ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন আরও সুদূরপ্রসারী ॥ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করলেন মুস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১ জুন ২০১৬

স্বপ্ন আরও সুদূরপ্রসারী ॥ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করলেন মুস্তাফিজ

এবারই প্রথম ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল) খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর প্রথমবারেই বাজিমাত করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি যে দলের হয়ে খেলেছেন সেই সানরাইজার্স হায়দরাবাদ হয়েছে নবম আইপিএলের চ্যাম্পিয়ন। এই প্রথম দলটিও সর্বোচ্চ এ সাফল্য পেয়েছে, হয়েছে প্রথমবারের মতো শিরোপাধারী। যেন বাংলাদেশের বাঁহাতি পেস বিস্ময় মুস্তাফিজই ছিলেন চাবিকাঠি। পুরো আসরেই তিনি যেমন নৈপুণ্য দেখিয়েছেন সেটা বিমুগ্ধ করেছে ক্রিকেট বিশ্বের সব রথি-মহারথিদেরও। নিয়মিতই ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। ফাইনাল পর্যন্ত অবিরাম খেলেছেন দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে। শুধু দুই নম্বর কোয়ালিফায়ার ম্যাচে হালকা হ্যামস্ট্রিং সমস্যা থাকায় খেলতে পারেননি গুজরাট লায়ন্সের পক্ষে। কিন্তু নিজের অবিশ্বাস্য ‘স্লোয়ার’ আর বিস্ময়কর ‘কাটার’ দিয়ে এ ২০ বছর বয়সী তরুণ যে কোন প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে চাপে রেখেছেন। টি২০ ক্রিকেট চার-ছক্কার ম্যাচ হলেও ডেথ ওভারগুলোয় রান দেয়ার ক্ষেত্রে তার কার্পণ্য হতবিহ্বল করেছে স্বীকৃত বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানদেরও। ১৬ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়েছেন ৬.৯০ ইকোনমিতে। এ কারণে পুরস্কারটাও জুটেছে কপালে, পেয়েছেন সেরা উদীয়মান তারকার স্বীকৃতি। তবে মুস্তাফিজ এবার আইপিএল চলার সময়েই এত প্রশংসায় ভাসার পরও দাবি করেছেন তিনি দেশের জন্যই খেলেন। সেটা যে কোন পর্যায়ের ক্রিকেটই হোক না কেন তার লক্ষ্য থাকে যেন নিজের নৈপুণ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করা যায়। সেটাই করে দেখালেন তিনি। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে আসলেন। এর আগে আইপিএল বলতেই ছিল সাকিব আল হাসানকে নিয়ে উন্মাদনা। ২০১১ সাল থেকে নিয়মিত সদস্য তিনি আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজি কলকাতা নাইট রাইডার্সের (কেকেআর)। কিন্তু প্রথম অংশগ্রহণেই তিনি দলের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো বড় সাফল্য পাননি। তবে পরের বছরই (২০১২) কেকেআরের হয়ে শিরোপা জয়ের স্বাদ নেন। একই অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ২০১৪ আইপিএলেও। কিন্তু এবার সেই সাকিব ছিলেন একেবারেই ম্লান। অধিকাংশ ম্যাচে তাঁকে ড্রেসিং রুমে বসে থেকেই খেলা উপভোগ করতে হয়েছে, একাদশে সুযোগ হয়নি। তাঁকে নিয়ে অতীতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল এবার সেটা দেখা যায়নি। কিন্তু মুস্তাফিজকে নিয়ে মাতোয়ারা ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। এমনকি কেকেআরের সমর্থন থেকে সরে গিয়ে সবাই মুস্তাফিজের হায়দরাবাদকেই অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। শুরু থেকেই ম্যাচ খেলার সুযোগ পান সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম তেঁতুলিয়া থেকে হঠাৎ ধূমকেতুর মতো উঠে আসা এ বাঁহাতি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণের প্রথম বছরের আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটার হয়েছেন। সে কারণে তাঁকে লুফে নিয়েছে আইপিএল। তবে প্রথম আসর বলে চড়া মূল্য ওঠেনি এ তরুণের। মাত্র ১ কোটি ৪০ লাখ রুপীতেই তাকে পেয়ে যায় হায়দরাবাদ। সেই মুস্তাফিজ অপরিহার্য হয়ে ওঠেন দুয়েকটি ম্যাচ খেলার পরই। হায়দরাবাদের সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়েই হায়দরাবাদের বোলিং বিভাগ যেন পূর্ণতা পেয়ে যায়। মুস্তাফিজ ছিলেন অন্যতম পুরোধা পেস আক্রমণের। দারুণ কিছু উইকেট নেয়া এবং ডেথ ওভারে কিপটেমি করে রান কম দেয়ার জন্য সবাই তাঁকে নিয়ে আলোচনায় সরব ছিলেন। এ কারণে বেশ আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছিল তিনিই হবেন এবার আইপিএলের সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু মুস্তাফিজ চাপ প্রয়োগ করেছেন প্রতিপক্ষের ওপর, সেটাকে কাজে লাগিয়ে উইকেট নিয়েছেন তার সতীর্থরা। আর এতসব প্রশংসার মধ্যেও দেশের গর্বের জন্য অবিচল মুস্তাফিজ বলেন, ‘আমি সবসময় চাই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে। যে পর্যায়ের ক্রিকেটই খেলিনা কেন আমার চিন্তা থাকে ভাল করে দেশের সুনাম বাড়াতে হবে।’ সেটা ঠিকই করতে পেরেছেন তিনি। বিশ্বকে বিমোহিত করে আইপিএল মিশন শেষ করলেন ‘ফিজ’ নাম হয়ে যাওয়া এ ক্রিকেটার। ক্রিকেটের জনপ্রিয় এ আসরে নিজের অভিষেকেই মাত করলেন বাংলাদেশী পেসার। পঞ্চম সর্বাধিক ১৭ উইকেট নিয়ে হায়দরাবাদের প্রথম শিরোপা জয়ে রাখলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কেবল তাই নয়, প্রথম বিদেশী ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএলের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারও নির্বাচিত হয়েছেন টাইগার কাটার-মাস্টার। এক্ষেত্রে তার ধারেকাছেও ছিলেন না কেউ। আইপিএলের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ‘ইমার্জিং ক্রিকেটার অব দ্য সিজন’ হিসেবে মুস্তাফিজের প্রাপ্য ভোট ৮৩.২ শতাংশ, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী যোজন যোজন দূরে থাকা লোকেশ রাহুলের ভোট মাত্র ৬.৫! ৬১ ওভার বল করে টুর্নামেন্টে তার ইকোনোমি ৬.৯০। কিপটে বোলিংয়ে মুস্তাফিজই সবার ওপরে। নগদ অর্থ হিসেবে পেয়েছেন ১০ লাখ রুপী। আইপিএলের বিভিন্ন আসরে আলাদা নামে পরিচিত এই পুরস্কার (সেরা উদীয়মান) এতদিন কেবল ভারতীয়রাই পেয়ে এসেছেন। এবারই প্রথম কোন ভীনদেশী হিসেবে সেটি মুস্তাফিজের হাতে। গত বছর এপ্রিলে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর থেকেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। ২ টেস্ট, ৯ ওয়ানডে আর ১৩টি২০তে তুলে নিয়েছেন ৫২ উইকেট (টেস্টে ৪টি, ওয়ানডেতে ২৬টি, টি২০ ২২টি)। ক্রিকেট–দুনিয়াকে মুগ্ধ করেছেন তাঁর দুর্দান্ত কাটার আর সেøায়ারে। আইপিএলে হায়দরাবাদের হয়ে খেলতে গিয়েও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের সাফল্যেরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। ১৬ ম্যাচে ২৪.৭৬ গড়ে তুলে নিয়েছেন ১৭ উইকেট, ইকোনমি রেট ৬.৯০। টি২০ ক্রিকেট বোলারদের জন্য কঠিন হলেও মুস্তাাফিজের বল খেলাই ছিল আইপিএলে ব্যাটসম্যানদের জন্য বড় পরীক্ষা। ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ফাইনালেও খারাপ করেননি। রান-উৎসবের মাঝে ৪ ওভার বল করে ৩৭ রান দিয়েছেন। ক্রিস গেইল আর বিরাট কোহলির ঝড়ের মধ্যে বল হাতে প্রথম ওভারে এসেই মাত্র ৪ রান দিয়ে চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। পরবর্তীতে শেন ওয়াটসনের উইকেটও নেন তিনি। কিন্তু সতীর্থ ফিল্ডার ক্যাচ মিস না করলে পেয়ে যেতে পারতেন আরও একটি উইকেট। ভারতের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম জিনিউজ এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানও মুস্তাফিজের বল ঠিকমতো খেলতে পারেনি। নির্ভুলভাবে সঠিক বল করার স্বীকৃতি হিসেবেই এ বছরের আইপিএলের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড় হিসেবে ঘোষণা করা হয় মুস্তাফিজের নাম। ধীরপায়ে হাসিমুখে মঞ্চে এসে তিনি হাতে তুলে নেন পুরস্কার। মুস্তাাফিজ প্রমাণ করলেন, ইংরেজি বলতে না জানা, হিন্দি ভাষা না বোঝা, প্রথমবার দল ছাড়া একা একা অন্য একটি দেশে থাকার বিড়ম্বনা ভাল ক্রিকেটার হওয়ার পথে কোন বাধা নয়। ক্রিকেটের ভাষা বোঝাটাই বড় কথা। দ্য ফিজ যেটা সবচেয়ে ভাল বোঝেন। কিছু না জানলেও ঠিকই ভারতীয় ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকদের মন জয় করেছেন তিনি। এমনকি অনেক ম্যাচেই ‘মুস্তাফিজ, মুস্তাফিজ’ স্লোগান দিয়েছেন উপস্থিত দর্শকরা। আর এটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য, বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্য দারুণ গৌরবের। দেশের মাথা উঁচু করেই আইপিএল থেকে ফিরছেন তিনি।
×