ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

মেস ছাড়ার নোটিস দিচ্ছেন বাড়ির মালিক ॥ পুলিশ বলছে এমন কোন নির্দেশনা নেই

বাসা নিয়ে বিড়ম্বনায় ব্যাচেলররা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৬ আগস্ট ২০১৬

বাসা নিয়ে বিড়ম্বনায় ব্যাচেলররা

আরাফাত মুন্না ॥ বেলাল নতুন ঢাকায় এসেছেন। চাকরি শুরু করেছেন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে। এলাকার এক চাচার বাসায় উঠেছেন কিছুদিনের জন্য। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় না হওয়ায় এ বাসায় তার বেশিদিন থাকা ঠিক নয় ভেবে এক রুমের সাবলেট বাসা খুঁজছেন ঈদ-উল-ফিতরের পর থেকেই। কী আর করবেন- ব্যাচেলর বলে কেউ তাকে বাসা ভাড়া দিচ্ছে না। সবার এক কথা- ‘ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া দেয়া বিপজ্জনক’। তাই বেলালের সারাক্ষণ একই ভাবনা, কবে বাসা ভাড়া পাবেন? একই ভাবে চাকরিজীবীদের পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও বাসা ভাড়া পাচ্ছেন না বলে অনেকেই অভিযোগ করেছেন। আর যারা ব্যাচেলর বাসায় রয়েছেন তাদেরও বাসা ছাড়ার নোটিস দেয়া হয়েছে। ফলে বাসা ভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার ব্যাচেলর। কল্যাণপুরে জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনার পরপরই ইস্কাটন গার্ডেন এলাকার একটি ভবন থেকে জাহিদ ও সঙ্গীদের মেস ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন বাড়ির মালিক। এমন ঘটনা শুধু ইস্কাটন গার্ডেনেই নয়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়ও ঘটছে। যদিও পুলিশ বলছে, ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ নেই। বাড়িওয়ালাদের কোন ভীতি থাকাও উচিত নয়। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অনেক বাসার সামনের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে- ‘ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া হয় না’। অনেক বাসায় লেখা- ছাত্রছাত্রীদের ভাড়া দেয়া হয় না। অনেক টু-লেটে লেখা- ‘এক রুম ভাড়া হবে, স্বামী-স্ত্রী অগ্রাধিকার’। যদিও ঢাকায় বাসা ভাড়ার এমন নিয়মনীতি অনেক আগেও ছিল। কিন্তু সম্প্রতি গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরে মেসে জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনার পর ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। তাই ব্যাচেলররা বাসা ভাড়ার জন্য শত চেষ্টা করেও বাড়ির মালিকদের মন গলাতে পারছেন না। ব্যাচেলর নাম শুনলেই বাড়ির দরজা বন্ধ হচ্ছে। ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ার প্রলোভন দিয়েও মন গলানো যাচ্ছে না মালিকদের। চাকরিজীবী ব্যাচেলরদের দু-একজন বাসা পেলেও শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন বাড়ির মালিকরা। এদিকে, বাসা ভাড়া দেয়া নিয়ে বাড়িওয়ালারাও বিপাকে পড়েছেন। বাসা ভাড়া দিয়েও নানা ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে তাদের। বিশেষ করে পরিবারসহ যাদের ভাড়া দেয়া হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। তবে ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। এমন ঝামেলার কথা জানালেন মিরপুরের এক বাড়ির মালিক। তিনি তার বাসা ব্যাচেলরদের বেশি ভাড়ায় দেন। কিন্তু সম্প্রতি জঙ্গী হামলার কারণে ভাড়াটিয়াদের নিয়ে অনেক সমস্যায় আছেন। প্রতিদিনই ভাড়াটিয়াদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের নির্দেশনা অনুসারে সব ভাড়াটিয়ার বিস্তারিত তথ্য থানায় জমা দিতে হচ্ছে। তারপরও যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন না। ভাড়াটিয়ার জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়া হলেও তা সত্য না মিথ্যা, সে চিন্তায় থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে কল্যাণপুরের মেসে যৌথবাহিনীর অভিযানকালে ৯ জঙ্গীর মৃত্যুর ঘটনা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর আগে গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় অংশগ্রহণকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। তাই বর্তমানে বাড়ির