ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

টিম কুকের বাংলাদেশ সফর!

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৩০ মে ২০১৬

টিম কুকের বাংলাদেশ সফর!

১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে স্টিভ জবস ভারতে এসেছিলেন। ছিলেন দীর্ঘ সাত মাস। ভারতে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল নৈনিতালে অবস্থিত বাবা নীম কারলীর কাঞ্চি আশ্রম দেখা। সঙ্গে এসেছিলেন তার কলেজের বন্ধু (পরবর্তী সময় এ্যাপলের কর্মী) ডানিয়েল কটকি। স্টিভের সঙ্গে বাবা নীম কারলীর দেখা হয়নি। ঠিক আগের বছর ১৯৭৩ সালে ১০ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। নৈনিতাল থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে উত্তরাকান্দের কুমন পাহাড়ে কাঞ্চি আশ্রম। বাবা নীম কারলী (অন্যত্র বাবা নিব কারলী)-কে ধরা হয় লর্ড হনুমানের পুনর্জন্ম। তাই এই আশ্রমটি এত বিখ্যাত। ধারণা করা হয়, এ্যাপল ঠিক কী ধরনের প্রতিষ্ঠান হবে তা এই আশ্রম থেকেই স্টিভ মনস্থির করেছিলেন। তার চিন্তা এবং পরিকল্পনাগুলোয় নির্দিষ্ট ছকে ফেলতে এটা সাহায্য করেছিল। শুধু স্টিভ জবস নয়, ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গও এই আশ্রমে এসেছিলেন। নরেন্দ্র মোদি যখন সিলিকন ভ্যালি বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন ফেসবুক পরিদর্শনে গেলে সেখানে জাকারবার্গ এই তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ফেসবুক তৈরির প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানটির ভিশন ঠিক করার জন্য স্টিভ জবস তাকে ওই আশ্রমে যেতে বলেছিলেন। তাই তিনি দীর্ঘ এক মাস ভারতে ছিলেন। ঘুরে ঘুরে মানুষ দেখেছেন, আর ভেবেছেন এই মানুষগুলোর জীবন কতটা পাল্টে যেতে পারত যদি তারা পুরো বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত থাকত। গত ১০ বছর ধরে তিনি যা তৈরি করে চলেছেন, তার প্রতিটি সময়েই সেই আশ্রমের দিনগুলোর প্রভাব রয়েছে। পাটনাগারে ঝড়ের কারণে জাকারবার্গকে ওই আশ্রমে দুইদিন বেশি থাকতে হয়েছিল। বাবা নীম কারলীর প্রভাবেই হলিউডের অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নেন। যে কেউ চাইলেই এই আশ্রমে গিয়ে থাকতে পারেন না। কোন একজন পুরনো ভক্তের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নিলে মাত্র ৩ দিন থাকার অনুমতি মেলে। ঠা-ার কারণে বছরের বেশিরভাগ সময়ই আশ্রমটি বন্ধ থাকে। স্টিভ জবস বেঁচে নেই। কিন্তু তারই পথ ধরে গত সপ্তাহে (১৮-২২ মে, ২০১৬) এ্যাপলের সিইও টিম কুক ভারত সফর করে গেলেন। তিনি দেখা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। পাশাপাশি যোগ দেন শাহরুখ খানের পার্টিতে, আইপিএলের খেলা দেখেন, ঘুরে দেখেন মুম্বাইয়ের মেহবুব স্টুডিও এবং ভারতে নতুন স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করেন। এই উপলক্ষে ভারতের মিডিয়াগুলো ফলো করছিলাম। সেখানে দেখতে পেলাম, টিম কুক মুম্বাইয়ের সিদ্ধিভিনায়েক মন্দিরও পরিদর্শন করেন। মোদির সঙ্গে বৈঠক টিম কুক গত শনিবার (২১ মে, ২০১৬) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাত করেন। গত বছর নরেন্দ্র মোদি যখন সিলিকন ভ্যালি গিয়েছিলেন তখন টিম কুকের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি সেখানে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচার করছিলেন। টিম কুক নরেন্দ্র মোদির ডিজিটাল ইন্ডিয়া তৈরিতে সহায়তা করতে চান। এই দুই নেতার মধ্যে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়, তা হলো ভারতে এ্যাপলের ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট তৈরি করা। পাশাপাশি তারা কথা বলেন সাইবার নিরাপত্তা এবং ডাটা এনক্রিপশন প্রযুক্তি নিয়ে। অফিসিয়াল বিবৃতিতে বলা হয়, টিম কুক ভারতে এ্যাপলের ভবিষ্যত পরিকল্পনা উন্মুক্ত করেন। তিনি ভারতের তরুণ মেধার প্রশংসা করেন এবং এই তরুণদের যে দক্ষতা রয়েছে তা এ্যাপলের কাজে লাগাতে চান। তাদের বৈঠক শেষ হওয়ার পর মোদি টুইটারে বলেন, ধন্যবাদ টিম কুক। বন্ধু, স্বাগতম এবং আনন্দময় হোক