ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজিজুর রহমান

বিপর্যস্ত ধরিত্রী ও বিধ্বস্ত প্রাণিকুল

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৯ এপ্রিল ২০১৬

বিপর্যস্ত ধরিত্রী ও বিধ্বস্ত প্রাণিকুল

স্মরণকালের সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি অতিক্রম করছে সবুজ-সজীব জীবন্ত এই প্রিয় ধরিত্রী। প্রকৃতিবিরোধী মানুষের কর্মকা-ের দরুন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নিজের বুকে পরম মমতায় আগলে রাখা ধরিত্রীর পাহাড় পর্বত, দূষিত হয়ে পড়ছে নদী ও সমুদ্র, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষ ও বনাঞ্চল, শূন্য হয়ে পড়ছে ভূগর্ভস্থ খনিজ ও পানির ভা-ার, মরে যাচ্ছে প্রাণচাঞ্চল্য জাগানিয়া মাতৃসম মৃত্তিকা, বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে শ্বাস নেয়ার বাতাস আর উষ্ণ করে তোলা হচ্ছে বায়ুম-ল। তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে কার্বন ডাই অক্সাইডসহ বিভিন্ন গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে উষ্ণ হয়ে ওঠা বায়ুম-ল- যার প্রভাবে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। সমগ্র ধরিত্রীর ওপর প্রকৃতির প্রতিশোধ স্পৃহার মারাত্মক আঘাত হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। উষ্ণায়নের কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠের ওপরের ক্ষয়িষ্ণু পদার্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটগ্রস্ত হচ্ছে মেরু অঞ্চলসহ ধরিত্রীর বুকের প্রতিটি পার্বত্যাঞ্চলের বরফ, হিমবাহ ও তুষার মুকুট ইত্যাদি। মেরু অঞ্চল এন্টার্কটিকা, এন্টার্কটিক মহাদেশের ম্যাগনেটিক আইল্যান্ড, আর্কটিক সাগর আইসল্যান্ড এবং গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলে যাচ্ছে। এছাড়া, গ্রীনল্যান্ডের উত্তর থেকে সুমেরু পর্যন্ত ত্রিকোণ অঞ্চলের বরফের পুরুত্বও মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। এদিকে, তানজানিয়ার মাউন্ট কিলিমানজারো, কেনিয়ার মাউন্ট কেনিয়া, হিমালয় পার্বত্যাঞ্চলের শতাধিক পর্বতসহ সকল পাহাড়-পর্বত চূড়ার বরফ, তুষার মুকুটগুলো গলে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর স্নো এ্যান্ড আইস (আইসিএসআই) এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউঅফ) বিভিন্ন জরিপ, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা থেকে পাওয়া রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়। পাহাড়-পর্বতের তুষার মুকুট ও হিমবাহগুলো যে হারে গলে যাচ্ছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে এগুলোর অর্ধেক এবং ২১০০ সালের আগে তা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আইপিসিসি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে, চলতি শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৮ থেকে ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। আর সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে ৭ থেকে ২০ ইঞ্চি। ফলে ২১০০ সালে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়াবে এখনকার চেয়ে ১ মিটার বেশি। গবেষকরা জানাচ্ছেন, বর্তমান হারে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে অনেক উপকূলীয় নিম্নভূমিÑ মালদ্বীপ ফিজি, মার্শাল, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ, টু ভ্যালু, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, কিরিবাতি, ভিয়েতনাম ও মিসরের বদ্বীপ এলাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি নদীর উপকূলের অংশ। এমনকি ভারতের মুম্বাই, চেন্নাই ও নিউইয়র্কের মতো সাগরঘেঁষা নগরীও তলিয়ে যেতে পারে। প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার নিম্নাঞ্চলও। পরিবেশ উদ্বাস্তু হবে বিশ্বের ২২ শতাংশ মানুষ। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাবে বাতাস থেকে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের কারণে সমুদ্রের পানিতে এ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে পানির কম্পনও। ফলে উষ্ণ হয়ে উঠছে সমুদ্রের পানি ও বাতাস। পানির এ্যাসিডিটি, উষ্ণতা, কম্পন ও উচ্চতা বৃদ্ধির মিথস্ক্রিয়ায় অস্থির হয়ে উঠছে সাগর-মহাসাগরগুলো। ফলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে সব ধরনের সামুদ্রিক দুর্যোগ। পার্বত্যাঞ্চলের বরফ ক্রমাগত গলতে থাকায় মারাত্মক পানি সঙ্কটে পড়বে বিশ্বের নদ-নদীগুলো। ২০৫০ সালের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে নদ-নদীগুলোর পানি প্রবাহ বেড়ে যাবে। প্রাথমিকভাবে এর প্রভাব বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে শুরু