ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ব্রাজিল সঙ্কট পারবেন কি টেলের

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ৮ জুন ২০১৬

ব্রাজিল সঙ্কট পারবেন কি টেলের

ব্রাজিলে একটা রাজনৈতিক সঙ্কট চলছে। প্রেসিডেন্ট ডিলমা রুসেফ ছয় মাসের জন্য সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। সোজা কথায় সাসপেন্ড হয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল টেমের। ব্রাজিলে তিন দশকের মধ্যে এমনি তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাহীনভাবে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হলেন। শোনা যায় ডিলমা রুসেফের তুলনায় টেমেরের ধ্যান-ধারণা যথেষ্ট উন্নত। তথাপি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কতটা সফল হবেন সেটাই প্রশ্ন। ইতোমধ্যে ব্রাজিলের রাজধানীতে টেমেরের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে। ডিলমা রুসেফের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ব্রাজিলের অর্থনীতির বেহাল অবস্থা আড়াল করতে সরকারী বাজেটের হিসাবে গোঁজামিল দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থ কাজে লাগিয়েছিলেন। এই অভিযোগে কংগ্রেসে তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট শেষ হওয়া সাপেক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। রুসেফ তার অপসারণকে ‘ক্যু’ বা ‘অভ্যুত্থান’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে এটা একটা ষড়যন্ত্রের ফল এবং সেই ষড়যন্ত্রে স্বয়ং টেমেরও জড়িত। রুসেফ এমন এক সময় সাসপেন্ড হলেন যখন অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্নীতির একগাদা কেলেঙ্কারির মধ্যে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছিল। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে রুসেফের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। সে অভিযোগ ছিল তাঁর সরকার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাস এবং বড় বড় নির্মাণ কোম্পানির বিরুদ্ধে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর মিশেল টেমের ব্যবসামুখী বেশ কিছু সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সরকারের মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশে হ্রাস করেছেন এবং মন্ত্রিসভায় সব পুরুষ সদস্য ও শ্বেতাঙ্গকে নিয়োগ দিয়েছেন। আপাতত ছয় মাসের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকলেও তার এই পদ স্থায়ী হতে পারে যদি রুসেফের বিরুদ্ধে অভিসংশন চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। টেমের এই সময়টুকু কিভাবে দেশ চালাবেন সেটা ব্রাজিলের ভবিষ্যতের ওপর বহু বছর ধরে প্রভাব রাখতে পারে। এর আগের অনির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের তুলনায় টেমেরের পক্ষে দেশ পরিচালনায় কাজটা নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন। কারণ রুসেফের পাঁচ বছরের অযোগ্য শাসনের ফলে ব্রাজিল ১৯৩০ এর দশকের পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ মন্দার কবলে পড়েছে। ২০১৬ সালে অর্থনীতির মোট সঙ্কোচনে ঘটবে সম্ভবত সাড়ে সাত শতাংশ। বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির হার দুটোই প্রায় ১০ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি জিডিপির এক-দশমাংশেরও বেশি। অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো প্রায় একই রকমের তীব্র হলো রাজনৈতিক সঙ্কট যা সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাসের নানা কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে। এতে রুসেফের ওয়ার্কার্স পার্টি (পিটি) এবং মধ্যপন্থী দল টেমেরের ব্রাজিলিয়ান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিএমডিবি) উভয়েরই ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হয়েছে। এই পটভূমিতে টেমেরের পক্ষে দেশ চালানো অত সহজ হবে বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে রুসেফ তার ইমপিচমেন্টের পেছনে টেমেরের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন। এখন টেমের রুসেফের বিপর্যকর নীতি যত বদলানো চেষ্টা করবেন ততই তার বিরুদ্ধে নির্বাচনের গণরায় পাল্টে দেয়ার অভিযোগ আনবে রুসেফের সমর্থকরা। অবশ্য এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার মতো শক্তি আছে টেমেরের। মনমানসিকতার দিক দিয়ে তিনি রুসেফের ঠিক বিপরীত। রুসেফের মধ্যে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। আর টেমেরের আছে মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। তিনি ভাল বাগ্মীও। রুসেফ আপোসহীন। টেমেরের সমঝোতা করার মনোভাব আছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত রুসেফ কখনও নির্বাচিত পদ ধারণ করেননি। অন্যদিকে টেমের চারবার কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাংবিধানিক আইনের ওপর তার বহুল বিক্রীত পাঠ্যবই এবং একটি কাব্য সঙ্কলনও আছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে টেমের রুসেফের অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপবাদকে তেমন একটা চ্যালেঞ্জ না করলেও তিনি নিজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদারতাবাদের মিশ্রণে বিশ্বাস করেন যদিও এমন ব্যবস্থা ব্রাজিলের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী। ১৯৮৮ সালে গৃহীত সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা হিসেবে টেমের শ্রমিকদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থার বিরোধী। তিনি মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করেছিলেন এবং গর্ভপাত বৈধ করার পক্ষে ছিলেন। টেমেরের পিএমডিবি দলের সঙ্গে রুসেফের ওয়ার্কার্স পার্টির (পিটি) ১৩ বছরের মৈত্রী ভেঙ্গে পড়তে শুরু করায় টেমেরের উদারতাবাদ- যা এতদিন ছিল রুদ্ধ অবস্থায় তা প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করে। গত অক্টোবরে তার দল ১৮ পৃষ্ঠার এক মেনিফেস্টো প্রকাশ করে যেখানে বিরাষ্ট্রীয়করণ থেকে শুরু করে মুক্ত বাণিজ্য এবং অতি উদার সরকারী অবসর ভাতা, শ্রম আইন ও করবিধি সংস্কারের প্রস্তাব ছিল। টেমের এখন এই প্রস্তাবগুলোর কয়েকটি বাস্তবায়িত করার পক্ষে। ত্বরিত কিছু সংস্কার বিশেষ করে ওতে যদি সরকারী ব্যয় হ্রাস করা যায় তাহলে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও আস্থা বাড়বে, মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার প্রবৃদ্ধি বিধ্বংসী ১৪.২৫ শতাংশ থেকে তার টার্গেট করা হারে নামিয়ে আনার সুযোগ পাবে। প্রেসিডেন্ট টেমের ভোটারদের সন্তুষ্ট করার জন্য ইতোমধ্যে তার মন্ত্রীর সংখ্যা ৩২ থেকে কমিয়ে ২৩ এ এনেছেন। কারণ ভোটাররা মনে করেন যে সরকারেরও ত্যাগ স্বীকার করা উচিত। ইতোমধ্যে টেমেরের কিছু কিছু পদক্ষেপ অর্থলগ্নি বাজারে উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে। ওই সব পদক্ষেপ নেয়া না হলে অর্থনীতির অবস্থা যে শোচনীয় তাতে বাজারটা নিরানন্দ থাকারই কথা। অবশ্য পরিস্থিতি অন্যরকমও হতে পারে এবং সেটা অতি সহজেই। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, নির্বাচন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে দেখছে যে পেট্রোব্রাসের দেয়া ঘুষের অর্থ রুসেফ ও টেমেরের নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা। যদি এক্ষেত্রে অনিয়ম উদ্ঘাটিত হয় তাহলে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল হয়ে যাবে এবং টেমেরও প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হবেন। ব্রাজিলের জনগণ তখন নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃবৃন্দ বেছে নেবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×