ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহত্তম ইফতার বায়তুল মোকাররমে

ধনী-দরিদ্র পার্থক্য নেই, দুই হাজার মানুষের বিশাল আয়োজন

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৯ জুন ২০১৬

ধনী-দরিদ্র পার্থক্য নেই, দুই হাজার মানুষের বিশাল আয়োজন

মোরসালিন মিজান ॥ সারাদিন রোজা। সন্ধ্যায় ইফতার। সন্ধ্যায় যদিও, দুপুরের পর থেকে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। ঘরে যেমন ইফতারের আয়োজন চলে। বাইরেও। যে যার মতো ছোলা মুড়ি পেঁয়াজু নিয়ে বসে যান। দুই দশজন কোথাও। কোথাও আবার বিশাল ইফতার মাহফিল। তবে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী আয়োজনটি চোখে পড়ে বায়তুল মোকাররমে। জাতীয় মসজিদে রোজার প্রতিদিন ইফতার করেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। সরকারী খরচে ফ্রি ইফতারের ব্যবস্থা করে ইসলামী ফাউ-েশন। এখানে ধনী দরিদ্রের পার্থক্য করার কেউ নেই। আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই কারও জন্য। বড় ব্যবসায়ী, উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে আশপাশের দোকানি ও পথচারীরা পাশাপাশি বসেন। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে একই খাবার খান। সকলকেই অতিথির মর্যাদায় আপ্যায়ন করা হয়। প্রতি রমজানের মতো এবারও প্রথমদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে ইফতার আয়োজন। বুধবার আছরের নামাজের পর সেখানে গিয়ে দেখা যায় নতুন চেহারা পেয়েছে পূর্ব সাহান। নামাজের পর অনেকেই আর মসজিদ ছেড়ে যাননি। চলছে হামদ নাত। বিভিন্ন বিষয়ে বয়ান দিচ্ছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা। রোজাদাররা মন দিয়ে বয়ান শুনছেন। সময় যত গড়াচ্ছিল, বাড়ছিল রোজাদারের সংখ্যা। কয়েকটি সারিতে ভাগ হয়ে বসছিলেন তারা। কেউ কেউ বসছিলেন বৃত্তাকার হয়ে। মুসল্লি, আশপাশের দোকানের কর্মচারী, গুলিস্তান এলাকায় কেনাকাটা করতে আসা মানুষ, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, এতিম- মিসকিন- কেউ বাদ যান না। বিরাট কর্মযজ্ঞ তদারকি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদ ও মার্কেট বিভাগ। এই বিভাগের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ মহীউদ্দিন মজুমদার জানান, এখানে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন। প্রতিদিনের ইফতারে থাকে শরবত, খেজুর, ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, জিলাপি ও কলা। প্রতিদিনের ইফতারে ৭০ কেজি ছোলা, ৪৫ কেজি মুড়ি, ৬০ কেজি পেঁয়াজু, ৬০ কেজি জিলাপি এবং ৪০ কেজি খেজুর থাকছে। সাড়ে ৬শ’ থেকে ৭০০ পিস কলা অর্ধেক করে কেটে পরিবেশন করা হয়। ১০টি বড় বালতিতে তৈরি করা হয় শরবত। ৭০টি জগে করে ১৫শ’ গ্লাসে তা বিতরণ করা হয়। জানা যায়, খাবার পরিবেশনের জন্য রয়েছে ২০০টি বড় ডিশ। প্রতিটিতে ৬ থেকে ৮ জনের ইফতার করার ব্যবস্থা। রোজাদাররা ডিশের চারপাশে চমৎকার গোল হয়ে বসে ইফতার করেন। সিঙ্গেল ডিশও আছে। ৪শ’ মানুষ সিঙ্গেল ডিশে ইফতার করতে পারেন। দশটি সারিতে ৭০ জন করে বসে ইফতার করেন। বিশাল এই আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে কাজ করছেন ২১ খাদেম। থালা বাটি ধোয়ার জন্য রয়েছেন আরও কয়েকজন। আছে স্বেচ্ছাসেবীও। পুরুষের পাশাপাশি পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে মহিলাদের জন্য। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে নামাজকক্ষে প্রতিদিন শতাধিক মহিলা ইফতার করেন। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটি আয়োজন। নিয়মিত এই ইফতারে অংশগ্রহণ করেন আলী আকবর নামের এক প্রবীণ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমি সরকারী চাকরি শেষে অবসর নিয়েছি। বাসায় স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ আছে। ইফতারের সব ব্যবস্থা বাসায় হয়। তবু এখানে চলে আসি ইফতার করতে। কারণ এখানে হাজার হাজার মুসল্লি। তাদের সঙ্গে ইফতার করার আলাদা শান্তি আছে। এটা আমি উপভোগ করি। বায়তুল মোকাররমের পাশেই অস্থায়ী দোকান মোঃ আরিফের। এই তরুণ হকারও ইফতার করতে এসেছিলেন। বললেন, মাগরিবের আজানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দোকান চালাই। খোলা রেখে কোথাও যেতে পারি না। এভাবে ইফতারের সময় দোকান বন্ধ করে মসজিদে চলে আসি। আর একেবারে হতদরিদ্র ভিক্ষুক ভবঘুরেদের কথা তো বলাই বাহুল্য, তাদের একবেলা খাওয়া এখানে হয়ে যায়। তাতেই আনন্দ। সিরাজ মিয়া নামের ছিন্নমূল এক কিশোর বললো, ‘আমাগোরে কেউ তো ইফতার দেয় না। এইখানে দেয়। এই জন্য সারাদিন যেইখানেই থাকি না কেন, ইফতারের সময় এইখানে চইলা আসি।’ আমির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীও ইফতার করছিলেন সবার সঙ্গে বসে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এখানে সব শ্রেণী পেশার মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। এর যেমন ধর্মীয় গুরুত্ব আছে, তেমনি আছে সামাজিক গুরুত্ব। এখানে সবাই সুশৃঙ্খল হয়ে বসেন। এক প্লেটে খান। ইফতার পরিবেশনায় সহায়তা করেন। সব মিলিয়ে দারুণ সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। এই সৌহার্দ্যরে শিক্ষা সারাবছর ধরে রাখা গেলে দেশে শান্তি আসবে বলে মনে করেন তিনি। রোজার শেষদিন পর্যন্ত এই আয়োজন চলবে।
×