ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গুডবাই বিএনপি

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৩ আগস্ট ২০১৬

গুডবাই বিএনপি

বিএনপি শনিবার ৬ আগস্ট ৫৯২ সংখ্যার চূড়ান্ত জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেছে। কমিটিতে জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধী আলবদর-আল শামসদের ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে জানিয়ে দিল দলটি স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী পলিটিক্যাল অরগানাইজেশন। কোন অবস্থাতেই জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগের সঙ্গ ছাড়ছে না তারা। এ এক অমর প্রেম। এতদিন মুক্তিযোদ্ধার দল (মিলিটারি জিয়া প্রতিষ্ঠাতা) বলে একটা প্রলেপ লাগিয়ে মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে। এবার আর প্রলেপ নয়, সরাসরি। জামায়াত-শিবির এতদিন পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে চলেছে, এবার নিজেদের লোক বংশধরদের যথেচ্ছা হারে ঢুকিয়ে দিয়ে বিএনপির শেষকৃত্য সম্পাদন করল, বিএনপি কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিল। যে কারণে দলের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন খান মোহন শনিবার কমিটি ঘোষণার পরই তাৎক্ষণিকভাবে তার ফেসবুকে লিখেছেন ‘গুডবাই বিএনপি, গুডবাই।’ বিদায়। দীর্ঘ ৩৮ বছরের সম্পর্কের ইতি টানছি আজ। একা মোহনই নন, অনেকেই তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এমনকি চট্টগ্রামের প্রধান নেতা দলের দুর্দিনের কা-ারি আবদুল্লাহ আল নোমানও থাকছেন না বলে মিডিয়ায় এসেছে। এসব দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা থেকে নেয়া। পত্রিকাটি পলিসির দিক থেকে প্রো-বিএনপি। তবু কথাগুলো লিখেছি, কারণ তারাও ৫৯২ সংখ্যক সদস্যবিশিষ্ট ঢাউস কমিটি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘যুদ্ধাপরাধী ইন, বিএনপি আউট’ দেখে অবাক হয়েছে বলতে হবে। অবাক হয়েছেন বিএনপির মারদাঙ্গা নেত্রী সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আশিফা আশরাফী পাপিয়াও। তাকে যেমন দেখা গেছে সংসদের ভেতরে লাগামহীন ভাষায় প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে, তেমনি পেট্রোলবোমার দিনগুলোতে নেতারা যখন ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে আত্মগোপনে তখনও এই নারী নেত্রী রাজপথে লড়াই করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। কোন কিছুই গায়ে মাখছেন না। আরেক সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার চৌধুরী মন্তব্য করেছেন পদ-পদবী বড় কথা নয়, জুনিয়রকে সিনিয়র করে দিলে ইজি হতে পারব না, অপমানবোধ নিয়ে তো আর ভাল কাজ করা যায় না। এমনি ভূরি ভূরি ক্ষোভের বহির্প্রকাশ লক্ষ্য করা গেছে। কমিটি ঘোষণার পর কিছু চুটকিও শোনা গেছে। কেউ বলছেন, বিএনপি যেহেতু রাজপথে মিছিল করার লোক যোগাড় করতে পারে না সেহেতু কমিটির আকার বড় করা হয়েছে, যাতে করে মিছিল করার জন্য লোক ভাড়া করার দরকার পড়বে না, নির্বাহী কমিটির ৫৯২ জন নিয়ে রাস্তায় নামলে এমনিতেই মিছিল হয়ে যাবে। কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৯ (২টি খালি রাখা হয়েছে); ভাইস-চেয়ারম্যান ৩৭ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক উপদেষ্টা পরিষদে ৭৩ জন। স্থায়ী কমিটিতে যে দুটি পদ খালি রাখা হয়েছে কেউ কেউ বলছেন তারেক রহমানের কারাদ- হয়ে গেছে, দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ারও সাজা হয়ে গেলে নেতৃত্বে তুলে আনা হবে দুই পুত্রবধূ অথবা তারেকের স্ত্রী ও কন্যাকে। তারেকের স্ত্রী জুবাইদার রাজনীতিতে আসার সম্ভাবনা নিয়ে সোমবার কেবিনেট মিটিংয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ভালই হবে জুবাইদা রাজনীতিতে এলে। ও অন্তত শিক্ষিত এবং ভদ্র ঘরের মেয়ে।’ শেখ হাসিনার এ মন্তব্যটিকে বিএনপির দুই নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহর ভাল লাগেনি। হান্নান শাহ বলেছেন, জুবাইদা যাতে রাজনীতিতে না আসে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী ঐ মন্তব্য করেছেন। আর গয়েশ্বর বাবুর বডি ল্যাঙ্গোয়েজ টিভি স্ক্রিনে দেখে ও তার কথা শুনে ঘৃণা প্রকাশ করেছে অনেকেই। তবে কেউ কেউ অবাক হয়েছেন এবারের কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের আউট হতে দেখে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। খালেদা নিজেই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যান্টনমেন্ট ছাড়েননি। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে ভারত নিয়ে যাবার জন্য দেখা করলে বরং তিনি জিয়াকেই ফিরে আসার কথা বলেছেন। এ সব কথা গত ৪৫ বছরে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েও কিভাবে শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান কাটাছেঁড়া করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চেয়েছেন তাও বহুবার উচ্চারিত হয়েছে। এমনকি আজ যে জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষটি ডালাপালা ছড়িয়ে গোটা বাংলাদেশকে আচ্ছন্ন করতে চাইছে তার চারাগাছটিও রোপণ করেন মিলিটারি জিয়া। তিনি যদি সেদিন গোলাম আযমের মতো রাজাকারকে (যুদ্ধাপরাধের কারণে নাগরিকত্ব হারায়) দেশে ফিরিয়ে না আনতেন বা শাহ আজিজুর রহমান, আবদুল আলীম, আবদুল মান্নানকে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি না বানাতেন কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াত-মুসলিম লীগকে ফিরিয়ে না আনতেন এবং তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে খালেদা জিয়া যদি নিজামী-মুজাহিদের (দুই আলবদর) মন্ত্রী না বানাতেন, তাদের বাড়ি-গাড়িতে শহীদের রক্তে লেখা জাতীয় পতাকা তুলে না দিতেন, তাহলে শায়খ-বাংলা ভাইদের সৃষ্টি হতো না বা আজকের হলি আর্টিজান বা শোলাকিয়ার ঘটনাও ঘটত না, কিংবা হিযবুল মুজাহিদীন, হিযবুত তাহরীর, হিযবুল ইসলাম, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হামযা ব্রিগেডের মতো জঙ্গী সংগঠনেরও জন্ম হতো না বাংলাদেশে। খালেদা জিয়া যে কতখানি বিকৃত মানসিকতার এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তার কয়েকটি উদাহরণ : . আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় প্রদান শুরু হলে নিজামী-মুজাহিদদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে খালেদা জিয়া বলেছিলেন বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই এবং তিনি ক্ষমতায় গেলে ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেবেন। . গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েদের চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। . এবারের নির্বাহী কমিটিতে রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ও কার্যকর করা অশ্লীল বাচিক রাজাকার সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, জয়পুরহাটের রাজাকার আবদুল আলীমের (ট্রাইব্যুনালে আমৃত্যু কারাজীবন ও সাজা ভোগ অবস্থায় মৃত) ছেলে ফয়সল আলীম, সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ফখরুল ইসলাম (আদালতের নথি চুরির দায়ে কারাবন্দী); ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি আবদুস সালাম পিন্টু; ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার আসামি বাবর,Ñএমনি বহু বিতর্কিত এবং ওয়ার ক্রিমিনাল বা তাদের সন্তানদের অন্তর্ভুক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার রাগ কতখানি এবং কি পরিমাণ বিকৃত তার প্রমাণ হচ্ছে তার ভুয়া জন্ম তারিখ ও ওই তারিখে জন্মদিন উদযাপন। সেই ভুয়া জন্মদিনটি হলো ১৫ আগস্ট, যেদিন বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শোকের দিন। এই ১৫ আগস্ট