ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাম্বা ছন্দে বিলীন জার্মানি, ফুটবলের স্বর্ণপদক ব্রাজিলের

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২২ আগস্ট ২০১৬

সাম্বা ছন্দে বিলীন জার্মানি, ফুটবলের স্বর্ণপদক ব্রাজিলের

আটলান্টিকের কোপাকাভানার ঢেউ আছড়ে পড়ল গোটা ব্রাজিলে। আয়োজন স্বার্থক। গেমসের মহামূল্যবান স্বর্ণপদকটি যে তারাই জিতে নিয়েছে। পেনাল্টি শূট আউটে পাঁচ নম্বর গোলটি করেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। চোখের জলে ভাসালেন মাঠ। সতীর্থদের হাত ধরে উঠে রক্তে লাল হয়ে পড়া চোখ দুইটি জার্সি দিয়ে মুছলেন। যেন অবুঝ শিশুর মতো অঝোর কান্না। আবার শুয়ে পড়লেন মাটিতে। আবেগের এই অশ্রু মারাকানায় দুঃখ ঘুচানোর। তিনি নেইমার। বাকিটা ইতিহাস, ততক্ষণে গোটা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমী মানুষ জেনে গেছেন রিও অলিম্পিক ফুটবলের ফাইনালের টাইব্রেকারে ব্রাজিল ৫, জার্মানি ৪। চারদিন আগে এই মারাকনায় কেঁদেছিলেন পাঁচবারের ফিফা বর্ষসেরা নারী ফুটবলার মার্তা। সেটা ছিল পরাজয়ের, সেমিফাইনালে সুইডেনের বিপক্ষে। আর নেইমারের কান্না বিজয়ের। মাঠে সাক্ষাতকার দেয়ার সময়ও ডুকরে কাঁদতে দেখা গেল ব্রাজিল অধিনায়ককে। ব্রাজিলের জার্সিতে মারাকানার গ্যালারিতে বিস্তীর্ণ হলুদের সম্রাজ্যে উৎসবের মেক্সিকান ঢেউ। আর গোটা রিও যেন উৎসবের নগরী। অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে ব্রাজিলের এই পর্যটক শহর এমনিতেই আলো ঝলমলে। সেখানে আবেগ-আনন্দের বাঁধভাঙ্গা ঢেউয়ে রংধনুর আবীর ছড়িয়ে দিল ফুটবলে সোনার মেডেল। অবশেষে মারাকানায় পারল ব্রাজিল। অপয়া হয়ে যাওয়া এই ভেন্যু পরিণত হলো ’পয়া’য়। সেটা নেইমারদের বদৌলতে। ফাইনালে প্রবল প্রতিপক্ষ জার্মানিকে হারানোর পর অধরা সাফল্যের ঝলকানিতে হাসল এবার মারকানা। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেলেন নেইমাররা। সোনার হরিণ হয়ে যাওয়া অলিম্পিক গেমসের প্রথম স্বর্ণপদক জিতল ব্রাজিল ঘরের মাঠে। সতেরো দিনের গেমসে ব্রাজিলিয়ানদের এত উৎসব করতে দেখা যায়নি কখনও। যা করলেন তারা কাক্সিক্ষত এই পদক জয়ের পর। আসলে ফুটবলের দেশ বলে কথা। ফুটবল দিয়ে বিশ্বে ব্রাজিলের পরিচিতি। ফলে ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার তৃপ্তি তাদের কাছে অনেক মধুর। সে স্বাদই গ্রহণ করলেন শনিবার ব্রাজিলবাসী। সাপ্তাহিক ছুটির কারণে এমনিতেই তিলধারণের জায়গা নেই রাস্তা ও ফুটপাথে। উইকেন্ডে ইউরোপ-আমেরিকায় এটা নতুন কোন চিত্র নয়। পাঁচদিন টানা খাটুনির পর শনিবার রাতভর হৈহুল্লোর নিত্য ঘটনা। এই আনন্দ উপভোগে নতুন মাত্রা যোগ হয়ে পড়ল ব্রাজিলের বিজয়ে। ঘরে থাকা মানুষও জাতীয় পতাকা হাতে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। সবকিছু যেন গেঁথে গেলে এক সুঁতোয়। বাঁধভাঙ্গা আনন্দের ঝরনায় অবগাহন করলেন অবাল-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাই। অন্য ইভেন্টেও স্বর্ণপদক জয় করেছে ব্রাজিল। কিন্তু এ নিয়ে তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়েনি। কিন্তু ফুটবলের সোনার আলোয় আলোকিত করে দিল গোটা রিও। যে কোন গেমসে এ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, জিমন্যাস্টিক্সের যে কদর সে তুলনায় ফুটবলের গুরুত্ব একটু কম, জাতীয় দলের পরিবর্তে যুবাদের লড়াই বিধায়। সেটার ব্যতিক্রম দেখা গেল কেবল ব্রাজিলেই। অলিম্পিকের অন্য দেশের আসরের তুলনায় এবার ফুটবল নিয়ে মাতামাতি বেশ ভালই দেখা গেল। আয়োজক ব্রাজিলের অগ্রযাত্রায় উত্তেজনার পারদ ক্রমেই উর্ধমুখী হয়ে উঠছিল। যে নাটকের শেষ পরিণতি ব্রাজিলের গৌরব গাঁথা, রূপকথার ইতিহাসে। সাফল্যের জন্য শুধু ভাল খেলা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন ভাগ্যের সহায়তায়ও। ভাগ্যদেবী এদিন ব্রাজিলের পাশে ছিলেন বিধায় জার্মানির দুটি প্রচেষ্টা ক্রসবারে লেগে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তা না হলে ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত। তবে সেটা হতো খেলার ধারার বিরুদ্ধে। অতিরিক্তসহ ১২০ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে মাঠে প্রায় এক তরফা রাজত্ব করেছে ব্রাজিল। জয়টা যে তাদেরই প্রাপ্য। আর সেটা নিম্পত্তি হলো টাইব্রেকারে। নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে অমীমংসিত থাকার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে গোল করতে পরেনি ব্রাজিল বা জার্মানি। ফলে দু’দলকে মেনে নিতে হয় টাইব্রেকার নামক নিয়তি। এখানেই ব্রাজিলের স্বপ্নপূরণ। মার খেয়ে গেল জার্মানি। সন্তুষ্ট থাকতে হলো রৌপ্য নিয়ে। নির্ধারিত সময়ের ২৭ মিনিটে অসাধারণ ফ্রি কিকের গোলে সেলেসাওদের লিড এনে দেন অধিনায়ক নেইমার। এরপর খেলার ধারা প্রমাণ করছিল ফাইনালেও হয় তো ভাল ব্যবধানে জিতে যাবে ব্রাজিল। কিন্তু প্রতিপক্ষ যে জার্মানি, ইউরোপের পাওয়ার হাউস। জার্মানদের নাছোড় লড়াইয়ে পাল্টে গেল খেলার চিত্র। ৫৮ মিনিটে সংঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে দর্শনীয় গোল করে জার্মানিকে খেলায় ফেরান অধিনায়ক ম্যাক্স মেয়ার। ১-১ সমতার পর জার্মানি যেন কিছুটা ছন্দ ফিরে পায়। লড়াইটা হয়ে উঠে ধুন্ধুমার। দু’দলের ছোট ছোট পাসের আক্রমণ-পল্টা আক্রমণে দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠে খেলা। কিন্তু গোলের দেখা মিলেনি। অতিরিক্ত সময়েও একই চিত্র। ফলে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ হয় টাইব্রেকারে। যেখানে স্বাগতিক ব্রাজিলের হিরো বনে যান গোলরক্ষক উইভারটন। পঞ্চম শটে নাইলস পিটারসেনের শটের বল অসাধারণ দক্ষতায় রুখে নিয়ে প্রশস্ত করে দেন বিজয়ের পথ। তখনও ব্রাজিলের একটি শট বাকি। আর শেষটা রাঙিয়ে দিলেন খোদ নেইমার। ব্যাস, মারাকানার কান্না বিলীন হয়ে গেল নেইমার বাহিনীর উদ্ভাসিত জয়ে। গেমসের দামী সোনাটা জিতে নিল ব্রাজিল। আর প্রবল আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান নেইমারকে হাসতে দেখা গেল পদকের মঞ্চে। জাতীয় সঙ্গীতের তালে উড়ছিল ব্রাজিলের বিজয় কেতনা।
×