ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

জিতলেন সালাউদ্দিন বাঁচল ফুটবল

প্রকাশিত: ০৪:০২, ৪ মে ২০১৬

জিতলেন সালাউদ্দিন বাঁচল ফুটবল

বাফুফের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় এখনও শেষ হয়নি। এখনও সবখানে আলোচনার একটাই বিষয়, আর সেটা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)’র নির্বাচন। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নির্বাচন নিয়ে আলোচনার এক টেবিলে কবি সানাউল হক খান বললেন- “সূর্য যদি পশ্চিমে ওঠে এবং পুবে অস্ত যায় সেটা মেনে নিলেও নেয়া যেতে পারে। কিন্তু এ দেশে আর একজন কাজী সালাউদ্দিন জন্ম নেবে সেটা কখনই হতে পারে না।” তার এ কথায় সবাই সম্মতিসূচক মাথা দোলালেন। উপস্থিত কেউ কবির এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন না। দ্বিমত পোষণ করার প্রশ্নই ওঠে না। কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবলের একজন লিজেন্ড। অর্থাৎ জীবন্ত কিংবদন্তি। একজন দক্ষ স্ট্রাইকার, একজন সফল সংগঠক তথা বাফুফের দুই মেয়াদের সভাপতি, দুইবার সাউথ এশিয়া ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে তাঁর কর্মকা- ও অবদান সম্পর্কে নতুন করে কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা বয়ান করার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। একজন নব্বইয়োর্ধ প্রবীণ থেকে শুরু করে কিশোর পর্যন্ত জানে কাজী সালাউদ্দিন কে? কী তাঁর পরিচয়; ফুটবলে কী তাঁর অবদান আর ফুটবলের জন্য তিনি কী করেছেন। সেই কাজী সালাউদ্দিনকে নির্বাচন করতে হয়েছে এমন একজন মানুষের সঙ্গে যিনি ফুটবলের কোন লোক নন। জীবনে ফুটবল খেলেছেন কিনা সন্দেহ। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও পরিচিতি নেই। তার নামটা ক্রীড়াঙ্গনে একবারেই অনুজ্জ্বল। এটা খুবই দুঃখজনক। একজন ফুটবলারকে অন্য অঙ্গনের একজন মানুষের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। তিনি নিজে বাফুফের এই নির্বাচনী মঞ্চে আসেননি। বলা হয়, তাকে আনা হয়েছিল। কারা এনেছিলেন সেটাও কারও অজানা নয়। শেখ জামাল ধানম-ি ক্লাব সভাপতি মনজুর কাদের, মোহামেডানের লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ফুটবলার নওশের, চুন্নু, বাবুল, কায়সার হামিদ, জনি প্রমুখ যারা তাকে নির্বাচনের মাঠে এনেছিলেন তাদের বড় ভুল ছিল। সেটা একজন ফুটবলের মানুষকে আনতে পারেননি তারা। একজন ফুটবলার তথা ক্রীড়াঙ্গনের মানুষকে নির্বাচনী লড়াইয়ে শামিল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা সালাউদ্দিনকে সভাপতির চেয়ারে চাননি ভাল কথা, একজনকে সবসময় সবাই পছন্দ করবে সেটা নাও হতে পারে। তবে যদি সালাউদ্দিনের সমকক্ষ ফুটবলাঙ্গনের কাউকে প্রার্থী করতে পারতেন সেটাই হতো তাদের জন্য বড় কৃতিত্ব। কিন্তু সেটা তারা পারেননি। এত কম ভোটের নির্বাচনে, চেনা মানুষের সামনে যে এভাবে হুট করে প্রার্থী করে কাউকে জেতানো যায় না সেটা তারা বোঝেন নি। যদি খেলার মাঠের কাউকে মনোনীত করতেন তাহলে ফলাফল কী হতো সেটা বলতে পারব না তবে অনেক বিতর্ক, অনেক কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি হতো না এটা নির্দ্বিধায় বলে দেযা যায়। সেটা না করে নেপথ্য নায়করা নিজেরা পর্দার আড়ালে থেকে মঞ্চে একটা পুতুল নাচিয়েছেন। যদিও শেষ লড়াইটাতে তারাই হেরেছেন। ফুটবলাঙ্গনটা এমন জায়গা নয় যে, এখানে এলাম, নির্বাচন করলাম; জয়ী হয়ে চেয়ারে বসে গেলাম। এবারের বাফুফের নির্বাচনটা ছিল বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা উত্তাপ ছড়ানো নির্বাচন। যা কিনা যে কোন সংসদ নির্বাচনকেও হার