ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৫ জুন ২০১৬

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ও একরৈখিক চিন্তাভাবনা

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পোষকতায় জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া বা মিসরে তা হয়নি। এবং জঙ্গীবাদকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যারা সহায়তা করেছে সেই জামায়াতে ইসলাম রাষ্ট্রের সব জায়গায় নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে অর্থ ও প্রচারের মাধ্যমে। সামরিক সামন্তবাদী পৃষ্ঠপোষকতায় যাদের বিকাশ তারা সব সময় ধর্মকে এভাবেই ব্যবহার করেছে। এবং লক্ষণীয় যে, প্রায় দেশে তারা সাধারণের মাঝে মোহ বিস্তারের জন্য কিছু শব্দের পুনঃপুনঃ ব্যবহার করে। যেমনÑ খিলাফত, উম্মাহ, আল্লাহর আইন প্রভৃতি। ধারণাটি এ রকম যে, বর্তমান ব্যবস্থার বিকল্প বা যেখানে জনসাধারণ নিষ্পেষিত হবে না। কায়রোর আল আজহারের শিক্ষক আলী আবদুর রাজিক লিখেছিলেন, কোরানের কোথাও খিলাফতের কথা নেই। হাদিসেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এবং খিলাফত ছিল সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং কিভাবে তা আল্লাহর অনুমোদন পেতে পারে? সমস্যা হচ্ছে এ যুক্তি কেউ শোনেনি। খিলাফতের প্রবক্তা আইএসের উদ্ভব হয়েছে এবং পৃথিবীর আনাচে-কানাচে তার সমর্থক জুটে গেছে। ফলে এখন শক্তি প্রয়োগে তা দমনে সবাই একমত হচ্ছে। রাজিকের ভাবশিষ্য আল আজহারের আরেক অধ্যাপক খালিদ মুহম্মদ খালিদ লিখেছেন, বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণ মোল্লাতন্ত্র। কারণ, এরা ‘অনিবার্য পরির্তনবিরোধী। সুতরাং আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার তাদের কাম্য হতে পারে না। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র অসাম্যের, অবিচারের ও স্বৈরাচারের সূতিকাগৃহ।’ বাংলাদেশে মোল্লাতন্ত্র সব সময় শাসকদের প্রশ্রয় পেয়েছে দেখে আজ তারা সংগঠিত। সাধারণে তাদের প্রভাব এখনও যে বেশ তা অস্বীকার করা যাবে না। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এখনও মোল্লাদের ফতোয়া কার্যকর করা হয়। হাইকোর্ট এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার পরও সরকার তা কার্যকর করেনি। ‘ইসলামী’ অনেক দেশেই এই সমস্যা আছে। তবে লক্ষণীয় যে, সাময়িকভাবে এটি প্রভাব বিস্তার করলেও অন্তিমে এ বিষয়ে সাধারণের মোহ হ্রাস পেতে থাকে। ইরান বা ইন্দোনেশিয়া তার উদাহরণ। এর সঙ্গে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নও চলে আসে যা আগে উল্লেখ করেছি। ধর্ম যে জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারে না তার উদাহরণ পাকিস্তান (বাংলাদেশ)। ধর্মের অতিব্যবহারের ফলেই বাঙালী ১৯৭১ সালে তিতিবিরক্ত হয়ে শুধু যুদ্ধ নয়, সংবিধানেই ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করেছিল। জোয়ারদারও একই যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘এটা যদি সম্ভব হতো তবে দুনিয়ার মুসলমানরা এত স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিভক্ত থাকত না বা মুসলিম দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে কলহ-দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত না।’ আবু জাফর শামসুদ্দীনের উপন্যাসের নায়ক দরিদ্র মুসলমান যুবক মামুন তার বন্ধুদের সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনার সময়ে বলে, ‘এটা সাম্রাজ্যের যুগ নয়Ñ জাতীয়তাবাদের যুগ। কওমি শাসনের যুগও নয়। ধর্মীয় সম্প্রদায় জাতি নয়। ধর্ম, ভাষা, আঞ্চলিকতাবোধ, সমষ্টিগত সাধারণ অর্থনৈতিক স্বার্থবোধ এবং অভিন্ন সাংস্কৃতিক চেতনা প্রভৃতি সবকিছু মিলিয়ে জাতি। ভারতীয় জাতি ভারতের স্বাধীনতা ভোগ করবে।’ সময় গত শতকের চল্লিশ দশক। সুতরাং এ বিষয়ে দ্বন্দ্ব বাংলাদেশে অনেক কাল থেকেই চলে আসছে এবং এই চিন্তাকে মোল্লাবাদীরা হটাতে পারেনি। জোয়ারদার বিভিন্ন ইসলামী দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রায় দুই দশক আগে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন এখনও তা প্রযোজ্য। তিনি লিখেছেন, প্রধান সমস্যা হলো ‘বিজ্ঞান শাসিত পৃথিবীতে যে কোন ধর্মের মতো ইসলামেও প্রধান সমস্যা এর মর্মবাণীকে মধ্যযুগীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে পৃথক করা।’ এবং মুসলিম দেশগুলোর জন্য কল্যাণকর কোন মীমাংসায় যদি পৌঁছতে হয়, তবে গণতন্ত্র, মানবতাবাদ ও বিজ্ঞানের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে ‘ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।... এই কাজটি না করা হলে মুসলিম জগতের রাজনীতি একদিকে স্বৈরতন্ত্র ও অন্যদিকে মোল্লাতন্ত্রের মধ্যে দোলায়িত হতে থাকবে।’ এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচ্য। বিভিন্ন সূত্র থেকে স্পষ্ট হয় যে, জঙ্গীবাদের মূল পৃষ্ঠপোষক মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ, যার মধ্যে প্রধান সৌদি আরব এবং পাকিস্তান। জঙ্গীরা সৌদি আরবীয় সংস্কৃতি বা ওয়াহাবিবাদ দ্বারা প্রভাবিত। তারা এখানে বিভিন্ন চালু ফারসী শব্দও বদল করছে। যেমনÑ ‘খোদা হাফেজ’-এর পরিবর্তে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বা নামাজ-এর পরিবর্তে ‘সালাত’। জামায়াতে ইসলামীও এসব শব্দ চালু করেছে। তারা এটাই বোঝাতে চাচ্ছে, ইসলাম আরবের। সুতরাং আরবী শব্দ ব্যবহারেই পুণ্য। লক্ষণীয় যে, নিকট বা মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশ ছিল গরিব উপনিবেশ সেখানেই এই মিলিট্যান্সি প্রবল। যেমনÑ সৌদি আরব, লিবিয়া বা সুদান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়ন এবং পাশ্চাত্যের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ইসলাম/মুসলিম হচ্ছে সন্ত্রাস-সন্ত্রাসীদের সমার্থক। সুতরাং জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটেছে। কিন্তু আমি আগেই উল্লেখ করেছি, এদেশে আরবী থেকে ফারসী সংস্কৃতির প্রভাব বেশি, ঐতিহাসিক কারণেই। ওয়াহাবি মতবাদও এখানে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বর্তমানে এই দ্বন্দ্ব প্রবল এবং ওয়াহাবিবাদের বিরুদ্ধে অন্য ‘ইসলামপছন্দ’ দল/গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই দ্বন্দ্বে জঙ্গীবাদ/ওয়াহাবিবাদ খুব সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। আর পাকিস্তান মানস তো আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ সব বিষয় সম্পর্কে বিএনপি জামায়াতের পক্ষাবলম্বী সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা জানেন না তা নয়। কিন্তু কেউ তা বলেন না। এমনকি ঐক্য পরিষদেও নাম এনে এদের দোষারোপ করেননি। এটা কি বলব। সুশীলদের বিষয়টি বুঝি, তারা ইজতিহাদ মানলে, শেখ হাসিনার পক্ষ নিতে হয় সেটি তারা পারবেন না। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সরকার সব কিছু করে দেবে এ ধরনের চিন্তা নিয়ে এগোনো যায় না। আমাদের বলা দরকার, লড়াইটা এখন হচ্ছে বাঙালী সত্তায় যারা বিশ্বাসী তাদের সঙ্গে পাকিস্তানীমনা বাঙালীদের। এখানে দরকার, বর্তমান সরকারের সাহায্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া কোন সমাধান নয়, যেটি স্বদেশ রায় তার লেখায় দেখিয়েছেন। হ্যাঁ, বলতে পারেন সরকার এ ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা। সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা জঙ্গী দমন করতে চাচ্ছেন। সেটি একটি পথ তো বটেই কিন্তু একমাত্র নয়। এখন সিভিল সমাজের অনেকেই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, এর সঙ্গে দরকার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এর সঙ্গে যুক্ত, আওয়ামী লীগে বিএনপি-জামায়াতের নিঃশর্ত প্রবেশ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা, দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং জোটের মধ্যেও পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ না করা। আমরা অনেক আগে বলেছিলাম, মহল্লায় মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের আত্মম্ভরিতার কারণে তা হয়নি। এখন সময় এসেছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া। লাখো ইমামের ফতোয়া যেমন মানস জগতে আধিপত্য বিস্তারে একটি কৌশল তেমনি কৌশল হবে মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন, বাংলাদেশের ইতিহাস বাধ্যতামূলক করা যাতে নবীনরা বুঝবে কেন এবং কিসের ভিত্তিতে এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সংখ্যালঘুদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। তবে, এটাও মনে রাখতে হবে, ক্রসফায়ার [যার অনুমোদন আমরা করি না গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে] বা ধর্ম দিয়ে ধর্মীয় এ অনাচার রোধ করা যাবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়েও নয়। অন্তিমে এ লড়াই মনের জমি দখলের লড়াই। সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান্তরালে সাংস্কৃতিক জিডিপি বৃদ্ধির প্রয়াস। মনোভূমি যা হাতছাড়া হয়ে গেছে ১৯৭৫ সালের পর সেটি দখল করাই আমাদের বড় লড়াই। শেখ হাসিনা সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারী দলের আত্মম্ভরিতা আছে। তারা যদি এসব বিষয় অনুধাবন না করে তাহলে এ কঠিন লড়াই জেতা তাদের অসম্ভব হয়ে উঠবে। গণতন্ত্র সজীব রাখে সিভিল সমাজ। তাকে গুরুত্ব না দিলে গণতন্ত্র বা এই সরকার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। শেখ হাসিনার সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু তার বিরুদ্ধে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিলে অন্তিমে কেউই লাভবান হবে না। শেখ হাসিনা হারলে বা ব্যর্থ হলে, ইজতিহাদ হারবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হারবে, বাংলাদেশ হারবে। জিতবে পাকিস্তান। সেটিই কি কাম্য আমাদের? এ ধরনের পরিস্থিতিতে অসাধারণ কবি নজরুল আজ থেকে ৮০/৯০ বছর আগে লিখেছিলেনÑ “হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।” ॥ আট ॥ এই পরিচ্ছেদ না লিখলেও চলত। তারপরও একাডেমিক প্রয়োজনে ও সামগ্রিকতার খাতিরে লিখছি। কারণ, ঐক্যপরিষদ, তাদের ও অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটি যা আগে আলোচিত হয়েছে। তবে, পাঠক, ইচ্ছে হলে এই পরিচ্ছেদ পড়তে পারেন, নাও পারেন। বাঙালী মানস সজীব। কখনো কখনো পিছু হটে গেলেও প্রতিরোধের যে শক্তির কথা আগে উল্লেখ করেছি তা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। প্রথমে যদি ধর্মের কথা আসে (ইসলাম) তা হলে বলতে হয় রাষ্ট্রীয় পোষকতা ছাড়া ইসলামকে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। সামরিক শাসকরা এটি করেছিল ধর্ম ও শক্তি (অস্ত্র) দিয়ে মানুষকে দমানোর জন্য। ১৫ বছর আগে (১৯৯০) সামরিক শাসকদের উৎখাত করে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। নানা দোলাচলে থাকলেও সংসদ আর উৎখাত করার সাহস কেউ দেখায়নি এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষ তা মেনে নিয়েছে। সজীবতার ও জনমানুষের শক্তির এটি একটি উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় পোষকতা না পেলে এবং জঙ্গীদের (ও এর সহায়ক শক্তি) যথার্থ বিচার হলে জঙ্গীবাদও আর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। ধর্মের প্রবল প্রচারের কারণে অনেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি মেনে নিচ্ছেন, মন থেকেই, কিন্তু দেখা যায় দৈনন্দিন জীবনে তা পুরোপুরি কার্যকর করা যাচ্ছে না। এখনও বিয়ের অনুষ্ঠানে আলপনা না থাকলে বিয়ে সম্পূর্ণ হয় না (জঙ্গী বা চরম ডানপন্থী ছাড়া)। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে আলপনা থাকেই। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন জারির পর ১৯৭৬ সালে তা বন্ধ ছিল কিন্তু পরের বছরই শিল্পী হাশেম খানের নেতৃত্বে গভীর রাতে শহীদ মিনারে আলপনা আঁকা হয় এবং বর্তমানে ইসলামী জোট সরকারও (২০০১-২০০৬) তা বন্ধ করার সাহস দেখায়নি। জামায়াত সরকারে থাকলেও প্রবল প্রতাপে দেশজুড়ে যে ফ্যাশন শো ও উৎকট পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যে প্রদর্শন চলছে সে ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ, ‘ইসলামী দেশগুলোর’ ওপর মার্কিনী আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও তারা চুপ। পহেলা বৈশাখ পালন আইয়ুব আমলে শুরু হয়েছিল বাঙালীর প্রতিবাদ হিসেবে, আজ যা বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব। জঙ্গীরা বোমা মেরে মানুষ মেরেও তা বন্ধ করতে পারেনি। একুশ শোকের মাস হলেও তা সাংস্কৃতিক উৎসবের মাস। এখনও লৌকিক ইসলামের অনেক উপাদান যেমন-মিলাদ, মাজার, চেহলাম কিছুই উৎখাত করা যায়নি, এমনকি মাজারে, মেলায় বোমা মেরেও। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভাষায়, বাংলাকে বদলাতে হলে এবং বাঙালী মুসলমানকে সমসাময়িক সময়ের মধ্যে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে ইজতিহাদের পথে অগ্রসর হতে হবে। হাজার বছরের ইতিহাসে যা সম্ভব হয়নি তা ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক ও আধাসামরিক বা জঙ্গী সমব্যথী সরকারের ত্রিশ বছরের ‘প্রজেক্ট’ কিভাবে সম্ভব হবে? যদি মুসলিম মানসের ওপরও কেউ জোর দেন তাহলে ঈটনের ভাষায় বলতে হয়, ‘What made Islam in Bengal not only historically successful but a continuing vital social reality has been its capacity to adopt to the land and the culture of its people, even while transforming both.’ বাঙালীর জীবনে এসব ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু বাঙালী মানসে তা গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি, করবেও না। সময়ের ব্যাপার মাত্র। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য। ঐতিহাসিক বাংলাদেশের যে বিবরণ দিয়েছি তার অনেক বদল হয়েছে। নদী মরে যাচ্ছে, গ্রাম-শহরের পার্থক্য কমেছে, জনসংখ্যার ঘনত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি, নগরায়ন হচ্ছে দ্রুত। কৃষি এখনও অর্থনীতির ভিত্তি তবে এর পদ্ধতি ও সম্পর্কের বদল হচ্ছে। ফলে এখানে গোঁড়া ধর্মবাদের আধিপত্য আরও হ্রাস পাবে। দ্’ুদশকের মধ্যে যারা স্বাধীনতা বিরোধিতায়, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও দ্বিখ-িত জাতীয়তার প্রবক্তা ও প্রভাবশালী তারা থাকবেন না বা অকার্যকর হয়ে পড়বেন। বাংলাদেশ এখনই গোলকানয়নের সঙ্গে যুক্ত, তখন সেই যুক্ততা বৃদ্ধি পাবে। তখন জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব হ্রাস পাবে বা থাকবে না। থাকতে পারে না। বাংলাদেশকে বাঙালীর রাষ্ট্র হয়েই থাকতে হবে। এ ভূখ-ের ইতিহাস হচ্ছে, বিভিন্ন সম্প্রদায় এখানে বাস করছে, বৈরীভাবে নয়। হয়ত স্বতন্ত্রভাবে কিন্তু পারস্পরিক আদান-প্রদান রহিত ছিল এ সাক্ষ্য ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। সেই ইতিহাসই রূপান্তরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, যা হচ্ছে আমাদের ইতিহাসের মূলধারা। ইতিহাসের পরম্পরা তাতে ব্যাহত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই ইতিহাসের মুখোমুখি হতেই হবে এবং এর ভিত্তি সেই ১৯৭১ সালের মতো অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বোধ যা হচ্ছে আধুনিকতার মাপকাঠি। ইতিহাসের সত্য হলো, বাংলাদেশ কখনও সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদের দেশ হয়ে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশ কখনও সম্পূর্ণভাবে হিন্দুদের দেশ হয়ে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে একমাত্র বাঙালীর রাষ্ট্র হিসেবেই। বাঙালী মানসও তা-ই বলে। (সমাপ্ত)
×