একদল মিলিটারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত অণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জার্মানিতে ছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সে রাতে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলতুন্নেছা মুজিবকে, যিনি কেবল বঙ্গবন্ধুর জীবনসঙ্গিনীই ছিলেন না, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ও পরামর্শক। তিনি একদিকে যেমন সংসার সামলিয়েছেন, সন্তানদের মানুষ করেছেন, আবার বঙ্গবন্ধু কারাগারে গেলে (বঙ্গবন্ধু জীবনের এক যুগেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন) সংসার এবং রাজনীতি দুই-ই সামলেছেন। সে রাতে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল ও শিশু রাসেলকে। সে রাতে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাই শেখ নাসেরকে, হত্যা করা হয় দেশের সবচেয়ে মেধাবী যুবনেতা ও দক্ষ রাজনীতি সংগঠক বঙ্গবন্ধু ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি প্রগতিশীল রাজনীতিক আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার ৪ বছরের নাতি সুকান্তসহ কয়েকজনকে এবং হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিলকে। এই রক্তঝরা শোকাবহ দিনটিতে (১৫ আগস্ট) খালেদা তার জন্মদিন পালন করে চলেছেন গত প্রায় আড়াই দশক ধরে। যদি এটি তার সত্যিকার জন্মদিন হতো তাহলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু তা তো নয়, বরং তার বিয়ের কাবিনে এক জন্ম তারিখ, স্কুলের খাতায় আরেক জন্ম তারিখ (অবশ্য তিনি স্কুল গ-ি পার হতে পারেননি) এবং কোনটাই ১৫ আগস্ট নয়। তিনি ১৯৯১ সালে যখন সূক্ষ্ম কারচুরির মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন তখন যে বায়োডাটা রাষ্ট্রীয় নথিতে দেয়া হয় তাও ১৫ আগস্ট নয়। পরে অবশ্য দৈনিক বাংলা (লুপ্ত) পত্রিকার একদল তথাকথিত সাংবাদিক প্রথম ১৫ আগস্ট তার জন্মদিন বলে রিপোর্ট ছেপে দিলে তিনি দিনটি পালন শুরু করেন। দিনটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ দিবস। এই মহিলার কৃতজ্ঞতাবোধও নেই। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী জেনারেলের তত্ত্বাবধানে ছিলেন; যে কারণে বিজয়ের পর জিয়া তাকে ঘরে তুলতে অস্বীকার করেন। তখন তিনি দুই সন্তানের হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বঙ্গমাতা বেগম মুজিব ও শেখ হাসিনা তাকে এবং তার সন্তানদের সম্মানের সঙ্গে বাড়িতে রাখেন। পরে বঙ্গবন্ধু জিয়াকে ডেকে এনে খালেদা ও তার দুই সন্তানকে জিয়ার হাতে তুলে দেন। শুনেছি বঙ্গবন্ধু খালেদাকে তাঁর ‘কন্যা’ উল্লেখ করে তার যেন অযতœ না হয় সেজন্য জিয়াকে সতর্ক করে দেন। জিয়াও কম ছিলেন না, এর বিনিময়ে ডেপুটি চীফ অব আর্মি পদ সৃষ্টি করে তাতে বসে পড়েছিলেন। আগে এই পদই ছিল না। খালেদা কতখানি বিকৃত মানসিকতার হলে এবং কতখানি স্বাধীনতাবিরোধী হলে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন না করে ঢাউসমার্কা (এবার বোধ হয় ৭০ কেজি ছাড়িয়ে যাবে) কেক কেটে জন্মদিন পালন করেন। আর তাই প্রতি বছর ১৫ আগস্ট এলে সচেতন বাঙালী জাতি যেমন শোক পালন করে তেমনি খালেদার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। সেই খালেদার কাছে এরচেয়ে ভাল দলের কমিটি আশা করা বেকুবি ছাড়া কিছু নয়। কেউ কেউ বলেন, এই কমিটি হয়েছে তারেক রহমানের ইনস্ট্রাকশন এবং তাতে গয়েশ্বর রায়, শিমুল বিশ্বাস এবং রুহুল কবির রিজভীর তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী। কাগজে বেরিয়েছে ফালু অর্থাৎ মোসাদ্দেক আলী ফালু দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। দল থেকে পদত্যাগ করলে কি হবে, জীবন থেকে পদত্যাগ করছেন না। লোকে বলে ফালুর স্থান তো সবার উপরে, সে নিচে যাবে কেন? ঢাকা : ১২ আগস্ট ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব নধষরংংযধভরয়@মসধরষ.পড়স
×