মানিয়েছিল। নির্বাচনে অর্থের ঝনঝনানি ছিল, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়েছে, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আজেবাজে কথার অবতারণা হয়েছে, পেশীশক্তির মহড়ারও ইঙ্গিত ছিল। এ কারণে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় র‌্যাডিসন হোটেলের মতো একটি সুরক্ষিত স্থানে। বাংলাদেশের ফুটবলানুরাগী মানুষ এ সবের কোন কিছুই আশা করেনি। যারা নির্বাচন করেছেন তারা সবাই ফুটবলকে ভালবাসেন, ফুটবলের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে চান। কিন্তু তার জন্য এত টাকা-পয়সা ছড়াছড়ি কেন সেটা আমার বোধগম্য নয়। এই অর্থের লেনদেন, এ সব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা গাওয়া এ সবই তো গর্হিত ও অনৈতিক কাজ। যারাই এটা করেছেন তারা নিজের বিবেকের কাছে কী জবাব দেবেন? আমরা যেখানে একটি দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি সেখানে কোন নির্বাচনে এমন টাকা-পয়সা আর উপঢৌকনের লেনদেন সেই সুষ্ঠু-সুন্দর সমাজ গড়ার পথে অন্তরায় সৃৃষ্ট করবে বৈকি। এ দিয়ে আমরা আমাদের পরের প্রজন্মকে কী শিক্ষা দেব? আশা করি সবাই এ বিষয়টির দিকে নজর রাখবেন। প্রত্যেকে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকবেন। যা হোক, আবার নির্বাচনের আলোচনায় ফিরে আসি। এবারের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)’র নির্বাচনের উত্তাপ শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। অনেক গুঞ্জন, অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচন করছেন কী করছেন না সেটা নিয়েও কম পানি ঘোলা হয়নি। অনেকবারই শোনা গেছে, কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। যদিও তাঁকে সরানোর জন্য একটা পক্ষ আদাজল খেয়ে লেগেছিল। তারা ‘বাঁচাও ফুটবল’ নামে একটা ফোরামও দাঁড় করিয়েছিল। ‘বাঁচাও ফুটবল’র কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে বলতে হবে কাজী সালাউদ্দিনের কথা। ২০০৮ সালে কাজী সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার আগে বাংলাদেশের ফুটবলের অবস্থার কথা অনেকেই ভুলে যাননি। তখন নিয়মিত ফুটবল খেলাই হতো না। দলবদল, টুর্নামেন্টের দাবিতে ফুটবলারদের আন্দোলন কম হয়নি। তখন অনেক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অংশ নিতে পারেনি। আর অংশ নিতে না পারার কারণে অনেক সময় জরিমানাও গুনতে হয়েছে। কাজী সালাউদ্দিন দায়িত্ব নেয়ার পর কী করেছেন? তিনি কথা দিয়েছিলেন, দায়িত্ব পেলে ফুটবলকে সারা বছর মাঠে রাখবেন। তিনি গত ৮ বছরে তার কথা রেখেছেন। লিগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে এই ৮ বছরে বাংলাদেশ সরব ছিল। বলা যায়, কোন না কোনভাবে বছরের ১২ মাসই ফুটবল মাঠে ছিল এবং বর্তমানেও আছে। এই ৮ বছরে কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে জরিমানা গুনতে হয়নি। বলা যায়, তিনিই ফুটবলকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এটা তার বিশাল কৃতিত্ব। তার এ কাজেরই মূল্যায়ন করেছে ভোটাররা। অনেক প্রলোভনও তাদের নেয়া সঠিক সিদ্ধান্তকে টলাতে পারেনি। সালাউদ্দিরে জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেটা কতটুকু করতে পারতেন সেটা বলা কঠিন! তবে তার সময়ে জেলার মাঠগুলোতে ফুটবল অনেকটা অনুপস্থিত ছিল বলে যে অভিযোগ আছে তার জন্য তাকে একা দায়ী করা যাবে না। কেননা, এ কাজটি কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। জেলায় ফুটবল লীগ বা টুর্নামেন্টের দায়িত্ব সবাই ভাগ করে নিলে এটা হতো না। তবে কাজী সালাউদ্দিন এবারের নির্বাচনের মেনুফেস্টোতে বলেছেন, ‘তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে চান।’ সবার শুভ কামনায় কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা আশা করছি, এই মেয়াদে তার অসমাপ্ত কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হবে আবার প্রতিটি জেলা ফুটবলের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠা। আর সেটা তিনি করতে পারবেন সবাই সেটা বিশ্বাসও করে। এবারের বাফুফের নির্বাচনে সভাপতি পদে কাজী সালাউদ্দিন ছাড়াও আরও ৩ জন প্রার্থী হয়েছিলেন। কাজী সালাউদ্দিন, কামরুল আশরাফ পোটন এমপি, গোলাম রব্বানী হেলাল ও নুরুল ইসলাম নুরু সভাপতি পদে প্রার্থী হন। পরে হেলাল কাজী সালাউদ্দিনের পক্ষে ও কামরুল আশরাফ পোটন এমপির পক্ষে সমর্থন দিয়ে নুরু মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। অনেক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর শেষ পর্যন্ত সব সংশয় কাটিয়ে কাজী সালাউদ্দিন তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হলেন। তিনি তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ‘বাঁচাও ফুটবল’ প্যানেলের প্রার্থী সার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কামরুল আশরাফ পোটন এমপিকে ৩৩ ভোটে (৮৩-৫০) পরাজিত করে বিজয় সুনিশ্চিত করেন। মাত্র ১৩৪ ভোটে ৩৩ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়া বিশাল ব্যবধানই বটে। এর আগে ২০০৮ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব) আমিন আমমেদকে ১৪ ভোটে (৬৩-৪৯) পরাজিত করে প্রথমবার বাফুফের সভাপতির হট সিটে বসেন। ৪ বছর পরের নির্বাচনে তাকে নির্বাচন করতেই হয়নি। সেবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আর এবারে পোটনকে পরাজিত করে যে তিনি একা নির্বাচিত হয়েছেন তাই নয়। তার প্যানেল থেকে সিনিয়র সহ-সভাপতি পদে সালাম মুর্শেদী নির্বাচনের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন। আর নির্বাচনে একটি সহ-সভাপতি (তাবিথ আওয়াল) ও ৩টি সদস্য পদ বাদে বাকি সবগুলোতে তার প্যানেলের প্রার্থীরা জিতেছে। প্যানেলের সদস্যপদে মাত্র ২ জন জিতেছে। তার মানে কোন সিদ্ধান্ত নিতে তার কোন অসুবিধে হবে না। ‘বাঁচাও ফুটবল’ জিতলে কী হতো জানি না। তবে কাজী সালাউদ্দিনের প্যানেল জেতায় যে ফুটবল বেঁচেছে সে কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। অন্তত এটাতে কারো সন্দেহ থাকবে না যে আগামী ৪ বছর ফুটবল মাঠে থাকবে। আর সভাপতির চেয়ারে কাজী সালাউদ্দিন আছেন বলে সেটা অসম্ভব বলে কেউ মনে করেন না। স্যালুট, কাজী সালাউদ্দিন। একজন দক্ষ স্ট্রাইকার হিসেবে আজও তাকে এ দেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। একজন সুদক্ষ সংগঠক তথা বাফুফের সভাপতি হিসেবে গত ৮ বছরে তার কর্মকা- বাংলাদেশের ফুটবলকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেছে। দুই দুইবার সাফ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম নিঃসন্দেহে অনেকখানি বৃদ্ধি করেছেন। ৪ বছর পরের নির্বাচনে আপনি আবার প্রার্থী হবেন কিনা সেটা ভবিতব্যই বলতে পারবে। তবে আমাদের আশাবাদ, আপনার এই মেয়াদে ফুটবলের উন্নয়নের জন্য এমন কিছু করে যাবেন যাতে সংগঠক সালাউদ্দিন ফুটবলার সালাউদ্দিনকেও ছাড়িয়ে যায়। স্ট্রাইকার সালাউদ্দিন যেমন হাজার বছর বাংলার ফুটবলামোদির হৃদয়ে বেঁচে থাকবে, পাশাপাশি যেন সংগঠক সালাউদ্দিনও বেঁচে থাকে। আপনার ভাল কাজের প্রেরণা যোগাবে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের শুভ কামনা। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক e-mail : [email protected]
×