ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাদারীপুর

খননের পরও মরা খাল নিম্নকুমার

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৩ জুলাই ২০১৬

খননের পরও  মরা খাল  নিম্নকুমার

মাদারীপুর অঞ্চল এক সময় নদ-নদী আর বিল-বাঁওড়ের জনপদ হিসেবে খ্যাত ছিল। পদ্মা, আড়িয়ালখাঁ, কুমার, ময়নাকাটা ও পালরদী এ জেলার প্রধান নদ-নদী। এছাড়া বাঘিয়ার বিল, লখন্ডার বিল, পিতাম্বর বিল, শশীকর বিল, গৈদির বিল, জয়ার বিল, জুয়ারিয়ার বাঁওড়, পাঁচখোলার বাঁওড়. বিল পদ্মার মতো বড় বড় বিল বাঁওড় ছিল জেলার সম্পদ। এ সব নদ-নদী, বিল বাঁওড় শুকিয়ে সরু খালে পরিণত হয়েছে। ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে জেলার নদ-নদী, বিল বাঁওড়। মাদারীপুরে নদ-নদীকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছিল বড়-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশী-বিদেশী বৃহৎ কোম্পানিগুলো এখানে ব্যবসা করতে এসেছে। তখন আড়িয়ালখাঁ নদীর তীরে প্রাচ্যের দ্বিতীয় ডান্ডি হিসেবে খ্যাত চরমুগরিয়া বন্দর ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির প্রধান কেন্দ্র। এখানে বাণিজ্য করতে এসেছে বিড়লা, ইস্পাহানী, গজরাজ, বসরাজ, পান্নালাল, সরজ মল, নাগর মল, চুনিলাল আগরওয়ালার মতো বড়-বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়ী। তখন ব্রিটিশ, ইউরোপ, ভারত, চায়না, জাপান থেকে বড়-বড় জাহাজ এসে নোঙ্গর করত চরমুগরিয়া বন্দরে। আড়িয়ালখাঁ ও কুমার নদের মোহনায় রাশিবাবু বাজারে ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম স্টিমার ঘাট। এই স্টিমার ঘাট থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য বোঝাই করে অস্টিচ, মেঘলা, শিউলী, কিউই, লালি, সান, সাগরের মতো বড় বড় জাহাজ ছেড়ে গেছে বিদেশের উদ্দেশ্যে। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই নয় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌপথ। চল্লিশের দশকেও মানুষের যাতায়াতের জন্য সড়ক পথ ছিল না। পদ্মা, আড়িয়ালখাঁ, কুমার, ময়নাকাটা ও পালরদী ছিল স্টিমার, লঞ্চ ও নৌকা চলাচলের সচল নৌরুট। অর্থাৎ নদ-নদী ছিল এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ। এসব উত্তাল-খরস্রোতা নদ-নদী পাড়ি দিতে পাকা মাঝি-মাল্লাদেরও বুক দুরুদুরু করে কেঁপেছে। নদ-নদীর পাশাপাশি এ জেলার বিল-বাঁওড় ছিল যাতায়াত, উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও মৎস্য সম্পদ ভা-ারের জন্য খ্যাত। চল্লিশের দশকের পর থেকে শুরু হয় ভাঙ্গা গড়ার খেলা। এ ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় এবং প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে ধীরে-ধীরে খরস্রোতা নদ-নদী শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হতে থাকে। যার কোনটা অস্তিত্ব সঙ্কটে আবার কোনটা সরু খালে পরিণত হয়েছে। এখন সেই সব উত্তাল নদ-নদীর বুকে বালুচরে গড়ে উঠেছে বসতি। যা দেখে এখন বোঝার উপায় নেই যে, এই সব জনবসতি এক সময় প্রবল উত্তাল ও খরস্রোতা নদ-নদী ছিল। পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকে জেলার নদ-নদী শুকিয়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় আড়িয়াল খাঁ তীরের চরমুগরিয়া নদী বন্দর, শিবচরের শিবচর ও উৎরাইল নদী বন্দর, কুমার নদের তীরের টেকেরহাট নৌবন্দর, ময়নাকাটা নদীর তীরের বরহামগঞ্জ, চান্দেরচর, উমেদপুর, পালরদি নদীর তীরের তালতলা, ফাসিয়াতলা, কালিগঞ্জ, ঝুরগাঁও, সাহেবরামপুর, সিডিখান, সন্নাসীরচর, নাওডোবা, বহেরাতলা, খাশেরহাট, ভাদুরী, আউলিয়ারচর, কালিকাপুর, ছিলারচর, লক্ষ্মীপুর, শেখপুর, খেজুরতলা, মাদ্রা, ফরাজীরহাট, গোবিন্দপুর, খোয়াজপুর, মহিষেরচর, জাজিরা, ভা-ারীকান্দি, নাওয়াড়া, হোগলপাতিয়া, জাফরাবাদ, ধুরাইল লঞ্চঘাট। ষাটের দশকে পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে শিবচর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন। এছাড়া মাদবেরচর ও বন্দরখোলা ইউনিয়নের বড় একটা অংশ পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে পদ্মার বুকে জেগে ওঠে বিশাল চর যা চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন। গড়ে ওঠে জনবসতি। সেই থেকে পদ্মানদী মাদারীপুর অংশ দুটি সরু খালে পরিণত হয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় বয়ে যাচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে ড্রেজিং করে কোন রকমে নৌ-চলাচল সচল রাখা হচ্ছে। মাদারীপুরের নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে বহু আগে। বন্ধ হয়ে যায় নদীনির্ভর কলকারখানা, পাট আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। যে কারণে দেশী-বিদেশী বড় বড় ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো এ অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এ অঞ্চলের মানুষ। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের মধ্যে জেলার ১৪০ বর্গ কিলোমিটার নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। নদ-নদীর অস্তিত্ব টিকে আছে সরু খালের ধারায়। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায় মাদারীপুর-টেকেরহাট নৌপথ নি¤œকুমার নদের ১৮ কিমি। ৬৬ বছর পর বর্তমান সরকারের আমলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে নি¤œকুমার নদ ড্রেজিং করে টেকেরহাটের মূল কুমার নদের সঙ্গে সংযোগ করে দেয়া হয়েছে। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×