ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভেজালে বিপন্ন জীবন

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৬ জুলাই ২০১৬

ভেজালে বিপন্ন জীবন

আমাদের রসনা তৃপ্তি ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য আমরা যা মুখে তুলছি সবগুলোতেই ভেজালের অস্তিত্ব বিরাজমান। ভেজালে ভেজালে জীবন অতিবাহিত করছেন এ দেশের মানুষ। ঘুষ-দুর্নীতি, জোর-জবরদস্তি, ছিনতাই-চাঁদাবাজির মতো সামাজিক অস্থিরতার আরেকটি বড় ক্ষেত্র হলো ভেজাল। মানবিক বিপর্যয়ের এই অনৈতিক কর্ম থেকে মুক্ত হতে পারছে না বাংলাদেশ। যতদিন যাচ্ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর মাত্রা। ভেজালের বৃহৎ রাজ্যে অসহায় সাধারণ মানুষ। অনেকটা জেনে-শুনে-বুঝে সবাই হাতে নিচ্ছে ভেজাল মিশ্রিত যে কোন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভেজাল নামক মনুষ্যসৃষ্ট ভয়াল দুর্যোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারছে না কেউ। যেন মৃত্যুর পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ খোঁজা! এক কথায় ভেজালে ভেজালে ছেয়ে গেছে চারপাশ। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি, বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি। ভেজাল খেয়ে আস্তে আস্তে অকেজো হচ্ছে কিডনি, লিভার, পাকস্থলী, হৃৎপি-সহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। শুধু তাই নয়, মরণ ব্যাধি ক্যান্সারও ডেকে আনছে এই ভেজাল খাবার। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, এসব খাবার খেয়ে অধিকহারে নানাবিধ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম, অর্থাৎ শিশুরা। এছাড়া পরিবর্তন আসছে মানুষের গড়নে। বাড়ছে খর্বকায় মানুষের সংখ্যা। মোটা হয়ে যাচ্ছে শিশু। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও যাচ্ছে কমে। নানা সমস্যার গ্যাঁড়াকলে নিমজ্জিত বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা হলো ভেজাল। সংবাদপত্রের পাতা ভরে প্রতিনিয়তই প্রকাশিত হচ্ছে এ সম্পর্কিত নেতিবাচক সংবাদ। সেখানে চোখ রেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হয় সর্বদা। ভাবনার অথৈ সাগরে ভেসে ভেসে চিন্তক মন খুঁজে ফেরে একটু স্বস্তির জায়গা। কিন্তু কোথায় সে ভাবনাহীন ক্ষেত্র? ভাবনামগ্ন প্রশ্ন, আসলে কি খাচ্ছি আমরা? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর পথ-খাবারের ৫৫ শতাংশে নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে। এসব খাবার বিক্রেতাদের ৮৮ শতাংশের হাতেও নানাবিধ জীবাণু থাকে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, পচন রোধে ব্যবহৃত ফরমালিন এখন মেশানো হচ্ছে মাছ, দুধ, মিষ্টি ও ফলে। বাহারি কৃত্রিম রং মেশানো হচ্ছে সবজি, ফল ও মিষ্টিতে। গুঁড়া মসলায় মেশানো হচ্ছে ইটের গুঁড়া ও কৃত্রিম রং। খাদ্য ও পানীয়তেও মেশানো হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রং। আম, পেঁপে, কলা, টমেটো প্রভৃতি কৃত্রিমভাবে পাকাতে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ইথ্রেল ইত্যাদি। শুঁটকি মাছে মেশানো হচ্ছে কীটনাশক ডিডিটি। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল আতঙ্ক। ভেজালহীন কিছু খুঁজে পাওয়া বর্তমান বাস্তবতায় দুষ্কর। আমরা জানি বাঁচতে হলে খেতে হবে। এখন বাস্তবতা এমনই যে, ভেজাল মিশ্রিত খাবারই খেতে হবে। এখান থেকে উত্তোরণের সন্তোষজনক কোন পথ খোলা নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে উদাসীন। কিছুদিন পর পর নামমাত্র অভিযানে নামে তারা। অভিযানের ফলে দেখা যায়, অমুকের অত টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন টেলিভিশন পর্দায় সংবাদ শিরোনামে ভেসে উঠছিল ‘খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের ৫টি বেকারি ও সেমাই কারখানার ১৪ জনকে ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।’ একজন সুস্থ মানুষকে পঙ্গু ও চিরতরে মেরে ফেলার জঘন্যতম কাজে লিপ্ত অপরাধীদের সামান্য টাকা জরিমানা করেই শেষ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানুষ হত্যার শাস্তি যদি হয় মৃত্যুদ- তাহলে অসংখ্য মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা মুনাফালোভীদের শাস্তি কি অল্প অর্থদ-! যাদের ভেজাল মিশ্রিত উৎপন্ন পণ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ আর লাভবান হচ্ছে ওই অসাধু চক্র, তারা শাস্তিস্বরূপ কিছু টাকা জরিমানা দিয়েই পেয়ে যাচ্ছে আরও ভেজালের নিশ্চয়তা। তাই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ভেজালকারীরা। এদের থামাতে হলে প্রয়োজন