মালিকরা বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে যেমন সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন, তেমনি জঙ্গীবাদের আতঙ্কও রয়েছে তাদের মধ্যে। ঢাকার বিভিন্ন বাসার মালিকের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ঢাকার বাড়িওয়ালারাই নিশ্চিতে বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না। অনেকে বাধ্য হয়ে ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়া বন্ধ করছেন। বাসা খালি থাকলেও পরিবার ছাড়া ভাড়া দিচ্ছেন না। তবে জঙ্গী আতঙ্কের মাঝে অনেক বাড়িওয়ালা ফায়দা লুটছেন। যেসব বাসায় ব্যাচেলর ভাড়া থাকছেন তাদের ওপর নানা চাপ সৃষ্টি করে ভাড়ার টাকা বেশি নিচ্ছেন। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং সন্ত্রাসীসহ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে বছরখানেক আগে নাগরিক তথ্যভা-ার তৈরির লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ লক্ষ্যে ২০ লাখ ১৫ হাজার ৩৭৪টি ফরম বিতরণ করে রাজধানীর ৪৯ থানা পুলিশ। এর মধ্যে ১৮ লাখ ৪ হাজার ৩১৯ বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার তথ্য পুলিশের কাছে জমা পড়েছে। এ তথ্যভা-ারে ঢাকায় স্থায়ী এবং অস্থায়ীভাবে বাস করা ভূমির মালিক (বাড়িওয়ালা) এবং ভূমি ব্যবহারকারী (ভাড়াটিয়া) উভয়ের তথ্য রয়েছে, যাতে সহজেই যে কোন প্রয়োজনে পুলিশের তথ্য পেতে সমস্যা না হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব তথ্য ডিজিটাল করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হওয়ার জন্য এতদিন ব্যাচেলরদের জন্য বিশেষভাবে রুম তৈরি করে ভাড়া দিতেন বাড়িওয়ালারা। বিশেষ করে নারীদের মেসগুলোতে ভাড়া রাখা হতো দ্বিগুণ। কিন্তু বাসার মালিকরা এখন লাভের দিক না দেখে ব্যাচেলরদের ভাড়া দেয়াটাকে বিপজ্জনক বলেই মনে করছেন। তাই তারা ব্যাচেলরদের বাসা ছাড়ার নোটিস দিতে শুরু করেছেন। এছাড়া অনেক বাড়িওয়ালা বাড়ির কেয়ারটেকারের ওপর নির্ভর করে ভাড়া দিতেন। তারা এখন বাসা ভাড়া দেয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তাই বাধ্য হয়ে নিজেরাই ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, অনেক বাড়িওয়ালা পুলিশের কাছে ভাড়াটিয়াদের তথ্য দিচ্ছেন না। পুলিশও এ নিয়ে সমস্যায় পড়ছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মোঃ মাসুদুর রহমান সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের কোন বিধিনিষেধ নেই। বাড়িওয়ালাদের কোন ভীতি থাকাও উচিত নয়। তিনি বলেন, ‘ভাড়াটিয়া ভাড়াটিয়াই; কে ব্যাচেলর, কে বিবাহিত, সেটা বড় কথা নয়। মূল বিষয়টা হলো ভাড়াটিয়াদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহে রাখা। ব্যাচেলরদের বাসা থেকে নামিয়ে দিতে বা বাড়ি ছাড়ার নোটিস দিতে কোন রকম নির্দেশনা দেয়া হয়নি। বাড়ির মালিক কাকে ভাড়া দেবেন নাকি দেবেন না, এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা শুধু চাই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।’ তিনি আরও বলেন, যাদের কাছেই (ব্যাচেলর-ফ্যামিলি) বাসা ভাড়া দেয়া হোক না কেন, সে তথ্য পুলিশকে জানাতে হবে। যে দু’জন বাড়িওয়ালাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা ভাড়াটের তথ্য জানাননি। এখানে ব্যাচেলর বা ফ্যামিলি ভাড়া নিয়ে কোন ধরনের সমস্যা নেই। সচেতন মহল মনে করে, রাজধানীতে এ আবাসন সঙ্কট সমাধানে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে। সরকারী ব্যবস্থাপনায় আবাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। যারা পড়ালেখা, চাকরি বা ব্যবসার জন্য ঢাকায় আসেন, তাদের অধিকাংশই ব্যাচেলর। সুতরাং অসংখ্য ব্যাচেলরের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে এ সমস্যার আশু সমাধান করতে হবে। উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলা হয় এবং পরে কমান্ডো অভিযানে জঙ্গীরা নিহত হয়। এছাড়া গত ২৬ জুলাই রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে একটি বাসার মেসে ‘জঙ্গী আস্তানা’য় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় ৯ জঙ্গী নিহত হয়।
×