ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

নাজমা রহমান ॥ ‘কে রহিবে আর দূর পরবাসে’

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৪ আগস্ট ২০১৬

নাজমা রহমান ॥ ‘কে রহিবে আর দূর পরবাসে’

প্রথম লিখন কার্যকারণবশত অপ্রকাশিত, এই খসড়াও চটজলদি। হয়ত আবেগাক্রান্ত, বিভুঁইয়ে আবেগই পাথেয়, স্বাদেশিকতায় উদ্বেলিত। আপনজনই সখ্যের উৎস। নাজমা রহমান মারা গেছেন। দেশঘর ছেড়ে দূর দেশে, আমেরিকার অঙ্গরাজ্য আরিজোনায়। পরবাসে। নিজের মাটিভূমি-জলহাওয়া থেকে এত দূরে, প্রিয় নারায়ণগঞ্জের, প্রিয় বাংলাদেশের মানুষ তাঁর শেষ বয়সের মলিন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখও দেখতে পেল না। ‘মলিন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট’?- হ্যাঁ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে, একটি মিছিলে, নাজমা রহমান ছিলেন আগুয়ান, পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত, সংজ্ঞা হারান, সুস্থ হলেও স্মৃতিভ্রষ্ট। স্মৃতিহীনতার রোগে দিকশূন্যজ্ঞানহীন। চিকিৎসার জন্য জার্মানি এসেছেন, কন্যা জয়িতা রহমান (সোমা) এবং জামাতা মোহাম্মদ হোসেন (মন্টু)-র নিবিড় সাহচর্য, দেখভালে, উন্নত ডাক্তারি, ওষুধেও সুস্থ নন পুরোপুরি, ক্রমশ অবনতি। এবং এমনই, চেনা মানুষও অচেনা, দূরের বহুদূরের যেন। চুপ থেকে ক্রমশ নিশ্চুপ। প্রায়-নির্বাক। এমন কী ছিলেন কখনও?- না। আঘাত লাঠির নয় কেবল, রাজনীতি থেকেও বিতাড়ন গোপনে, সূক্ষ্ম চাতুরিতায়। ভাবেননি এই পরিণতি। নিজেকে উৎসর্গ করে তুচ্ছ, নিশ্চিহ্ন হয়ে যান নানা ষড়যন্ত্রে। রাজনীতির কালচারই বোধহয় চাণক্যপরম্পরা-নীতি। নাজমা রহমান ছিলেন সংস্কারপন্থী, পছন্দ হয়নি শীর্ষ তথা নেতৃপক্ষের, অলক্ষ্যে মাইনাস হয়ে যান, বলা ভাল, মাইনাস করা হয়। লাঠির আঘাতের চেয়ে মানসিক যন্ত্রণা আরও গুরুতর। নারায়ণগঞ্জ শহরের আওয়ামী লীগের দায় সামলানোই নয় কেবল, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও (১৯৯৭-২০০১) ছিলেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পলিট ব্যুরোতে, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ দফতরের দায়িত্বে। রূপালী ব্যাংকের সার্বিক দেখভালেও। বলছিলেন একবার, ‘ব্যাংকের তত্ত্বাবধায়ন সবচেয়ে ঝুটঝামেলা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, আমলা, মন্ত্রীর হরেক চাপ, নিজের সততা রক্ষা কঠিন। বলছিলেন বার্লিনে, সোমা-মন্টুর আস্তানায়। নাজমা রহমান হালের রাজনীতিক নন। ওকে চিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে থেকে। সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’ করতুম। যেতুম ২৬৩ বংশাল, সংবাদ অফিসে। দেখতুম, আমাদের চেয়ে বছর কয়েক বড়, গাট্টগোট্টা চেহারা, হেসে-খেলে, যেন দিগি¦জয়ী, অফিসে ঢুকছেন একজন, প্রচ- হৈচৈ, হুল্লোড় করতে করতে। তিনি রিপোর্টার। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। বললেন একদিন, ‘তোমার বড় ভাই জিয়া হায়দার আমার অধ্যাপক, তোলারাম কলেজে। স্যার পদ্য লেখেন, তুমিও কি?’ ঘনিষ্ঠতা হলো। এমনই ঘনিষ্ঠতা, বয়সের ফারাক সত্ত্বেও বন্ধু। পুরান ঢাকার অলিগলি চেনান, হিন্দুদের রেস্তরাঁ, মায় পতিতাদের আখড়াও। জিজ্ঞেস করি, আপনি এই আস্তানা চিনলেন কী করে? সরল উত্তর : ‘চিনতে হয়। আমি রিপোর্টার। এসব এলাকায় ক্রাইম প্রায়- নিত্যদিনই, রিপোর্ট করতে আসি। -এসব নিয়ে রিপোর্ট, রাজনীতি নিয়ে রিপোর্ট নয়? মুজিবুর রহমান বাদল : সব ধরনের রিপোর্টেই তালিম নিতে হবে। সন্তোষ দা (সন্তোষ গুপ্ত) বলেছেন, কোন রিপোর্টে কোন রিপোর্টার পোক্ত, যাচাই করবেন। আমি পলিটিক্স নিয়ে রিপোর্ট করব, রাজনীতিকদের হাড়েমজ্জার খবরই আমার উৎসাহ, তালিম নিচ্ছি। সন্তোষ দাও শেখাচ্ছেন, রাজনীতিকদের সঙ্গে কিভাবে মিশতে হবে, ঘনিষ্ঠ হতে হবে, কিভাবে রিপোর্ট করতে হবে। নাম মুজিবুর রহমান বাদল, আমরা নাম দিলুম বাদল রহমান। আপত্তি জানান, বলেন, ‘বাদল রহমান নামে একজন নাট্য চলচ্চিত্রকার আছেন, অতিশয় পরিচিত। ‘বললুম, থাক গে, আপনিই আমাদের বাদল রহমান।’ এই নামেই সাংবাদিক মহলে কেউকেটা। ‘আজ থেকে বাদল রহমান, কেন জানো? বঙ্গবন্ধুর প্রেস কনফারেন্সে গিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, সংবাদ-এর রিপোর্টারের নাম কি?’ -বললাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘নামের আগে শেখ নেই। আজ থেকে তুমি সাংবাদিক বন্ধু বাদল রহমান।’ সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’-এর সদস্য থেকে সাপ্তাহিক ললনা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, দৈনিক গণকণ্ঠ (ফিচার এডিটর) নানা মিডিয়ার জল খেয়ে সংবাদ-এ সাহিত্য সম্পাদক, মুজিবুর রহমান বাদলই প্রথম কংগ্রেটস করলেন, ‘আজ তোমাকে চাইনিজ খাওয়াব।’ পুরানা পল্টনের মোড়ে একটি চাইনিজ রেস্তরাঁ (ঢাকায় তখন একটিই), অচেনা, নিয়ে গেলেন। বাদলের সঙ্গে এক সুবেশ তরুণী। বুঝলুম, বান্ধবী। প্রেম করছেন। বললেন, ‘ওর নাম শিরিন। তোমার উড বী ভাবী।’ জানলুম, ভাল নাম নাজমা। এই নাজমা তখন থেকেই শিরিন আপা। জানলুম, ছাত্র ইউনিয়ন করেন। শ্রদ্ধায় অবনত হই। মনে পড়ে, ছাত্র ইউনিয়নের মিটিংয়ে দেখেছি ওকে, অতীব সুন্দরী, আলাপের সাহস হয় না। বয়স সমসাময়িক, ছোটও হতে পারেন। কিন্তু এমনই গাম্ভীর্য তার, বিনীত স্বভাব, আত্মিকতার পরশ, ‘শিরিন আপা’ ডাকতে বাধ্য হলুম। স্নেহে আবদ্ধ করলেন। বাদল সহকর্মী, বিয়ের আগে, প্রেম ও বিয়ে নিয়ে সবক দেন, ‘তোমার এই শিরিন আপা পারফেক্ট রমণী।’ বাদল ওর মোটরবাইকে, শিরিনকে পেছনে চড়িয়ে ঢাকা শহর দেখান, ‘বুঝলা মিয়া, রাজনীতির বদমাইশি, ফক্কিও শেখাই।’ ঠিক শেখাননি, রাজনীতির বাজে নীতি শেখাননি, বদমাইশি শেখাননি, না- শিখে আখের ঝরঝরে। মরেছেন মানসিক যন্ত্রণায়। বিভুঁইয়ে। দূর দেশে, ভূমিমাটি ছেড়ে। মুজিবুর রহমান বাদলের মৃত্যু ঢাকায়, ১৯৯৬ সালে। অসুস্থ হয়ে বড় মেয়ে তানিয়া রহমান (লুনা)- এর কাছে গিয়েছিলেন আমেরিকায়, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। সম্পূর্ণ সুস্থ না হয়েই দেশে প্রত্যাবর্তন, হেতু ভিন্ন। প্রিয় দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে, স্বাগত জানাবেন। নাজমা রহমানের মৃত্যু আমেরিকায়, কন্যা লুনার কাছে। ঠিক কাছে বললে ভুল হবে। মারা গেছেন হাসপাতালে (বেউড হাসপাতাল)। কয়েকদিন আগেই কার্ডিয়াক হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত। তখনই জীবনদীপ প্রায়- অস্তমিত। ১৮ (আগস্ট) তারিখ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেয়া হয় লাইফ সাপোর্ট চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, কোন প্রকারেই বাঁচানো সম্ভব নয় আর। মৃত্যু যে