কঠোর আইন। লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে ভেজাল দমানো সম্ভব নয়। অর্থদ-ের পাশাপাশি কারাদ-ের রীতি রেখে আইনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আস্তে আস্তে হয়ত কমে আসবে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকা-। ভেজালে জড়িত অপরাধীরা সাধারণ মানুষকে ভেজাল নামের বিষ খাইয়ে যেমন আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি তাদের নীতি বিবর্জিত ভেজাল কর্মকা- থেকে বাদ পড়ছে না মায়ের গর্ভের শিশুও। চিকিৎসা ও পুষ্টি বিজ্ঞানীরা ভেজালের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক নিয়ে বলেছেন, গর্ভবতী মায়েরা যেসব ভেজাল খাবার খাচ্ছে এর নেতিবাচক প্রভাব শিশুর ওপর পড়ে। গর্ভবতী মায়েরা বেশি ভেজাল খাবার খেলে গর্ভস্থ শিশু আক্রান্ত হয়। এর ফলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। সাম্প্রতিক অপরিণত শিশু জন্মের হার বেড়ে গেছে। জন্মের পর শিশুর নানা অঙ্গের অপরিপক্বতা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া নবজাতক আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগ-ব্যাধিতে। এসব হচ্ছে ভেজাল পণ্যের প্রভাবে। ভেজালের প্রভাবে শিশুরা শুধু মায়ের গর্ভেই আক্রান্ত হচ্ছে না, জন্মের পর ভেজাল খাবার খেয়ে বড় হচ্ছে। ২০১২ সালে দিনাজপুরের একটি বাগানের রাসায়নিক মিশ্রিত বিষাক্ত লিচু খেয়ে ১৪ শিশুর করুণ মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালে একই জেলায় কীটনাশক মিশ্রিত লিচু খেয়ে প্রাণ হারায় আরও আট শিশু। ২০০৯ সালে ধামরাইয়ে ৩ এবং ২০১৩ সালে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিষাক্ত খাবার খেয়ে ১৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। আর সারা বাংলাদেশের সমগ্র হিসাব একত্রিত করলে আরও ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল) চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফুলকপি, বেগুন, লালশাক ও শিমের মোট ১০৮টি নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করে। এতে ২৭টি ফুলকপির মধ্যে আটটিতে ম্যালাথিয়ন, ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন মিথাইল ধরনের কীটনাশক জাতীয় পদার্থের ক্ষতিকর মাত্রার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই আটটির মধ্যে চারটি কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়। এগুলো সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১২ থেকে ৩৬ গুণ বেশি মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। পাইকারি বাজার থেকে সংগৃহীত ফুলকপিতে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ৮ এবং খুচরা বাজারে ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণায় বেগুনের ২৭টি নমুনার মধ্যে ১২টিতে কুইনালফস নামে ক্ষতিকর পদার্থ পাওয়া গেছে। প্রতি কেজিতে কুইনালফস ১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১২৮ দশমিক ২৮ মিলিগ্রাম পর্যন্ত, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১৪ গুণ বেশি। শিমের ২৭টি নমুনার মধ্যে ৯টিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ডাইমেথয়েট পাওয়া গেছে। এটি সহনীয় মাত্রার ২০ গুণ বেশি। এক কেজি শিমে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ডাইমেথয়েট সহনীয়; কিন্তু এগুলোয় পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৪২৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। ক্লোরোপাইরিফস ও মেটালাক্সিলও পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। লালশাকের ২৭টি নমুনার মধ্যে মাত্র তিনটিতে ক্লোরোপাইরিফস পাওয়া গেছে। এগুলোয় এর উপস্থিতি ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২৮ থেকে ৩১ গুণ পর্যন্ত বেশি। প্রতি কেজি লালশাকে ৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্লোরোপাইরিফস সহনীয়। কিন্তু এগুলোয় পাওয়া গেছে ১৫৭৭ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। এই যদি হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজার ব্যবস্থা তাহলে মানুষ কি খেয়ে জীবন ধারণ করবে? ভেজাল বিস্তৃত স্বদেশ দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, শুধু কি বাংলাদেশেই ভেজালের বিষক্রিয়া লক্ষণীয়, না অন্য কোথাও এর ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে। যতটুকু জানা যায়, বাংলাদেশে যেভাবে প্রকাশ্যে ভেজালের কারিগররা মানুষ ঠকানোর ঘৃণ্য অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোন দেশে এই অসাধু তৎপরতা নেই বললেই চলে।
×