ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী পুলিৎজার বিজয়ী সাংবাদিক সিডনি শেনবার্গ

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১১ জুলাই ২০১৬

চলে গেলেন একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী পুলিৎজার বিজয়ী সাংবাদিক সিডনি শেনবার্গ

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্কিন সাংবাদিক এবং নিউইয়র্ক টাইমসের সাবেক প্রতিনিধি সিডনি শেনবার্গ মারা গেছেন। শনিবার নিউইয়র্কের পগকিপ্সি শহরে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। গত মঙ্গলবার তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন বলে তার এক বন্ধুর বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস এ খবর দিয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে হানাদার পাকি বাহিনীর সংঘটিত নির্মম গণহত্যার খবর প্রকাশ করে তিনি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ঢাকায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর তিনিই প্রথম বহির্বিশ্বে প্রচার করেন। বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু সিডনি শেনবার্গ মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘ডেটলাইন বাংলাদেশ: নাইন্টিন সেভেন্টিওয়ান’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। বইয়ের ভূমিকায় লেখা হয়েছে, সাংবাদিক সিডনি শেনবার্গ ঢাকায় থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাকে বহিষ্কার করে। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কৃত হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরে যাননি শেনবার্গ। নিউইয়র্ক টাইমসের দিল্লী ব্যুরো চীফ হিসেবে তিনি বারবার ফিরে আসেন সীমান্ত এলাকায়। কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ঢুকে পড়েন মুক্তাঞ্চলে, প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধ অপারেশন, ঘুরে দেখেন শরণার্থী শিবিরগুলো। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা সফর করেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের এমন একটি গ্রামও নেই যেখানে পাকিস্তানীদের হাতে কোন মানুষ মারা যায়নি।’ শেনবার্গের মতে, ‘বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে কমপক্ষে ৩০ লাখ লোক নিহত হয়েছেন।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকারের অনুমতি নিয়ে জুন মাসে পুনরায় বাংলাদেশে আসেন শেনবার্গ। তবে ঢাকা থেকে তার করা প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হয়ে ফের তাকে এ দেশ থেকে বের করে দেয় পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ। পরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত অভিযানের সঙ্গী হয়ে যশোর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন শেনবার্গ, ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের সাক্ষীও ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ এ কম্বোডিয়ায় গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া এই মার্কিন সাংবাদিক একাত্তরে বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানীদের গণহত্যার বিবরণ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি তখন নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি ছিলেন। পরে যুদ্ধের খবর সংগ্রহে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় যান শেনবার্গ। পঁচাত্তরে কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ শাসনামলে গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহের সময় সহযোগী ডিথ প্রাণের গেরিলাদের হাতে বন্দী হওয়া ও সেখান থেকে বেঁচে আসা নিয়ে ‘দ্য ডেথ এ্যান্ড লাইফ অব ডিথ প্রাণ’ শিরোনামে একটি বই লেখেন তিনি। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত ওই বই নিয়ে পরে ‘দ্য কিলিং ফিল্ডস’ চলচ্চিত্র হয়। ১৯৫৯ সালে কপি লেখক হিসেবে নিউইয়র্ক টাইমসে যোগ দেয়ার পর ২৬ বছর সেখানে কাজ করেন শেনবার্গ। পুলিৎজার ছাড়াও জর্জ পোল্ক মেমোরিয়াল পুরস্কারসহ সাংবাদিকতার অনেক সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের শোক ॥ বাসস জানায়, মার্কিন সাংবাদিক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সিডনি শেনবার্গের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর নেতৃবৃন্দ। তারা তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক সিডনি শেনবার্গের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জীবন বাজি রেখে দীর্ঘ ৯ মাস তিনি ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধের প্রতিবেদন লিখে গেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের খবর তিনি তার লেখনীর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা হিসেবে তিনি ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পাকিস্তানী গণহত্যার খবর প্রথম সারা বিশ্বে প্রচার করেন। শেনবার্গ ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লেখেন। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম নেতৃবৃন্দ এই আদর্শবাদী ও ত্যাগী সাংবাদিকের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।
×