হলেও ৩০ থেকে ৪০ বছর পর নদ-নদীর প্রবাহ আবার কমতে থাকবে। বরফ গলা শেষ হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত নদ-নদীগুলো স্থায়ীভাবে শুকিয়ে খটখটে হয়ে যাবে। এরপর ২ থেকে ৩ দশকের মধ্যে নদ-নদীগুলো বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে বর্ষাকালীন মৌসুমী নদীতে পরিণত হবে। উল্লেখ্য, বিশ্বের প্রায় নদ-নদীই এর প্রবহমান স্রোতধারার জন্য বৃষ্টির পানি নয়, পাহাড়-পর্বতের বরফ গলা পানির ওপরই বেশি নির্ভরশীল। বৈশ্বিক, উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এরই মধ্যে বিপর্যয়ে পড়তে শুরু করেছে জীবন-দায়িনী ধরিত্রী। এই বিপর্যয়ের কারণে কমে যাচ্ছে শীতকালের স্থায়িত্ব, দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে খরা, নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। তাছাড়া বাড়ছে ভূমি ও পাহাড় ধস। ঘন ঘন ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, সুনামি, দাবানল, লুহাওয়া, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ, মাত্রাতিরিক্ত গরম, অতিবৃষ্টিসহ বিভিন্ন দুর্যোগে প্রতিবছর প্রাণহানি ঘটছে বিপুলসংখ্যক মানুষ ও প্রাণিসম্পদের। কলেরা, বসন্ত, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মার মতো প্রাণঘাতী রোগগুলো ফিরে আসছে বহুগুণ শক্তি নিয়ে। ভবিষ্যতে ডিপথেরিয়া, ডেঙ্গু ও যক্ষ্মা রোগের বিরুদ্ধে টিকাও তেমন কোন কাজে আসবে না। আরও আতঙ্কের বিষয় হলো মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমশ কমে যাবে। ফলে নিত্যনতুন জীবাণু দ্বারা খুব সহজেই বিপুল জনগোষ্ঠী বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে। সেই সঙ্গে নানা অজ্ঞাত ও মারাত্মক সব রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে মানুষ ও প্রাণিজগতে। এছাড়া গ্রীনহাউস গ্যাসের কারণে ছিদ্র হয়ে যাওয়া বায়ুম-লের ওজোনস্তর ভেদ করে সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি যে আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে তা হলো ত্বকে মারাত্মক ক্যান্সার রোগ ছড়িয়ে পড়া, চোখে ছানি রোগে আক্রান্ত হওয়া, জলজ খাদ্যচক্রের নিয়ামক ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও ডায়াটস উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, বিশ্বব্যাপী এ্যামফিরিয়ানস বা উভচর প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এবং সালোক সংশ্লেষণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে উদ্ভিদ তথা শস্য উৎপাদন কমে যাওয়া। এ বিপর্যয়ে পড়ে এরই মধ্যে ধরিত্রীর বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বিশ্বের ৯৭৬ প্রজাতির উদ্ভিদকে বিপন্ন এবং ১৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদকে ‘হুমকিগ্রস্ত’ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। তবে জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন ২০০৯ সালে প্রকাশিত একটি উদ্বেগজনক প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৭০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছরে এক-তৃতীয়াংশ প্রাণী প্রজাতি পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে স্থলচর ২৫, সামুদ্রিক ২৮ এবং মিঠাপানির প্রজাতি ২৯ শতাংশ। এই বিলুপ্তি থেকে মানুষ প্রজাতিও বাদ পড়েনি। আর এই প্রজাতিটির বিলুপ্তির পরিমাণ ১ শতাংশ। ধরিত্রীর দিকে নিঃশব্দে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসা মহাপ্রলয়ের অশনি সঙ্কেত উল্লেখ করে বেলজিয়ামের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ১০০ বছরের মধ্যে সমগ্র মানবজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সংগঠনটির পর্যবেক্ষণকারী বিজ্ঞানীরা আরও জানান, পুরো মানবজাতি যদি বিলুপ্ত নাও হয় তবু শত শত কোটি মানুষের মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যে জানা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। যে ধরিত্রী প্রাণস্পন্দন টিকিয়ে রাখতে, মানুষকে বেঁচে থাকতে সব ধরনের উপাদান যোগান দিয়ে আসছে, সেই ধরিত্রীই এখন মানুষসহ সকল প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য মৃত ও প্রাণহীন গ্রহে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বের প্রতিটি সচেতন নাগরিকই আজ উপলব্ধি করতে পারছেন মানুষের কৃতকর্মের প্রতিশোধ নিতে রুদ্র প্রকৃতির আক্রমণের শিকার বিশ্বের কোটি কোটি নির্দোষ অসহায় মানুষ আর মহাবিশ্বের বিস্ময় আমাদের এই জীবন্ত ধরিত্রী। মানবজাতি বেশ চড়া মূল্যে অনুধাবন করতে পারছে প্রকৃতিবিরোধী এই অব্যাহত আত্মঘাতী কর্মকা- বন্ধ করা না গেলে প্রাণিকুল তো বটেই শেষাবধি প্রিয় ধরিত্রীর অস্তিত্বই ধ্বংস হয়ে যাবে। লেখক : গবেষক
×