ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পূর্ণাঙ্গ বন্দরের মর্যাদা পাবে ’২৩ সালে

পায়রা সমুদ্রবন্দরে এ বছরই সীমিত কার্যক্রম চালু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১২ জুন ২০১৬

পায়রা সমুদ্রবন্দরে এ বছরই সীমিত কার্যক্রম চালু হচ্ছে

তপন বিশ্বাস ॥ দ্রুত এগিয়ে চলেছে পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ। দেশের তৃতীয় এই সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে জমি অধিগ্রহণ, মাটিভরাট, সংযোগ সেতু নির্মাণ, এক হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মাণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। চলতি ২০১৬ সাল থেকে স্বল্পপরিসরে এর কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে বহির্নোঙ্গরে ক্লিংকার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনয়ন ও ছোট জাহাজের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরেও পরিবহন কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে এটি পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, পায়রা বন্দর ঘিরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এজন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) প্রণয়ন করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরে শুধু জেটি নয়, থাকছে মোট ২০ ধরনের অবকাঠামো। পায়রা বন্দরে টার্মিনাল-জেটির পাশাপাশি তেল শোধনাগার, বিদ্যুতকেন্দ্র, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, অর্থনৈতিক অঞ্চল, এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট অঞ্চল, বিমানবন্দর এবং জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের ব্যবস্থাও থাকবে। পায়রা বন্দর নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনার ব্যাখ্যায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পায়রা বন্দর ঘিরে মোট বিশটির মতো কম্পোনেন্ট থাকবে। বন্দরের টার্মিনাল বা জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামোর পাশাপাশি সেখানে একটি বিমানবন্দর স্থাপনের বিষয়ে আশা আমাদের রয়েছে। পায়রাকে পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে স্থাপনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বন্দরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর প্রাকৃতিক গভীরতা। এ গভীরতায় সহজেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্ভব। জানা গেছে, ২০২৩ সালের মধ্যে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বন্দরের প্রাথমিক কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরুর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ২০১৮ সাল নাগাদ এ বন্দর দিয়ে আন্তর্জাতিক আমদানি-রফতানি পণ্য ওঠানামা শুরুর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বন্দরের কারিগরি পরামর্শক ও ধারণাগত মহাপরিকল্পনা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করতে বিগত বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এইচআর ওয়েলিংফোর্ড সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হাইড্রোলিকসের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী এইচআর ওয়েলিংফোর্ড কনসেপচুয়াল মাস্টারপ্ল্যানের কাজ সম্পন্ন করবে। এজন্য ব্যয় হবে ১৮ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। উল্লেখ্য, দেশের সমুদ্রবন্দর কার্যক্রম আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের রাবণাবাদ চ্যানেলে ২০১৩ সালের ১৯ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা বন্দরের ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন। তিন পর্বে এই নির্মাণ পরিকল্পনায় প্রথম পর্বে ১৯ ধাপের প্রথম পর্যায় ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে পায়রা বন্দরের জন্য। নির্মাণ করা হয়েছে ১৬ একর জায়গায় সীমিত অবকাঠামো, জেটি ও অত্যাধুনিক কন্টেনার ক্যারিয়ার, শুল্ক স্টেশন, নিরাপত্তা ভবন এবং বন্দর পন্টুনে সরাসরি ট্রাক বা কন্টেনার লরি প্রবেশের জন্য অভ্যন্তরীণ রাস্তা। নিয়োগ দেয়া হয়েছে শিপিং এজেন্ট, সিএ্যান্ডএফ, ফ্র্রেইট ফরোয়ার্ডও। কন্টেনার ডিপোর জন্য ভূমি উন্নয়ন করা হয়েছে। চলছে অফিস ভবন ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় পর্যটন শিল্প বিকাশে বিশেষ অঞ্চল নির্মাণের সমীক্ষা কার্যক্রম শেষ হয়েছে। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি সমীক্ষার কাজ শুরু করে এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করেছে ইউকে’র পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিংফোর্ড। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে তোলা হবে সবুজ বেষ্টনী। বন্য প্রাণীর জন্য থাকবে অভয়ারণ্য। থাকবে কয়লা টার্মিনাল। গড়ে তোলা হবে জাহাজ নির্মাণ শিল্প এবং বিশেষ রফতানি অঞ্চল। বন্দর সুবিধা কাজে লাগিয়ে এখানে তৈরি হবে তেল শোধনাগার, সার কারখানা। আকাশপথে যোগাযোগের জন্য বিমানবন্দর গড়ে তোলাসহ থাকবে নৌবাহিনীর ঘাঁটি বিএনএস শের-এ-বাংলা। পর্যায়ক্রমে এটি গভীর সমুদ্রবন্দরের রূপ নিয়ে চার লেনের মহাসড়ক ও ডাবল গেজ রেললাইনে যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণভাবে চালু হবে ২০২৩ সালে। বন্দরের পাশেই গড়ে উঠবে এলএনজি টার্মিনাল। এ জন্য জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্নের কাজ চলছে। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে পায়রার কাছেই কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। ২০১৮ সালের মধ্যেই উৎপাদনে যাওয়ার আশা করছে সরকার। আপাতত সড়ক ও রেলপথ ছাড়াই নৌপথে পণ্য আনা- নেয়ার মধ্য দিয়েই চলতি বছরে শুরু হতে যাচ্ছে বন্দরটির কার্যক্রম। শুরুতে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে নৌপথে পণ্য পরিবহন হবে। এ জন্য লালুয়ার চারিপাড়া পয়েন্টে পন্টুন (জেটি) স্থাপন করা হয়েছে। পায়রা বন্দরে নির্মাণ করা হবে মোট ১৬টি জেটি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই শুরু হয়েছে পায়রাকে সাজানোর কর্মযজ্ঞ। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নৌপথে ঢাকা থেকে উভয় বন্দরের দূরত্ব প্রায় সমান ২৫০ কিলোমিটার। বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কমপক্ষে ৯ মিটার গভীরতা দরকার হয়, সেখানে রামনাবাদ চ্যানেলে জোয়ারের সময়ও ১৪ মিটার পানি থাকে। তবে এই মুহূর্তে মালামাল খালাসের কার্যক্রম চালু হলেও ২০১৮ সাল নাগাদ পূর্ণাঙ্গ বন্দরের কার্যক্রম শুরু এবং ২০২৩ সালের মধ্যে পায়রা বন্দরটি সম্পূর্ণরূপে চালু করা হবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বন্দরটিকে ফাস্ট ট্র্যাকে রাখা হয়েছে। তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রার কার্যক্রম চালুর সুবাদে সামগ্রিকভাবে বদলে যাবে এ অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালচিত্র। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এলাকার হাজার হাজার মানুষের। চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না এমন বড় জাহাজ জোয়ার-ভাটার অপেক্ষা না করে সারা বছরই ভিড়তে পারবে পায়রা বন্দরে। বহির্নোঙর থেকে সারা দেশে সহজেই পৌঁছানো যাবে আমদানি পণ্য। একইভাবে রফতানি পণ্যও পাঠানো যাবে যেকোন দেশে। নেপাল ও ভুটান খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারবে এই বন্দর।
×