কোন মুহূর্তে। জামাতা মোহাম্মদ হোসেন মন্টু জানান, ‘রাখা হয় ‘হসপিস কেয়ারে’। এই হসপিস কেয়ার মূলত আসন্ন মৃত্যু পথযাত্রীকে সাইকোলজিক্যাল এবং স্পিরিচুয়াল সাপোর্ট দিয়ে থাকে, মৃতের শান্তি, আরামদায়ক মরণ প্রার্থনা করে। নাজমা রহমানের রাজনীতির হাতেখড়ি ছাত্র ইউনিয়নে। আস্থা ছিল কমিউনিজমের প্রতি। আস্থা ভঙ্গ হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পরে। ন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তখনকার ভূমিকায়। সরাসরি যোগ দেন আওয়ামী লীগে, আওয়ামী লীগের ভয়ঙ্কর দুর্দিনে। সর্বদাই অকুতোভয়। পরোয়া করেননি বিপদ। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আন্দোলনে, রাজপথে, মিলিছে, সংগ্রামে। সংগঠক, দল পরিচালন, দেখভাল, কর্তৃত্বে¡ও ছিলেন সুচারু। আবার, সংসার, সন্তান পালনের ঘরোয়া, পরিশ্রমী জননী। সব বিষয়েই গোছালো, সবকিছুতেই নিষ্ঠাবতী। পৃথিবীতে একজন মানুষও নেই, ছিল না কখনও, আগামীতেও থাকবে না, ভুল করেনি জীবনে, করবে না। নাজমা রহমানও করেছেন, শুধরেও নিয়েছেন, কিন্তু তাঁর কাজ, সংগ্রাম, অবদান মূল্যায়ন করা হয়নি। এই দুঃখ , মানসিক আঘাত, কম নয়। পরিশেষে অবসাদ। মনমনন-মানসিকতায় বিপর্যয়। কষ্টের নানা দিক, নানা পর্ব আছে। আত্মীয়কুল, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন থেকে যদি তাচ্ছিল্য, অবহেলা, করুণা, উপেক্ষা, অপমান ঘন হয়, দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে মানসিক আঘাত ও পীড়ন এতটাই নিদারুণ, জীবনও তুচ্ছ হয়ে যায়। হয়েছিলেন নাজমা রহমান। স্বামীহারা হয়ে নির্বাক হননি, বরং মুখর, সঁপে দিয়েছিলেন নিজেকে, সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে। রাজনীতিই ছিল ধ্যান-জ্ঞান। দেশের কল্যাণে, আওয়ামী লীগের কল্যাণে উৎসর্গিত। তাঁর উৎসর্গ স্মরণীয়, কুর্নিশ জানাই। তিনি বহুধায় একক। নাজমা রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়েছেন, সাহিত্যের ছাত্রী। নারায়ণগঞ্জে, তোলারাম কলেজে বাংলা পড়িয়েছেন, বাংলার অধ্যাপক। ‘অধ্যাপিকা নাজমা রহমান’ নামেও বহুখ্যাত। তোলারাম কলেজেরই এক ছাত্র ভাগ্যান্বেষণে বার্লিনে ছিলেন কিছুদিন, বলেন একবার, ‘নাজমা আপার ক্লাস-লেকচার যদি হুবহু টুকে রাখতাম, ওই লেকচার ছাপিয়েই লেখক হয়ে যেতাম। জটিল বিষয়ও চমৎকার ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করতেন। আপা কেন লিখতেন না, আফসোস।’ মুজিবুর রহমান বাদল-নাজমা রহমানের তিন সন্তান। তিনজনই কন্যা। কিন্তু, নাজমা রহমানের স্নেহের-পুত্র সংখ্যা বিপুল, নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকায়, গোটা বাংলাদেশে। ফেসবুকে তাঁদের শোকবার্তায় উদ্বেলিত হয়েছি। একজন লিখেছেন, ‘আজ থেকে আমি মাতৃহারা, পৃথিবীতে আমার কোন মা নেই আর।’ বাদল-নাজমার ছোট কন্যা বছর কয়েক আগে মারা যান আমেরিকায়, স্বামী শোকের পরে আরও কাতর। প্রথম জামাই মুরাদ, চিত্রশিল্পী, পত্রিকার সম্পাদক, দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত। বড় কন্যা তানিয়া রহমান (লুনা) আরিজোনা, আমেরিকায়। মেজ কন্যা জয়িতা রহমান (সোমা) ফ্রাঙ্কফুর্টে (জার্মানি)। শিরিন আপা (নাজমা রহমান) চলে গেলেন, শ্রদ্ধা-আদর্শ-ভালবাসার মানুষগুলো দ্রুত বিলীন হচ্ছেন, ‘কে রহিবে আর দূর পরবাসে’ (রবীন্দ্রনাথ)। [email protected]
×