স্বেচ্ছাসেবা। তোমার মতামত এবং প্রচেষ্টা সব সময়ই সমৃদ্ধ করেছে। এর উত্তরে টিম কুক লেখেন, চমৎকার একটি বৈঠকের জন্য ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আগামী ভ্রমণের দিকে তাকিয়ে আছি। তোমার এ্যাপের সাফল্য কামনা করছি। এখানে বলে রাখা ভাল যে, টিম কুকের ভ্রমণ উপলক্ষে তাকে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি নিজের এ্যাপের নতুন ভার্সনটি উদ্বোধন করান। সেই এ্যাপে নতুন একটি ফিচার যোগ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষ স্বেচ্ছাসেবা নেটওয়ার্কে অংশ নিতে পারবে। তবে টিম কুক আরও দুটি বিষয়ে প্রশংসা করেন তা হলো, ভারতে এখন ব্যবসা খোলা এবং পরিচালনা করা সহজ; এবং রিনিউয়েবল এনার্জি। সিলিকন ভ্যালিভিত্তিক এ্যাপল তার শতকরা ৯৩ ভাগ এনার্জি এখন আসে রিনিউয়েবল এনার্জি থেকে এবং এ্যাপল আশা করছে খুব দ্রুতই তার পুরো প্রতিষ্ঠানটি চলবে রিনিউয়েবল এনার্জি দিয়ে। টিম কুকের সঙ্গীরা রাজস্থানের একটি এলাকা পরিদর্শন করেন যেখানে কয়েকটি গ্রামকে মাত্র সোলার এনার্জি দিয়ে বিদ্যুত দেয়া হয়েছে এবং গ্রামের মেয়েরা একত্রিত হয়ে সেই সৌর বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি পরিচালনা করতে শিখে গিয়েছে। ভারতের দুটি এক্সট্রিম অবস্থা। এখানে একদিকে বিশ্বের অন্যতম ধনীদের বাস; অন্যদিকে অতি দরিদ্র মানুষেরও অভাব নেই। তা অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও তুলনামূলকভাবে খারাপ- বিশেষ করে এত বিশাল আকারের জনসংখ্যা যারা কিনা এই গ্রহেরই মানুষ। তার ভেতর মোদি যখন ঘোষণা দেন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার, তখন তা পুরো বিশ্বে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করে। মোদির ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় তিনটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে- শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি। এটা থেকেই বোঝা যায়, ভারতের এই তিনটি বিষয় প্রায়োরিটিতে ওপরে। আর সে কারণেই হয়ত আরও অনেক মানুষকে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে যুক্ত করার প্রয়াস নিয়েছেন মোদি। তাই হয়ত তৈরি করেছেন ‘মাই নেটওয়ার্ক’Ñ যার মাধ্যমে যে কেউ তার পছন্দের টপিক বেছে নিয়ে কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন। সেখানে খুঁজে পাবেন নতুন নতুন বিষয়, যার সঙ্গে আপনি হয়ত নিজেকে যুক্ত করতে পারবেন। আমি তার মোবাইল এ্যাপটি ডাউনলোড করে দেখতে শুরু করেছি। কিছুদিন পর হয়ত আরও বিস্তারিত লিখতে পারব। তবে একজন প্রধানমন্ত্রী যে সত্যি সত্যি নিজের জনগণকে তার কাজের সঙ্গে যুক্ত করছেন, সেটা তার এ্যাপ থেকে বোঝা যাবে। সেই যাত্রায় তিনি টিম কুককেও যুক্ত করে ফেলেছেন। ভারতে নতুন পদক্ষেপ টিম কুক তার এই যাত্রায় দুটি নতুন কেন্দ্র খোলার জন্য ঘোষণা দেন। একটি হবে ব্যাঙ্গালুরুতে, অন্যটি হায়দরাবাদে। বৃহস্পতিবার এ্যাপল ঘোষণা করেছে যে, তারা হায়দরাবাদে নতুন একটি অফিস খুলবে, যারা মূলত ম্যাপ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করবে। এর মাধ্যমে নতুন চার হাজার হাইটেক মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। টিম কুক তার বক্তৃতায় বলেছেন, এই এলাকার মেধা অসাধারণ। আমাদের পণ্য তৈরিতে ভারত থেকে আরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পার্টনারদের যুক্ত করা হবে। এ্যাপল তার ম্যাপ প্রযুক্তি থ্রি-ডি ভিউ-সহ আরও অনেক নতুন ফিচার নিয়ে এসেছে। তাদের আইওএস ৯-এ ট্রানজিট নামে একটি ফিচার এসেছে, যেখানে আপনি হাঁটার রাস্তা, বাস, ট্রেন এবং প্লেনের বিস্তারিত জানতে পারবেন। এতে বর্তমানে প্রায় ৩০০ শহরের ট্রানজিট তথ্য দেয়া রয়েছে। হায়দরাবাদের এই নতুন কেন্দ্র চালু হওয়ার পর এ্যাপল ম্যাপ আরও সমৃদ্ধ হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমানে ভারতে প্রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার এ্যাপল এ্যাপ ডেভেলপার রয়েছে। টিম কুক এবারে আরও কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বসেন। তাদের