ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিটি ক্রসফায়ারের তদন্ত করার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২২ জুন ২০১৬

প্রতিটি ক্রসফায়ারের তদন্ত করার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

শংকর কুমার দে ॥ প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ঘটনার তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব-সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে নিহত ঘটনাগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। বিচারিক তদন্ত (জুডিশিয়াল এনকোয়ারি) ও বিভাগীয় তদন্ত (ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি) এই দুই পদ্ধতিতে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রায় ৭৫ জন নিহত হয়েছে। যারা নিহত হয়েছে তারা জঙ্গী, সন্ত্রাসী, ডাকাত, দুর্বৃত্ত বলে অভিহিত করেছে পুলিশ। গত সাড়ে ৩ বছরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে এ ধরনের ৪৫৬ জন। মাদারীপুরের জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর সদস্য ফাইজুল্লাহ ফাহিম ও ঢাকায় জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য শরীফ ওরফে মুকুল রানা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো নানা ক্রসফায়ার গল্প বলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তদন্তে দায়ী ও দোষীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্র জানান, মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে জবাই করে হত্যার চেষ্টার সময়ে তার ওপর হামলার ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেফতার হওয়া হিযবুত তাহরীর সদস্য গোলাম ফাইজুল্লা ফাহিম পুলিশ রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনাটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই প্রশ্নের উত্তর না মিলতেই ঢাকায় জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য শরীফ ওরফে মুকুল রানা ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকা-কে বিভিন্ন মহল থেকে অভিহিত করা হলে প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানান, চলতি বছরের ২০ জুন পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে বা পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়েছে ৭৫ জন। আগের বছর ২০১৫ সালে নিহত হয়েছে ১৮৩ জন, এর আগের বছর ২০১৪ সালে নিহত হয়েছে ১২৮ জন, এর আগের বছর ২০১৩ সালে নিহত হয়েছে ৭২ জন। গত সাড়ে তিন বছরে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ার এবং পুলিশের হেফাজতে ৪৫৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের গল্প হচ্ছে একই রকম। পুলিশের গল্প বা দাবি সত্য বলে ধরে নিলে তাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিবে। কেননা এতগুলো হত্যাকা-ের পরও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে তাদের দেখা যায়নি। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানান, গত ৫ জুনে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু টার্গেট কিলিং বা গুপ্তহত্যার শিকারে পরিণত হওয়ার বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ঘটনা বেড়ে যায়। অবশ্য এর আগেই সুন্দরবনের জলদস্যুদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটতে থাকে। দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দুবর্ৃৃত্ত দলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি অনুযায়ী ক্রসফায়ারে দুবৃৃর্ৃৃত্ত পরিচয়ের ব্যক্তিরা নিহত হচ্ছেন। আহত হচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধারের দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্বৃত্ত গ্রেফতার করতে গেলে কিংবা গ্রেফতার করা দুর্বৃত্তদের নিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার অভিযানে গেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকাতে, যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষণার প্রতিবাদে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিরোধের ডাকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দুর্বৃত্তায়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে। এতে নিরীহ নিরপরাধ মানুষজনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত হতাহত হয়েছেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে টার্গেট কিলিং যা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে গোপন সংগঠনগুলোর খুনী চক্র। খুনী চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করতে না পেরে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে সরকার। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই খুনী চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চালাচ্ছে গুপ্তহত্যা। মোটরসাইকেল যোগে এসে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে খুন নিশ্চিত করা হয়েছে যার ধরন একই কায়দায়। ২০১৩ সাল থেকে গত সাড়ে ৩ বছরে একই কায়দায় সারাদেশে ৫১টি জঙ্গী গোষ্ঠীর হামলায় প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মুয়াজ্জিন, ধর্মযাজক, বিদেশী, মানবাধিকার কর্মী, সেবক, দর্জি, মুদি দোকানি, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের সদস্য, হিন্দু, খ্রিস্টান, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বীসহ ৫২ জনকে গুপ্তহত্যা করেছে খুনী চক্র, যাদের পরিচয় বলা হচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠী। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি) অনুযায়ী প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, গুম, গুপ্তহত্যার ঘটনার ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় ও পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত করা বাধ্যতামূলক। তদন্তে বিচার বিভাগীয় ঘটনাগুলো জাস্টিফাইড কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। কি পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করেছে, গুলি করার মতো আদৌ কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হবে। যদি তদন্তে কোন বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, গুম, গুপ্তহত্যার মতো ঘটনাগুলো হত্যাকা- প্রমাণিত হয় তাহলে হত্যাকা-ের মামলা হবে এবং দায়ী ও দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ আইনানুগ দ-বিধি অনুসারে আদালতে মামলা করা যাবে। ২০০৪ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এক আলোচনা সভায় বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে বলেছিলেন, র‌্যাব খুব ভাল কাজ করছে। ক্রিমিন্যালরা খুবই শক্তিশালী। আত্মরক্ষা করছে র‌্যাব। দেশের মানুষ র‌্যাবের ভূমিকায় খুশি। ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে রাজধানীতে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ক্রসফায়ার সম্পর্কে এই কথা বলেন তিনি।
×