাথায় চোট লাগে ওমরানের। সেদিন রাতেই তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। বুধবারের বিমানহানায় আহত হয় আরও ১২টি শিশু। তাদের সকলেরই বয়স পনেরোর নিচে।
×