ভেতর রয়েছে আইসিআইসিআই ব্যাংকের চন্দ্র কোচার, টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসের প্রধান নির্বাহী এন. চন্দ্রশেকারান, ভোডাফোনের সিইও সুনীল সুদ এবং ভারতী এয়ারটেলের মালিক মিত্তাল গ্রুপের চেয়ারম্যান সুনীল ভারতী মিত্তাল এবং গ্রুপের অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল ভারতে ফোর-জি মোবাইল নেটওয়ার্ক বসানো, এর বিস্তার এবং আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা। টিম কুক মনে করেন, ফোর-জি দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা শুরু করার এটাই সবচেয়ে ভাল সময়। তবে ভারতে এ্যাপলের স্মার্টফোনের অবস্থান ততটা ভাল নয়। এর মূল কারণ হলো দাম। তাই এ্যাপল চিন্তা করছে, ভারতে রিফারবিশড ফোন ছাড়া যায় কি না। এখানকার মানুষ মূলত কম মূল্যের এন্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে থাকে। তবে এ্যাপলের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফক্সকন ভারতে নতুন ফ্যাক্টরি করার ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে তারা প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। তাতে হয়ত ভারতে কম মূল্যের এ্যাপল ফোন তৈরি করে বাজারজাত করা সম্ভব হতে পারে। বলিউড পার্টিতে টিম কুক টিম কুকের এই সফর শুধু ব্যবসায়িক মহল এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেটা ছড়িয়ে পড়েছিল বলিউডেও। শাহরুখ খান নিজের বাড়ি মান্নাত-এ টিম কুকের উদ্দেশ্যে একটি পার্টির আয়োজন করেন। সেই পার্টিতে যোগ দেন অমিতাভ বচ্চন ও তার পরিবার, আমির খান, মাধুরী দীক্ষিত, এ.আর রহমান, টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাসহ আরও অনেকে। পার্টি শেষে ৫০ বছর বয়স্ক বলিউডের এই অভিনেতা টুইটারে দলবেঁধে একটি ছবি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি বলেন, যারা আজকের পার্টিতে এসে টিম কুক এবং তার দলকে ভারতের ভালবাসা দেখিয়েছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। মি কুক, আপনি একজন রকস্টার! বাংলাদেশে টিম কুক! টিম কুকের ভারত সফর নিয়ে আশপাশে অনেক আগ্রহ দেখা গেছে। বাংলাদেশের মিডিয়াতেই এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেউ কেউ আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশেও তথ্যপ্রযুক্তিতে এতটাই এগিয়ে যাচ্ছে যে, একদিন টিম কুক বেড়াতে আসতে পারেন। আচ্ছা, এটা তো ভাবা যেতেই পারে যে বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিখ্যাত মানুষরা বাংলাদেশ ভ্রমণে আসবেন। সেটা বাংলাদেশের দারিদ্র্য দেখার জন্য নয় (যা বিল গেটসের ফাউন্ডেশন করছে), বরং বাংলাদেশের মানুষের বুদ্ধি, কর্মক্ষমতা, উদ্যম, নতুন উদ্ভাবনী কিংবা কোন সমস্যার চমৎকার সমাধান দেখার জন্য। তবে একটি বিষয় আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না, তা হলো কাঞ্চি আশ্রম। সেই পৃথিবীর ঠিক উল্টো প্রান্ত থেকে কেন স্টিভ জবস এবং মার্ক জাকারবার্গ আশ্রমে গিয়েছিলেন! কী সেই যোগাযোগ? কী সেই ক্ষমতা? আমার ধারণা, এক্সট্রিম ইনোভেশনের সঙ্গে এক ধরনের সাধনার যোগসূত্র রয়েছে। কারও মন, ব্রেইন এবং শরীরকে একটি বিন্দুতে ফোকাস করার জন্য ধ্যানের প্রয়োজন রয়েছে। এই পৃথিবীর যাবতীয় বিশৃঙ্খলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একটি বিন্দুতে ফোকাস করার সবচেয়ে ভাল জায়গা হয়ত আশ্রম। বহু মুনিঋষি এমন ধরনের বিভিন্ন আশ্রমে থাকতেন এবং ঘুরাঘুরি করতেন। তাদের জীবনে আশ্রমের একটি সরাসরি প্রভাব রয়েছে। তারা মূলত সমাজের প্রাত্যহিক যোগটা ছিঁড়ে নিজেকে এর থেকে বাইরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। অর্জন করেছেন অসাধারণ ক্ষমতা। বর্তমান সময়ে যারা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে চাইছেন, তাদের কোন না কোন ফর্মে ধ্যানে বসতে হবে। আমাকে ছোটবেলায় কেউ এটা বলে দেয়নি। আমি তরুণদের জন্য এটা বলে যাচ্ছি। ধ্যান, ধ্যান এবং ধ্যান! ২৮ মে, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×